ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

শঙ্খচিলের গান

ফরিদ আহমেদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৮, ২০১৪
শঙ্খচিলের গান

পর্ব ১
বিদেশী শাসন এবং শোষণ থেকে মুক্তির তীব্র আকাঙ্খাই জন্ম দিয়েছে জাতীয়তাবাদের। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জন্য তৈরি হয়েছে মুক্তিকামী মানুষের গণ আন্দোলনের।

আর এই সব গণআন্দোলনকে পুষ্টি দিতে জন্মেছে গণ-সঙ্গীত। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার আগে স্বদেশী গানগুলি ছিল সে যুগের গণ-সঙ্গীত। এই গানগুলো দেশবাসীকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সাহস যুগিয়েছে, প্রেরণা দিয়েছে। এই গানগুলিই যুগিয়েছে সাদা ব্রিটিশের চোখে চোখ রেখে কালো মানুষের নিজের অধিকার আদায়ের স্পর্ধাটুকু দেখানোর। এই গানগুলিই ব্রিটিশ সৈন্যের বুলেট আর ফাঁসির মুখোমুখি হতে সাহস যুগিয়েছে অগুণতি মানুষকে।

এই গানগুলির গুরুত্ব কমেনি আজও। নানা সময়ে শোষণ থেকে মুক্তির জন্য শ্রমজীবী মানুষের মনে সাহস ও উদ্দীপনা জাগিয়েছে। গণ-আন্দোলনের অপরিহার্য এক শক্তি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে গণ-সঙ্গীত।

অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে যে গান সদা সোচ্চার, মানুষের দুঃখ দুর্দশাকে দূর করার জন্য, তাঁকে সুস্থ সুন্দর জীবনে নিয়ে আসার জন্য পথ দেখায় যে গান, তাই গণসঙ্গীত। অধিকার সচেতন, শ্রেণীচেতনায় উদ্বুদ্ধ মানুষকেই বলা যায় ‘গণ’। আর তাদের জন্য যে গান তাই গণ-সঙ্গীত। আমাদের দেশে ‘গণসঙ্গীত’ কথাটার ব্যবহার শুরু হয়েছে চল্লিশের দশকের প্রথম দিক থেকে।

বিশ শতকের বাংলা গানে গণসঙ্গীতের স্থান অনেক উপরে। পরাধীনতার জ্বালায়, অপমানে, ক্লেশে ভারতবাসী স্বরাজের স্বপ্নে বিভোর হয়ে ওঠে। বিদেশী ইংরেজ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বরাজ প্রতিষ্ঠা তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল। আর এই লক্ষ্যে গণসঙ্গীত পালন করেছেন এক অনন্য ভূমিকা।

১৯১৭ সালের অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর এদেশে প্রলেতারীয় মতাদর্শের সূচনা হয়। গানে এর রূপ পায় নজরুলের লেখায়। রণাঙ্গন থেকে নজরুল কোলকাতায় এলে তখনকার কমিউনিস্ট নেতাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। ইতিপূর্বে রাশিয়ার বিপ্লব তাঁকে প্রচণ্ডভাবে ধাক্কা দিয়েছে। কোলকাতায় এসেই কমিউনিস্টদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেন নজরুল। ১৯২১ সালে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার যে পরিকল্পনা নেওয়া হয় সেখানে অংশ নেন তিনি।

শুরু হয় শ্রমিকের রক্তপতাকার জয়গান। ১৯২৬ সালে কৃষ্ণনগরে ‘নিখিল বঙ্গীয় প্রজা সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে ‘বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিকদল’ তৈরি হলো। নজরুল সম্ভবত এসময়েই আন্তর্জাতিক সঙ্গীতটির ভাবানুবাদ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনাকালে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের পটভূমিকাতেই গণসঙ্গীতের জোয়ার শুরু হয়।

গণসঙ্গীতের বিস্তার খুব সহজেই ঘটতে পারে। সাধারণ মানুষ নিজে থেকেই গলায় তুলে নিতে চায় এর কথা ও সুর। যন্ত্রণাময় জীবন থেকে বেঁচে ওঠবার স্বপ্ন সে পায় এসব গানে। এ গান খুব সহজভাবে বাঁধা সড়কের বাইরে পা ফেলতে পারে। সুরের নতুন প্রয়োগ দেখা যায়, আবার বিভিন্ন ধরনের সুরের ও গায়নভঙ্গির মিশ্রণও ঘটে এখানে।

বাংলা গণসঙ্গীতে অনেকেরই অবদান রয়েছে। বিখ্যাত থেকে স্বল্পখ্যাত, এমন বহু শিল্পীই গণসঙ্গীতে নিজেদের উজাড় করে দিয়েছেন। গণসঙ্গীত যেহেতু গণমানুষের গান। কে যে কোথায় কখন এই গান গাইছে, তার হদিস রাখা মুশকিল। তারপরেও যাঁরা গণসঙ্গীত গেয়েছে, রচনা করেছেন, সুর সংযোগ করেছেন, তাঁদের মধ্যে নিঃসন্দেহে হেমাঙ্গ বিশ্বাস হচ্ছেন সবার উপরে, সবচেয়ে স্মরণীয় নাম। বাংলা গণসঙ্গীতের প্রথম সারির স্রষ্টা।

হেমাঙ্গ বিশ্বাসের জন্ম ১৯১২ সালে। জন্মেছিলেন হবিগঞ্জের মিরাশী গ্রামে। জমিদার পিতার সন্তান ছিলেন তিনি। কিন্তু, জমিদারের উচ্চশ্রেণীতে নিজেকে আটকে রাখেননি তিনি। রাজনৈতিক মতাদর্শে এবং অঙ্গীকারে তিনি অতিক্রম করেছিলেন শ্রেণীর সীমানাকে । আজীবন বামপন্থার প্রতি নিষ্ঠা দেখিয়েছেন। শোষিত, নির্যাতিত, খেটে খাওয়া সংগ্রামী মানুষের প্রতি তাঁর পক্ষপাত অটুট থেকেছে মৃত্যু পর্যন্ত। শিরদাঁড়াটাকে সোজা রেখেছেন আগাগোড়াই। তাঁর সঙ্গের অনেক লাল কমরেডই জীবনের যাত্রাপথে আপোষ করে বর্ণ পালটেছেন, তিনি করেননি। অনেকেই বাম থেকে সরে গেছেন ডানে। তিনি অবিচল থেকেছেন আপন অবস্থানে। এর জন্য সকল মোহকে, সকল লোভ-লালসাকে দূরে সরিয়ে রাখতে হয়েছে তাঁকে।

যে পরিবারে তিনি জন্মেছিলেন, সেখানে গান-বাজনার কোনো চর্চা ছিল না। তাঁর মায়ের পরিবার অবশ্য ছিলো ভিন্ন। নানা ছিলেন সে সময়ের নামকরা তবলা বাদক। মা সরোজিনী বিশ্বাসও গান কিছুটা জানতেন। মায়ের আগ্রহেই তাঁর কবিতা লেখার সুত্রপাত। শৈশবে স্কুলে যাবার পথে গান গেয়ে গেয়ে স্কুলে যেতেন। কিন্তু, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গান শেখার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি। জ্যোতিপ্রকাশ আগারওয়ালের কাছ থেকে গানের কিছুটা তালিম নিয়েছিলেন এক সময়। সেটাই ছিল তাঁর একমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। এর বাইরে বলা যেতে পারে যে, গানের ক্ষেত্রে তিনি মূলত স্বশিক্ষিতই ছিলেন। হেমাঙ্গ বিশ্বাস নিজেই এ সম্পর্কে বলেন যে, “গানের প্রতি আমার এই আকর্ষণ কিন্তু বাবার মোটেও মনঃপূত ছিল না। তাই ইস্কুল যাওয়ার পথে মাঠ ঘাট ছিল আমার গাইবার ক্ষেত্র। খেতের কৃষকরা আমার গান শুনতে খুব ভালবাসতো। এমনি করে মাঠের সঙ্গে হাওয়ার সঙ্গে আমার গানের সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেলো। ‍”

শৈশব থেকেই লোকসঙ্গীত গাইতেন এবং তা নিয়েই ভাবতেন আর চর্চা করতেন বলেই লোকসঙ্গীতে অসামান্য দখল ছিল তাঁর। লোকসঙ্গীতের সরল আবহ দিয়ে সহজ-সরল সাধারণ মানুষের কাছে সহজে পৌঁছে যাওয়া যায়, এটা শুরুতেই টের পেয়েছিলেন তিনি। সে কারণে লোকসঙ্গীতের আঙিকেই মূলত গণসঙ্গীত গেয়েছেন তিনি।

কলেজে থাকা অবস্থায় হেমাঙ্গ বিশ্বাস জড়িয়ে পড়েন স্বদেশী আন্দোলনে। আন্দোলন করতে গিয়ে আটক হন। বিচারে ছয় মাসের জেল হয় তাঁর। কলেজ থেকে বহিষ্কৃতও হতে হয় তাঁকে এজন্য। তাঁর কারাভোগের এখানেই শেষ না। স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ততার কারণে ১৯৩২ সালে আবারও গ্রেফতার হন তিনি। প্রায় তিন বছর কারাভোগ করতে হয় সে সময়। জেলে থাকা অবস্থাতেই আক্রান্ত হন সেই সময়কার মরণব্যাধি যক্ষ্মাতে।

জেলে থাকা অবস্থাতেই ইংরেজরা বেশ কয়েকবার প্রস্তাব নিয়ে এসেছে তাঁর কাছে। আর কখনো স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত হবেন না, এটা লিখিত দিলে মুক্তি পাবেন তিনি। এরকম অবমাননাকর প্রস্তাবগুলোকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেন তিনি। যক্ষ্ণায় তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত জেনে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে মুক্তি দেয়। মৃত্যুপথযাত্রী মানুষকে জেলে রাখা বড্ড বেশি ঝামেলার কাজ।

জেল থেকে বের হয়ে এসে পরপারে যাবার বদলে সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি। তবে, এর জন্য তাঁকে যাদবপুর যক্ষ্মা হাসপাতালে থাকতে হয় দীর্ঘ তিনবছর । জেলে থাকা সময়ে কংগ্রেসের অহিংস নীতির প্রতি আস্থা-বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন তিনি। এবারে ঝুঁকে পড়লেন মার্কসবাদী রাজনীতির প্রতি। ১৯৩৯ সালে কংগ্রেস সভাপতি সুভাষ বসু হবিগঞ্জে এলে তাঁকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। সংবর্ধনাপত্র পাঠ করেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস।

চা বাগানের শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলন এবং ডিকবয় তেল কোম্পানির শ্রমিক হত্যার প্রতিবাদে সংঘটিত আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৪২ সালের ১৮ জুলাই কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে সিলেট শহরের গোবিন্দচরণ পার্কে সাংস্কৃতিক স্কোয়াড  ‘সুরমা ভ্যালি কালচারাল স্কোয়াড’ গঠন করেন। সিলেট তখন বাংলার অংশ ছিল না, ছিল আসামের অংশ। গানের স্কোয়াড নিয়ে চষে বেড়িয়েছেন তিনি সারা আসাম জুড়ে।

লেখক : বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক। মুক্তমনার প্রাক্তন মডারেটর

বাংলাদেশ সময়: ১৬২২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।