নয় এগারোর সন্ত্রাসী হামলার পর আপনার নিরাপত্তা একটি এয়ারপোর্টের নিরাপত্তা ব্যবস্থার মতই মারাত্মক মজবুত ও কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে ওই দিন সন্ত্রাসী হামলায় টুইন টাওয়ারের ধ্বংসাবশেষ ও এ সংক্রান্ত ঘটনা নিয়ে যে জাদুঘর তৈরি হয়েছে, তার ভেতরে সবাই বেশ নিরাপদ অনুভব করেন।
বেসবল কিংবা পাই যেমন সঙ্গে থাকে, মার্কিন নাগরিকদের সঙ্গে তেমনি বার্কিংডগ বা নিরাপত্তা কুকুরকেও রাখতে হয়। সবসময়ই আপনার পেছনে কুকুরের মত নিরাপত্তারক্ষাকারী কেউ যেন থাকছে। ব্যক্তির এই সাধারণ আত্মমর্যাদাহীনতার মধ্যেই নয় এগারোর জাদুঘর অংশ হয়ে গেছে আপনার নিরাপত্তা অভিজ্ঞতার। জীবনের ভাব ও তাৎপর্যের পুরো বিপরীত হয়ে যাচ্ছে এটি। এর ফলে মার্কিন জীবনযাপন ও দেশটির গণতন্ত্রের মধ্যে মৌলিক সংঘাত ও দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। এমনকি শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র খুব দ্রুত একটি সিকিউরিটি স্টেট বা নিরাপত্তা রাষ্ট্রে রূপ নিতে যাচ্ছে।
জাদুঘরটি তৈরি করা হয়েছে মাটির নিচে। বাতাসভরা একটি প্যাভিলিয়নের ভেতর দিয়ে দর্শকদেরকে ওই জাদুঘরটির (জাদুঘরটির নকশা তৈরি করেছে স্নোয়েতা নামের নরওয়ের একটি ফার্ম) ভেতরে ঢুকতে হয়। প্যাভিলিয়নটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে— যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দুটি স্কয়ার ও ধীরে ধীরে পতনশীল ঝর্নার কয়েকটি ক্যাভারনাস। এতে এমন একটি আবহ ও পরিবেশ গড়ে তোলা হয়েছে, যা নয় এগারোর সেই ধ্বংসযজ্ঞ ও মৃত্যুর স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। তিন বছর আগেই আকর্ষণীয়, মোহনীয় আর সতর্কসঙ্কুল এই জাদুঘরের নকশা তৈরি করেন মাইকেল অ্যারাড। তবে জাদুঘরটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয় চলতি বছরের মে মাসে। শিক্ষাগ্রহণ, অভিজ্ঞতা ও স্মৃতিমূলক তাৎপর্য সৃষ্টি করা হয়েছে এ জাদুঘরে।
অবশ্য এধরনের অভিজ্ঞতাধর্মী বা প্রামাণ্য জাদুঘর যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে চরম বিকাশের একটি স্তর বটে। এই গণহত্যা জাদুঘরের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়াগুলো তৈরি করেছে রাল্ফ আপেলবাম এসোসিয়েটস। এতে তাদের যে লক্ষ্যগুলো অর্জিত হয়েছে সেগুলো হল, আবেগময় ও সংবেদনশীল ভাষায় শিক্ষামূলক জিনিস অন্তর্ভুক্ত করা। এর ভাষা এমন, যা ক্ষণে ক্ষণে তুমুল আবেগময় করে তুলবে। জাদুঘরের প্রতিটি স্থাপত্য বিষয়ক উপাদান, চলচ্চিত্র, সাহিত্য ও ধর্ম বিষয়ক উপাদানও ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
এই জাদুঘর মূলত পশ্চিমা সভ্যতার একেবারে গোড়ার একটি প্রতীক। এর মধ্যে পশ্চিমের উত্তেজনাও ধরা পড়ে। জাদুঘরটি স্বচক্ষে দেখার পর শেষে যে অভিজ্ঞতা হবে, তাতে আপনার উপলব্ধিটা এমন হবে যে, এটি শুধু একটি জাদুঘরই নয়। আপনার মনে হবে, একটি আধা পবিত্র স্থানও তাতে গড়ে তোলার প্রয়াস চালানো হয়েছে। আর এ পুত-পবিত্র স্থানটি হলো, একটি ধর্মের উপস্থাপন— মানে যেটি হল একটি নতুন ধর্ম। যেখানে এই জাদুঘরের মধ্য দিয়ে পুরোপুরি একটি ভাষা তৈরি করা হয়েছে। তাতে যথাযথভাবে একটি ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতিকে শোক ও নতুন অর্থব্যাঞ্জনায় উদযাপন করা হয়েছে। একইসঙ্গে তাতে অভিষিক্ত হয়েছে গণমাধ্যম এবং গণমাধ্যম-সম্পৃক্ত দুনিয়া ও ব্যক্তি।
এক লক্ষ দশ হাজার বর্গফুট উপর দিয়ে আড়াআড়িভাবে এর ব্যাপ্তি ও প্রশস্ততা তৈরি হয়েছে—যেটি বিধ্বস্ত বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের একেবারে গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত। যেটি দেখতে একদম মার্কিন জঙ্গিদের খ্রিস্টান ক্যাথেড্রাল চার্চের পাতাল সুড়ঙ্গের মতো। বেশ বেদনাদায়ক ও ব্যক্তিক্রমও বটে।
এটি একটি অনস্বীকার্য অবস্থা। জাদুঘরটি এমনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে, তাতে যখন দর্শনার্থীরা প্রবেশ করবে, মানে অবতরণ করবে এর গভীরে, তাতে তারা আলো-আঁধারী অবস্থা, বিভিন্ন শব্দ ও কণ্ঠের তীব্র ছুটাছুটি, পাশাপাশি কারো ছুটে যাওয়া, ভয় আর হরর ফিউশন, সংশয় আর আতঙ্কময় এক পরিবেশের মুখোমুখি হবে। এই পরিবেশে থাকবে আঘাত, ঘোঙানির শব্দ, হতাশার আর্তচিৎকার এবং হাজারো বিচিত্র শব্দ ও ভাষার কণ্ঠস্বর। সবমিলিয়ে এর ভিজুয়াল ও অধিবিদ্যাগত প্রভাব খুবই শক্তিশালী নিঃসন্দেহে। সেখানে আল কায়েদার হামলায় যে ধ্বংসযজ্ঞ ঘটেছে তার বড় ধরনের একটি সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যাবে এই ভীতিপ্রদ স্মৃতিসৌধে।
এই জাদুঘর তৈরির ধারণা এবং কাঠামোগত অবস্থা ও প্রতিবেশের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে খ্রিষ্টান ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনগত ঐতিহ্য। জাদুঘরের অভ্যন্তরের নীরবতা, আলো-অন্ধকার, ভেতর-বাহির, পুনরুত্থান, পুনরাবির্ভাব, পবিত্র নগরদুর্গ, পবিত্র দেয়াল, শোক ও দুঃখের জলধারা—এসবই গভীর আবেগময় ও সংবেদনশীল। যা খুবই অর্থবহ, প্রতীকী এবং বিশেষভাবে খ্রিষ্টান অর্থোৎপাদনের সাথে যুক্ত।
*লেখাটি সম্প্রতি মার্কিন প্রভাবশালী সংবাদ মাধ্যম ‘ওয়াশিংটন পোস্টে’ প্রকাশিত হয়েছে
ফিলিপি কেনিকট: মার্কিন শিল্প ও স্থাপত্য সমালোচক
অনুবাদক: শাহাদাৎ তৈয়ব