মঙ্গলবার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে বলে জানান। এর ফলে অঞ্চলটিতে ইবোলা আক্রান্ত জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যগত ও চিকিৎসা বিষয়ক সরঞ্জমাদি দিয়ে সহযোগিতা করতে এক বিলিয়ন ডলার অর্থ সহায়তা ও তিন হাজার সেনা পাঠানোর ঘোষণা দেন ওবামা।
আসলে আমরা এ মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকেই অনেক সময় নষ্ট করে ফেলেছি। মার্চের দিকে রিপাবলিক অব গিনির প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ মহামারির শুরু হয়। কয়েক দিনের মধ্যেই এটি লাইবেরিয়ায়ও ছড়িয়ে পড়ে। এপ্রিলে এসে এ মহামারি রীতিমত ভয়ানক আকার ধারণ করে। মে মাসে এটি গিনি-লাইবেরিয়ার সীমান্ত ছাড়িয়ে একেবারে সিয়েরা লিওনে ছড়িয়ে পড়ে। জুন মাসে ভাইরাসটি লাইবেরিয়ার রাজধানী মনরোভিয়ার পুরা নগর এলাকায় ছড়াতে থাকে।
ডক্টরস উইদাউট বর্ডার্স (ডিডাব্লিউবি)জানায়, ‘ভাইরাসটি পুরা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ’ জুলাইয়ের শেষের দিকে এটি নাইজেরিয়ায় ঢুকে পড়ে। কিন্তু এই মহামারির চাইতেও বেশি মারাত্মক হল ইবোলা আতঙ্ক। কারণ ভাইরাসটির চেয়ে অনেক বেশি দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ে এর ভীতিকর আতঙ্ক।
গত সপ্তাহের শুরুতে ইবোলা সংক্রমণ সম্পর্কে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম জানান, এটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে ‘এর দুই রকম সংক্রমণ দায়ী। ’ ‘একটি খোদ ভাইরাসটির সঙ্গে যুক্ত। অপরটি এই ভাইরাস সম্পর্কিত আতঙ্ক ছড়ানোর সাথে যুক্ত। ’
তবে গত সপ্তাহের মঙ্গলবার প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভাইরাসটির সংক্রমণ জনিত অসুস্থতা ও চিকিৎসা বাবদ ব্যয়ের প্রভাব অর্থনীতিতে তুলনামূলকভাবে কমই বটে। কিন্তু এ ভাইরাস সম্পর্কিত যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে তার অর্থনৈতিক প্রভাব খুবই মারাত্মক। এ ভাইরাসের শুধু ‘আতঙ্ক জনিত কারণে’ অর্থনীতিতে প্রভাব পড়েছে আট থেকে নয় শতাংশ; এতে রীতিমত পরিবহন ব্যবস্থা পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এমনকি সমুন্দ্র বন্দর ও বিমানবন্দরের মতো পরিবহন ব্যবস্থাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। একই সঙ্গে পরিবহন খাতে কর্মরত শ্রমিক কর্মকর্তা কর্মচারীদেরও কর্মস্থল ছেড়ে চলে যাওয়ার দশা তৈরি হতে পারে।
ইবোলার মোকাবেলায় আমরা সবাই ডলার দিয়ে আফ্রিকার আক্রান্ত এই দেশগুলিকে সহায়তা করতে পারি। প্রতিশ্রুতির সঙ্গে শেষ পর্যন্ত কোনো নৈতিক অজুহাতই আসলে খাটে না। প্রতিশ্রুতিই যথেষ্ট। তবে পশ্চিম আফ্রিকার এসব দেশকে শুধু রক্ষা করলেই চলছে না, আমাদেরকে এর মুখোমুখি হতে হবে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে এসব দেশের চেয়ে মূলত আমাদের স্বার্থটাই বেশি। কাউকে বাদ দিয়ে শুধু নিজেই এক দিনের মধ্যেই এর মোকাবেলা সম্ভব না। এমনকি আমার নিজের পরিবারের ক্ষেত্রেও এটি সত্য।
তবে আমাকে প্রশ্ন করেন, যদি ইবোলা আমাদের সবাইকে শেষ করে দেয়? আমার জবাব হল, না। কারণ এটি বার্ড ফ্লু’র মত এতটা দ্রুত ছড়িয়ে পারতে পারে না। ফলে এখন পর্যন্ত যতটুকু ওই সীমায় ছড়াতে পেরেছে ভাইরাসটি তাতে অন্তত আকাশ পথ পাড়ি দিয়ে এর পক্ষে আর কোথাও ছড়ানো সম্ভব নয়।
অনেকেই সাবধান করে দিয়েছেন যে, ভাইরাসটি খুব দ্রুত রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। আসলে ভাইরাস এমনই হয়। স্বাভাবিকভাবেই তাদের এই সাবধানতার জন্য তাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। এরকম হলে অনেক সময় দেখা যায়, ভাইরাস পরিবর্তন হওয়ার চাইতে বরং দুর্বল হয়ে যায়। ডারউইনিয়ান ধারণার দিক থেকে ভাইরাসের ব্যাখ্যা হল, কোনো ভাইরাসই নিজে নিজে টিকে থাকতে পারে না। কোনো না কোনো আশ্রয় দখল করা তার জরুরি। টিকে থাকতে ভাইরাস এভাবেই সৃষ্টিগতভাবে তৈরি হয়ে থাকে। ফলে যেকোনো ভাইরাসই কোষ ধ্বংস করে ফেলে।
পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার কারণ হল, ওইসব অঞ্চলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নাই বললেই চলে। যোগাযোগ ব্যবস্থাও খুবই নাজুক। পানযোগ্য পরিষ্কার পানিসহ জীবন ধারণের খুবই প্রাথমিক জিনিসপত্রেরও মারাত্মক সংকট রয়েছে সেসব অঞ্চলে।
এই সমস্যা সেখানে নতুন না। কম করে হলেও এক বছর আগের এ সমস্যা। এমনকি হাজার বছর আগে থেকেই এ সমস্যা সেসব অঞ্চলে চলে আসছে। বিশ্ব ব্যাংকের মতে, গত বছর লাইবেরিয়ায় চিকিৎসা খাতে মাথাপিছু মাত্র ৬৫ ডলার ব্যয় হয়েছে। এর আগের বছরে হয়েছে ৫৯ ডলার। আর গিনির অবস্থা আরও খারাপ। সেখানে হয়েছে মাথা পিছু ৩২ ডলার। তুলনামূলকভাবে নাইজেরিয়া ইতিমধ্যে বেশ উন্নত হয়ে উঠলেও সেখানে গত বছরে মাথাপিছু স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় হয়েছে ১০০ ডলার। (অপরদিকে স্বাস্থ্যখাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গত বছর মাথা পিছু ব্যয় হয়েছে ৯ হাজার ডলার। আর ইতালিকে গণস্বাস্থ্যখাতে মোটামুটি ভাল ধরে নেয়া হয়। স্বাস্থ্যখাতে তাদের মাথাপিছু ব্যয় হল ৩৫শ ডলার। )
ইবোলা কোনো রহস্যময় ব্যাধি নয়। এটি কখনোই দুরারোগ্য রোগ না। এখন এটি বন্ধ করতে প্রয়োজন বড় ধরনের উদ্যোগ। প্রথমেই যারা আক্রান্ত হয়েছে তাদেরকে শনাক্ত করা। দ্বিতীয় কাজ হল এই সংক্রামক ব্যাধির ছড়ানো বন্ধ করার উদ্যোগ নেয়া। যারা আক্রান্তদের সাথে ঘনিষ্টভাবে মিশেছে তাদের খুঁজে বের করা জরুরি। তারা যদি অসুস্থ বা দুর্বল থাকে তবে তাদেরকে দ্রুত আলাদা করে ফেলা জরুরি।
বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোই এধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়ে আসছে। ১৯৮৮ সালের ওই সময়টা ছিল বিশ্বের এসব দেশের খুবই মারাত্মক একটা সময়। সে সময় আমি নিউইয়র্ক সিটির স্বাস্থ্য কমিশনার স্টিফেন জোসেফের সাথে সুইডেনের স্টকহোমে এইডসের বিষয়ক ৫ম আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে যোগ দিয়েছিলাম। জোসেফের প্রধান বক্তব্য ছিল, এসব মহামারির ক্ষেত্রে খুবই জরুরি কথা হল, কোনোভাবেই সময় নষ্ট করা যাবে না। সময় নষ্ট করার সুযোগ নাই। খুবই দ্রুত গণস্বাস্থ কর্মীদের এতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
আমরা যারা পশ্চিম আফ্রিকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে অন্য সময় যেমন করে অর্থ ব্যয় করেছি, কাজ করেছি তাদেরকে অবশ্যই এই মারাত্মক মহামারির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। এবং আমাদেরকে বহু জীবন রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। এই এগিয়ে আসাটা এই মহামারিকে দুর্বল করে দেবে। এমনকি ইবোলা আতঙ্কও কমিয়ে দেবে। মূলত ভাইরাসের চেয়েও ভাইরাস আতঙ্ক অনেক বেশি মারাত্মক।
*লেখাটি ১৯ সেপ্টেম্বর মার্কিন প্রভাবশালী সাপ্তাহিক ‘দি নিউ ইয়র্কার’-এ প্রকাশিত
মিশেল স্পেকটার: দি নিউ ইয়র্কারের স্টাফ রাইটার
অনুবাদক: শাহাদাৎ তৈয়ব
বাংলাদেশ সময়: ১৮১৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৪