আজ ৯/১১। পৃথিবীবাসী মাত্রই জানেন- এই দিনে আমেরিকার টুইন টাওয়ারে হামলা হয়েছিলো এবং আমরা সরাসরি দেখতে পেয়েছিলাম বিশাল দুটি দালান মুহূর্তে ধুলোয় মিশে গেলো।
ওই হামলার পর পরিবর্তন হয়েছে বিমান ভ্রমণের নিয়ম কানুন থেকে হাজারো কিছুর। প্রতি বছর এই দিনে পশ্চিমা দেশগুলো বিশাল সতর্কতা জারি করে, বৃহস্পতিবারও করেছে। এ প্রসঙ্গে নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলতে হচ্ছে। আমার ধারণা এ ধরনের অভিজ্ঞতা আমার মতো অনেকেরই হয়েছে।
আমার নামের পাশে "ইসলাম" থাকায় পুরো পৃথিবীর যে বিমান বন্দরে দিয়েই যাতায়াত করি না কেন, খেয়াল করে দেখেছি আমার পাসপোর্ট দুই বার করে চেক হয়। একবার তো জার্মানিতে আমাকে এক ঘণ্টার মতো প্রশ্ন করা হয়েছিলো। আরেকবার, বেলজিয়াম থেকে আমেরিকা যাচ্ছি সেখানেও একই কাণ্ড।
প্রাসঙ্গিক আরেকটি অভিজ্ঞতার কথা বলতেই হচ্ছে। একটা ওয়ার্কশপে গিয়েছি পশ্চিমা একটি দেশে। ওই ওয়ার্কশপের বিষয়বস্তু হচ্ছে-"ইসলাম ও জঙ্গিবাদ"। আমিও একজন বক্তা সেই প্রোগ্রামের। তো মূল ভেনুতে ঢোকার সময় সবার পাসপোর্ট বা আইডি কার্ড দেখাতে হয়। আমি আমার আইডি কার্ড দেখালাম, এর পর ওরা নিজেরা নিজেরা কি যেন কথা বললো, এবার আমার পাসপোর্ট চাইলো, আবার নিজেরা নিজেরা কিছুক্ষণ কথা। মিনিট দশেক পর ওরা বললো-"আমরা খুব দুঃখিত তোমাকে দাঁড় করিয়ে রাখলাম। তুমি তো জানো পুরো দেশে এই দিনে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। এ জন্যই একটু দেরি হয়ে গেলো। "
মূল ভেনুতে ঢোকার পর ভাবলাম, আমার আশপাশের আর কাউকে তো চেক করলো না, কাউকে তো ১০ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে হলো না, তাহলে আমার বেলায় এমন হলো কেন? নামের কারনণ? নাকি আমার অবয়ব দেখে? “জঙ্গিবাদ ও ইসলাম” নিয়ে কিছু বলার জন্য আমি যে ওয়ার্কশপে গেছি, সেখানকার বড় বড় চিন্তাবিদরা কি জানেন মূল সমস্যা আসলে কোথায়? আপনি যদি কাউকে ভিন্ন ভাবে ট্রিট করেন, অন্য চোখে দেখেন শুধু তার নাম কিংবা গায়ের কালার দেখে, তাহলে এক সময় সেই ক্ষোভ থেকে জঙ্গিবাদ কেন এর চেয়ে বড় কিছুর জন্ম হতে পারে!
নিজের কিছু অভিজ্ঞতা সেয়ার করার কারণ হচ্ছে- আমার ধারণা, এ ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন অনেককেই হতে হয়। বিশেষ করে দ্বিতীয় প্রজন্মের মুসলিম অভিবাসীরা যারা ইংল্যান্ড-আমেরিকায় জন্মেছে, বড় হয়েছে কিন্তু স্রেফ নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় কিংবা গায়ের রঙের কারণে যদি তাদের বিরূপ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয় তাহলে তাদের হয়তো প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীদের চেয়ে আরও বাজে অনুভূতি হবে। কারণ ওই সমাজে জন্ম নিয়ে ও বড় হয়েও তাদের ভিন্নভাবে ট্রিট করা হচ্ছে। এতে “ইন্টেগ্রেশন” না হয়ে “সেপারেসন” কনসেপ্টই বেশি কাজ করার কথা। আর এ থেকে তাদের মধ্যে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতা বোধ কাজ করতে পারে। আর বিচ্ছিন্নতা বোধ কাজ করলে তার ফল কখনো ভালো হয় না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- তাহলে কি সতর্কতা মূলক ব্যবস্থা বা এয়ারপোর্টে ও নানা জায়গায় চেক করা যাবে না? অবশ্যই যাবে। সাধারণভাবে অন্য সবাইকে যেভাবে চেক করা হয় সেভাবে চেক করলেই কিন্তু আর সমস্যা থাকে না। দরকার হয় চেক করার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়া হোক। কিন্তু সে মাত্রা যেন সবার জন্য সমান হয়। নইলে ৯/১১ পর আমরা যে পরিবর্তিত পৃথিবী পেয়েছি সেটি হয়তো মেরুকরণের দিকেই কেবল যাবে। আমরা এখন বিশ্বায়নের যুগে বাস করি। এখানে মেরুকরণ হয়ে গেলে এক মেরুকে আপনি আলাদা করে রাখতে পারবেন না।
কিছুদিন আগে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি প্লেন দুর্ঘটনার উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। প্লেনটি নেদারল্যান্ডস থেকে মালয়েশিয়া যাচ্ছিলো। ইউক্রেনের আকাশসীমা দিয়ে যাবার সময় সেখান থেকে ছোড়া মিসাইলের আঘাতে প্লেনটি ভূপাতিত হয়। কারণ ইউক্রেনে এক রকম যুদ্ধ চলছে এই মুহূর্তে। যদিও নেদারল্যান্ডস কিংবা মালয়েশিয়া কোন দেশেই যুদ্ধ চলছে না। অথচ তাদের বিমান সংস্থা ও মানুষকে কিন্তু এর খেসারত দিতে হয়েছে।
পরিবর্তিত পৃথিবী নিয়ে যারা ভাবেন তাদের এখনই ভাবা দরকার, জঙ্গিবাদকে সঠিক উপায়ে কিভাবে দমন করা যায়। আর দমন করতে গিয়ে যদি সেটি জঙ্গিবাদকে আরও উস্কে দেয় তাহলে হিতে বিপরীতই হবার কথা।
আমিনুল ইসলাম: গবেষক, tutul_ruk@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১৮২২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৪