ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের দাবি, বাংলাদেশের মৌলবাদী গোষ্ঠী জামায়াতকে দেশের ভেতর অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য কয়েক মিলিয়ন ডলার দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। তৃণমূল এমপি আহমেদ হাসান ইমরানের মাধ্যমে অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান সারদার কেলেঙ্কারির টাকা বাংলাদেশে জামায়াতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ হয়েছে।
ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ তদন্তের নির্দেশ দেওয়ায় অভিযোগটি যে গুরুতর, তা প্রমাণ করে। বিষয়টি বন্ধু-প্রতিম ভারত এবং বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুবই সংবেদনশীল। তেমন গুরুতর না হলে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মাথাব্যথা হওয়ার কথা নয়।
আহমেদ হাসান ইমরান ২০০১ সালে ভারতে নিষিদ্ধ মৌলবাদী সংগঠন ‘স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্ট অফ ইন্ডিয়া’ (সিমি)-র পশ্চিমবঙ্গ শাখার সভাপতি ছিলেন। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক মনে করে, সিমি বহুগুণে শক্তিশালী হয়ে ভারত-বিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। সিমির প্রাক্তন অনেক নেতা এখন তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনীতিতে যুক্ত।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নিজস্ব গোয়েন্দা বিভাগও ইমরানের বিরুদ্ধে সরকারের কাছে একই ধরনের রিপোর্ট করেছিল। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার নলিয়াখালিতে জঙ্গি-গোষ্ঠীর সংঘর্ষের ঘটনায় ইমরানের সক্রিয় সম্পৃক্ততাও পাওয়া যায়। রিপোর্টটি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে দেওয়ার পরেও কেন মনোনয়ন দিয়ে ইমরানকে রাজ্যসভায় নিয়ে আসা হল, সেই প্রশ্নের উত্তর একমাত্র মমতাই দিতে পারবেন।
ইমরানের সাথে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত গোলাম আজমের ছেলে মামুন আল আজমের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। ইমরান ভারতের জামায়াতে ইসলাম-ই হিন্দ-এর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন বেশ কয়েক বছর। আল আজম আইডিবি ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর থাকা অবস্থায় ভারতের পূর্বাঞ্চলে ব্যাংকটির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন ইমরান। সেই থেকে ইমরান আর আল আজমের সম্পর্ক।
যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসি হওয়ায় কলকাতার ধর্মতলায় কিছু ইসলামিক সংগঠন প্রতিবাদ মিছিল করেছিল। পরে জানা যায়, বাংলাদেশের জামায়াত ও সিমির মদদেই মিছিলগুলি হয়। আহমেদ হাসান ইমরান এই মিছিলে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা কেন্ত্রীয় সরকারকে তা নিশ্চিত করে।
তৃণমূলের আরেক এমপি অভিনেত্রী মুনমুন সেন ও পাকিস্তানের তেহরিক-ই ইনসাফ নেতা ইমরান খানের মধ্যে এখনো নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে বলে ভারতীয় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দার সংস্থার দাবি। পাকিস্তানের আইএসআই’র সাথে মুনমুন সেন সরাসরি জড়িত, সেই সন্দেহও রয়েছে কিছু কিছু মহলের। গোয়েন্দারা বলছেন, ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের প্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে।
ধর্মীয় উগ্রবাদী-অধ্যুষিত প্রদেশ খাইবার পাখতুনখাওয়াতে ইমরানের তেহরিক-ই ইনসাফের ক্ষমতায় শরিক পাকিস্তানি জামায়াত। প্রদেশটি উগ্র জঙ্গি গোষ্ঠীর স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। অতি সম্প্রীতি নওয়াজ শরীফ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আইএসআই’র প্রেসক্রিপশনে আজাদি মার্চ করে ইমরানের পিটিআই। আন্দোলনটি যে আইএসআইয়ের নির্দেশনায় হয়েছে, তা ইমরানের উদ্যোগে অন্যায়ভাবে বহিষ্কৃত তেহরিক-ই ইনসাফের চেয়ারম্যান জাভেদ হাশ্মিরই গণমাধ্যমকে বলেছেন।
যে প্রশ্নটি সবার সামনে চলে আসে, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেইসব জানতেন কি না?’। তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের উগ্র-গোষ্ঠীর মধ্যকার নিবিড় যোগাযোগ মুখ্যমন্ত্রী মমতার গোচরেই হয়েছে বলে মনে হয়। যদিও তাঁর দল অস্বীকার করছে। বলছে, এটি বিজেপির রাজনীতি।
কিন্তু তাদের দাবি তেমন গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। সারদার মাধ্যমে জামায়াতের কাছ থেকে টাকা নেওয়া দেওয়া ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি বিশ্বাসযোগ্য ঘটনা তাই প্রমাণ করে।
প্রথমতঃ পাকিস্তানি হাইকমিশনারের কলকাতা সফর ও মমতার সাথে সাক্ষাতের পেছনে মুনমুন সেন ও ইমরান খানের আগ্রহ এবং ঘনিষ্ঠতা ক্যাটালিস্ট হিসাবে কাজ করেছে। চির বৈরি পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের সাথে একজন মুখ্যমন্ত্রীর দেখা হতেই পারে। কিন্তু সেই সাক্ষাৎটি যখন আইএসআইপন্থি পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুর আগ্রহে অনুষ্ঠিত হয়, তখন এর পেছনের উদ্দেশ্য বেশ পরিষ্কার হয়ে যায়।
দ্বিতীয়ত, সাক্ষাতের পরপরই কলকাতার একটি সাংবাদিক দলকে পাকিস্তান সফরের ব্যবস্থা করা হয়। ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে তেমন প্যারা-ডিপ্লোমেসি স্থান পায় না। কেন্দ্রকে আড়ালে রেখে পাকিস্তানের সাথে স্বপ্রণোদিত হয়ে প্যারা-ডিপ্লোমেসি চালিয়ে যাওয়ার সাথে অন্যান্য পাকিস্তানপ্রেমি কর্মকাণ্ডগুলি মিলে যায়। খোদ পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ জনগণই বিশ্বাস করে যে, মমতা সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপে এই অঞ্চলের উগ্রপন্থিদের আশা আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিন হচ্ছে।
তৃতীয়ত: কলকাতায় পাকিস্তানি ডেপুটি হাইকমিশনারের কাছে রাজ্যের মুসলিমদের জন্য পাকিস্তানে যাওয়ার ভিসা প্রসেস সহজ করার অনুরোধের অভিযোগও রয়েছে মমতার বিরুদ্ধে। ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও মুসলিম বাস করেন। সেই প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীরা পাকিস্তানি ভিসা সহজ করার অনুরোধ করেন নি। আজ যদি মমতা সারা ভারতের মুসলিমদের জন্য ভিসা পদ্ধতি সহজ করার কথা বলতেন, কারো তেমন কিছু বলার থাকত না।
চতুর্থতঃ উর্দুভাষী মানুষের আনাগোনা কলকাতায় উল্লেখ্যযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে, যা সন্দেহকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সাধারণ মানুষের ধারণা, মমতার উগ্র রাজনীতি প্রীতির জন্যই রাজ্যের ভেতর অন্য দেশের মানুষের আনাগোনা বেড়ে গেছে।
পশ্চিমবঙ্গ আমাদের প্রতিবেশী হওয়ায় মমতার এ ধরনের কর্মকাণ্ডে আমরাও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ এবং ভারতের সীমান্তে গরু চোরাচালান ও মাদক ব্যবসায় সারদা কেলেঙ্কারির টাকার একটি বিরাট অংশ বিনিয়োগ হয়েছে। বিনিয়োগের লভ্যাংশ দেশের ভেতর অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য ব্যয় হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। উদ্দেশ্য, শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করা।
গোয়েন্দা তথ্যে আরও জানা যায়, তৃণমূল কংগ্রেসও নির্বাচনে জামায়াতের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়েছিল। গোয়েন্দারা এ ব্যাপারে নিশ্চিত বলা যায়। সারদা কেলেঙ্কারির অন্যতম মূল অভিযুক্ত কুণাল ঘোষ অর্থের আদান প্রদান বিষয়ে মুখ খুলতে চাইলেও মমতা সরকারের নির্দেশে গঠিত কল্যাণ কমিশন তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। কল্যাণ নিজে থেকেই কমিশনের সাথে এ বিষয়ে কথা বলার অনুরোধ জানিয়ে আসছেন।
বিধানসভা এবং লোকসভার নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় বাংলাদেশের জামায়াতের নেতা-কর্মীরা তৃণমূল পক্ষে কাজ করেছিল। বিশেষ করে মালদা, দক্ষিণ ও উত্তর দিনাজপুর (৬০-৮০%), মুর্শিদাবাদ জেলাতে (৯০%)সহ বাংলাদেশের সাথে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী এলাকায় জামায়াতের কর্মীরা তৃনমূলের পক্ষে গণসংযোগ করেন।
ভারতের জাতীয়, আঞ্চলিকও স্থানীয় নির্বাচনে সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংকটির ইলেকটোরাল বিহেভিয়ার পর্যালোচনা করলে মমতার বিতর্কিত রাজনৈতিক পদ্দক্ষেপগুলোর কারণ বোঝা যায়।
ঐতিহাসিকভাবে ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (বাংলাদেশের মত সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস হয় না) প্রবল। বিশেষ করে সিপিএম ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা প্রায়ই হত এবং সংখ্যালঘু মুসলমানরা নিরাপত্তাহীনতায় দিনানিপাত করত। সিপিএম ক্ষমতায় আসার পর তেমন দাঙ্গা হয়নি এবং ফলে সংখ্যালঘু ২৭ শতাংশ ভোট সিপিএমের কোষাগারে যায়। সিপিএম মুসলমানদের মধ্যে ভূমি বিতরণ করেও মুসলমান সম্প্রদায়ের আস্থা অর্জন করেছিল। একই সাদৃশ্য দেখা যায় বিহারে। ১৯৯০ সালে লালু প্রসাদ যাদব ক্ষমতায় আসার পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। দীর্ঘ ১৫ বছর সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংকটি ব্যবহার করে লালু ক্ষমতায় থাকেন। একই পদ্ধতিতে উত্তর প্রদেশে মুলায়েম সিং যাদব ক্ষমতায় আসেন।
এখন নিরাপত্তা সংখ্যালঘু মুসলমানের অগ্রাধিকার তালিকায় নেই। তাদের সচেতনতা বেড়েছে। তারা শিক্ষা, চাকরি ও দারিদ্র অগ্রাধিকার তালিকায় নিয়ে এসেছে।
সেসব ইস্যুকে গুরত্ব না দেওয়ার জন্য লালু প্রসাদ যাদবের ক্ষমতা চলে যায় নিতিশের হাতে। ঠিক একই কারণে মুলায়েম সিং ইউপিতে মায়াবতীর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন।
পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু মুসলমানরাও আগের মত নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত নন। সিপিএমের জমানায় সরকারি চাকরিসহ অন্যান্য আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে পিছিয়ে থাকার কারণেই বামফ্রন্টের মুখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেন ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা। যেখানে সারা ভারতে স্বাক্ষরতার হার ৬৫ শতাংশ, সেখানে পশ্চিমবঙ্গের ২৭ শতাংশ ভোটের মালিক সংখ্যালঘু মুসলমানদের হার ৫৭.৫। এমনকি বাম শাসিত কেরালায় সংখ্যালঘুদের স্বাক্ষরতার হার ৮৯.৪ শতাংশ। একটি গবেষণায় দেখা যায়, কেরালায় মুসলমানদের দারিদ্র ১৫ বছরে (১৯৮৭-২০০৪) ৫৬ থেকে ৩১ এ নেমে এলেও পশ্চিমবঙ্গে নেমেছে ৫৩ থেকে ৪৪ শতাংশে।
মুসলমানদের প্রতি অবহেলার কারণেই সিপিএম ২০১১ সালে ক্ষমতা হারায়। মমতা ২৯৪ তে ২২৫ আসন পেয়ে রাজ্যের ক্ষমতায় যান। রাজ্যসভার মত লোকসভার নির্বাচনেও সিপিএমের শোচনীয় পরাজয় হয়। পশ্চিমবঙ্গের ৪২ টি আসনের মধ্যে ২০টিতে জয় নির্ধারণই ভোটের মালিক সংখ্যালঘুরা। ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল ৩৪ আসন পায়, যেখানে ২০০৯ সালে ১৯ এবং ২০০৪ সালে একমাত্র নিজের আসনটিতে জিতে আসেন মমতা।
পাশাপাশি মমতার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও ব্যক্তিগত আচার আচরণ নির্মোহ-ভাবে বিশ্লেষণ করলে অসহনশীলতা, নীতিহীনতা, রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতা মমতার রাজনৈতিক বিকাশ ধারায় প্রবলভাবেই পাওয়া যায়।
জীবনের প্রারম্ভিক পর্যায়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি শুরু করলেও, কংগ্রেসের রাজনীতি দিয়েই মমতার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু। মমতা ১৯৮৪ সালে বর্ষীয়ান কমিউনিস্ট নেতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হয়ে জাতীয় পর্যায়ে সাড়া ফেলে দেন। এরপর সারা ভারতের যুব কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদকও নির্বাচিত হন।
১৯৯১ সালে লোকসভায় আবার নির্বাচিত হয়ে নরসিমা রাওয়ের মন্ত্রিসভায় মানব সম্পদ ও ক্রীড়ামন্ত্রী হিসাবে স্থান পান মমতা। কিন্তু পরে কলকাতায় ক্রীড়া উন্নয়নের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের উদাসীনতার অভিযোগ এনে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেন। ১৯৯৬ সালের দিকে নিজ দল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সিপিএমকে সহযোগিতার অভিযোগ আনেন এবং পরিচ্ছন্ন কংগ্রেসের দাবি জানিয়ে প্রকাশ্য জনসভায় শাল পেঁচিয়ে আত্মহত্যার হুমকি দেন।
১৯৯৬ সালে পেট্রোলের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে মমতা সমাজবাদী পার্টির নেতা অমর সিংহের জামার কলার ধরে টানা-হেঁচড়া করেন মমতা। রেলের প্রতি অবহেলার অভিযোগে ১৯৯৭ সালে সংসদে তৎকালীন রেল-মন্ত্রী রাম বিলাসের দিকে নিজের শাল ছুঁড়ে মারেন। ১৯৯৮ সালে লোকসভায় নারী সংরক্ষণ বিলের বিরোধিতা করতে গিয়ে সমাজবাদী পার্টির এমপি দারোগা প্রসাদ সরোজকে জামার কলার ধরে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে আসেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৯৭ সালে তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করে। তৃণমূল কংগ্রেস খুব অল্প সময়ে বামফ্রন্টের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে প্রকাশ পায়।
তৃণমূল ১৯৯৯ সালে বিজেপির নেতৃত্বের সরকারে সামিল হলে রেলের দায়িত্ব পান মমতা। কিন্তু রাজনৈতিক মতানৈক্যের কারণে সরকার থেকে বের হয়ে যায় তৃণমূল।
২০০১ সালের শেষের দিকে বিধানসভা নির্বাচনের আগে মমতা কংগ্রেসের সাথে নির্বাচনী জোট করেন। তারপরেও নির্বাচনে বামফ্রন্ট জয় লাভ করে। ২০০৬ সালের বিধানসভার নির্বাচনেও বড়োসড়ো বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে মমতার তৃণমূল।
মমতা ২০০৪ সালে আবার ফিরে যান বিজেপির কোয়ালিশন সরকারে। তখন কয়লা এবং খনির দায়িত্বে ছিলেন। এটিই হিন্দুত্ববাদী বিজেপির সাথে মমতার শেষ কোয়ালিশন। কারণ বর্তমান ভোটের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিজেপির সাথে জোট করা আর মমতার পক্ষে সম্ভব নয়।
২০০৬ সালে সিপিএম সরকারের শিল্পনীতির বিরোধিতা এবং ২০০৭ সালের নন্দী গ্রামের গণহত্যার প্রতিবাদের ফলে মমতার জনপ্রিয়তা অনেক বেড়ে যায়। কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের একটি বৃহৎ অংশ বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায়। বামফ্রন্টের জনপ্রিয়তা কমতে থাকে।
২০০৯ সালে লোকসভার নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ৪২ আসনের মধ্যে ১৯টি জয় করে তৃণমূল। নিজেদের উত্থানের ঘণ্টা বাজায়। কংগ্রেসের নেতৃত্বে সরকারে আবারও রেলের দায়িত্ব পান মমতা। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ৩৫ বছরে ক্ষমতায় থাকা সিপিএমকে হারিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসে। অভিযোগ রয়েছে, সারদা ১৩০ কোটি টাকা তৃণমূলের নির্বাচনে অর্থায়ন করেছিল, যার একটি বড় অংশ বাংলাদেশের জামায়াতকে দিয়েছিল।
সংখ্যালঘুদের ভোট ব্যাংকটিই মমতার ক্ষমতার প্রাণশক্তি। নির্বাচনের আগে জামা মসজিদ শাহির ইমাম বুখারি এবং টিপু সুলতান মসজিদের ইমাম বারখাতি তৃণমূলের পক্ষে ভোট দেওয়ার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে মুসলমানদের তৃণমূলকে ভোট দেওয়ার আহবান জানান।
মমতার মত পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ জানেন, কেন লালু প্রসাদ যাদবকে সরিয়ে নীতিশ, মুলায়েম সিংকে সরিয়ে মায়াবতী ক্ষমতায় ছিল। এমনকি খোদ পশ্চিমবঙ্গেও কংগ্রেসের কাছ থেকে সিপিএম, এবং সিপিএমের কাজ থেকে নিজের দল তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় এবং লোকসভায় দ্বিতীয় বিরোধী দল।
মমতা এমন কিছু করতে চাইবে না যেন ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা তার বিপক্ষে চলে যায়। ক্ষমতায় আসার পরেই ৩০০০০ হাজার ইমামকে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ভাতা প্রদান হাইকোর্ট দ্বারা অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হলেও মমতার প্রতি সংখ্যালঘুদের বিশ্বাস বেড়ে যায়। তিস্তা পানি চুক্তি না করার পেছনেও অন্যতম কারণ হল- তিস্তার তীরে বসবাসকারী মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশই ধর্মীয় সংখ্যালঘু। মমতা জানেন ভারতের সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংকটি কোনো দলের জন্য নির্দিষ্ট নয়। আগে প্রোগ্রেসিভ অল্টারনেটিভ তেমন ছিল না, এখন অনেক আছে।
মমতার নিজেও জানেন, ইমরানের মত সিমির অনেক প্রাক্তণ নেতার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কি? সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংকটি ব্যবহার করে ইমরান খানের মত সিমির নেতারা ভারতের ভেতরে ও বাইরে ভারতের স্বার্থ বিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত, তা খোদ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গোয়েন্দারই সন্দেহ করে।
সারদা কেলেঙ্কারিতে তার নিজ দলের জঙ্গি-বান্ধব রাজনীতিবিদ ইমরান থেকে শুরু করে মুনমুন সেনের মত অনেক সেলিব্রেটি জড়িত। যদি ইমরানের মাধ্যমে বাংলাদেশের জামায়াত টাকা নিয়ে ২০১১ সালের বিধান সভা ও ২০১৪ সালে লোকসভার নির্বাচন করা যায়, প্রশ্ন থেকে যায় কোন নৈতিক ক্ষমতার জোরে সারদার টাকা জামায়াতকে দিতে না করবেন মমতা?
অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, দেশের ভেতর জঙ্গি উত্থান ঘটল কিনা, তাও মমতার কাছে মুখ্য নয়। মুখ্য সংখ্যালঘু ভোটের কিছু সুবিধাবাদী প্রতিনিধিকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় থাকা। এক্ষেত্রে শেখ হাসিনা আর বাংলাদেশ, অনেক দূরের বিষয়।
মমতা এমন এক রাজনীতিবিদ, যার কাছে নিজ দলের স্বার্থই প্রাধান্য পায়। নিজের স্বার্থের জন্য প্রথমে বিজেপি, পরে কংগ্রেস, আবার বিজেপি, আবার কংগ্রেস জোটে গিয়েছিল। চলতি বছরের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের আগে বিজেপি থেকে কোয়ালিশনের জন্য ইঙ্গিত দিলেও মমতার সাড়া পাওয়া যায়নি। কারণ বিজেপির বিপক্ষে গিয়ে সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংকটি হারাতে হবে এই ভয়ে।
ড: বিজন সরকার: গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, চন্নাম ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সাউথ কোরিয়া, bipoly3001@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৪