ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

তবে কি মেয়েদের আরও পিছিয়ে দেয়াই লক্ষ্য?

মীর তামান্না ছিদ্দিকা ও আফসানা ইসলাম, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৪
তবে কি মেয়েদের আরও পিছিয়ে দেয়াই লক্ষ্য?

সম্প্রতি বাল্যবিবাহ রোধে প্রস্তাবিত এক আইনে বাংলাদেশে ছেলে ও মেয়েদের বিয়ের সর্বনিম্ন বয়সসীমা কমিয়ে যথাক্রমে ১৮ ও ১৬ বছর করার সুপারিশ করা হয়েছে এবং মন্ত্রিসভা এ ব্যাপারে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে।

যদিও প্রস্তাবিত আইনে বাল্য বিয়ের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির মাত্রা আরও বাড়ানো হয়েছে, তথাপি বিষয়টি আমাদের হতবাক করে দিয়েছে! আজ থেকে ১০৫ বছর আগে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ লেখায় যেখানে শিক্ষাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মেয়েদের ন্যূনতম বিয়ের বয়স ২১ করার কথা বলেছেন সেখানে আমরা কি তবে সামগ্রিক উন্নয়নের উল্টো পথে হাঁটছি না?

বাল্যবিবাহ রোধে সরকারের ব্যর্থতা ঢাকার এই প্রচেষ্টায় বলির পাঁঠা কি তবে নারীকেই হতে হবে? নিঃসন্দেহে এই হঠকারী সিদ্ধান্ত মেয়েদের আরও পিছিয়ে দেবে।

রাষ্ট্রের একজন যথার্থ নাগরিক, সমাজের একজন প্রতিনিধি এবং ভবিষ্যতের নেতৃত্বের পথে তাদের বিকাশকে ব্যহত করবে।

প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মেয়েদের ঝরে পড়ার হার এমনিতেই অনেক বেশি। এই আইন এই হারে আরও বাড়িয়ে দেবে সুনিশ্চিতভাবেই। সরকার নারীশিক্ষার প্রসারে ডিগ্রি পর্যন্ত ব্যয় মওকুফ এবং বৃত্তি প্রদানসহ যে সব পদক্ষেপ নিয়েছে তার মূলেও পড়বে কু্ঠারাঘাত। এছাড়া পরিবার পরিকল্পনার মাধ্যমে  জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের যে সাফল্য সেটিও হুমকির সুম্মুখিন হবে। আর ১৬  ও ১৮ বছর যথাক্রমে মেয়ে ও ছেলের বিয়ের বয়স হলে বালিকা মাতার সংখ্যা বৃদ্ধির হার কোথায় গিয়ে ঠেকবে আর নির্ভরশীল জনসগোষ্ঠী কী পরিমাণ বাড়বে তা আমাদের অনুমান থাকা উচিত।

মেয়েটি তার বাড়ন্ত শরীর সম্পর্কে জানার আগেই আইনের মাধ্যমে তাদের আমরা অকাল গর্ভধারণ, মাতৃত্বের মত কঠিন দায়িত্বগুলোর দিকে ঠেলে দিচ্ছি। অন্যদিকে- মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কাছাকাছি গেলেও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে অনেক নারীই সন্তান জন্মদানের সময় মৃত্যুবরণ করছেন, যাদের বেশির ভাগেরই বয়স ১৫ থেকে ১৯ বছর। তার মানে বিয়ের বয়স ১৬ করার অর্থ হচ্ছে একটা মেয়েকে সরাসরি মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া। বাংলাদেশে প্রতি এক লাখ শিশুর জন্মের সময় ১৭০ জন মা মারা যায় যেখানে ইউরোপে এ সংখ্যা গড়ে ৬ থেকে ৮ জন।

অধিকন্তু, সাম্প্রতিককালে বিবিএস-এর এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতি ১০০ নারীর মধ্যে ৮৭ জনই স্বামীর হাতে নির্যাতিত হয়ে থাকেন। বাংলাদেশে যেখানে ১৭ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে বিয়ে হলেও ১৫ বছরের মেয়েদের তুলনায় দ্বিগুণ যৌতুক দিতে হয়। এ অবস্থায় বিয়ের এই নিম্ন বয়সসীমা যৌতুকসহ অন্যান্য পারিবারিক নির্যাতনগুলোকে আরও উস্কে দেবে। তাহলে কোন আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার দোহাই দিয়ে সরকার বিয়ের বয়স কমাতে চাইছে?

বিয়ের বয়সের এই নিম্নসীমা দেশি ও আন্তর্জাতিক আইনের সাথেও সাংঘর্ষিক হবে।

১৯২৯ সালের বাল্যবিয়ে সংক্রান্ত আইনে বর্তমানে নারীদের ক্ষেত্রে ১৮ বছরের কম এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে ২১ বছরের কম হলে নাবালক বলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক শিশু সনদ ও জাতীয় শিশুনীতি ২০১৩ অনুযায়ী, শিশুর সংজ্ঞার শুরুতেই বলা আছে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত ছেলে বা মেয়ে সবাই শিশু! সিডও ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদে যে নিজ পছন্দে বিয়ে এবং পরিবার গঠনের কথা বলা হয়েছে, প্রাপ্তবয়স্কদের পক্ষেই সেই অধিকার প্রয়োগ করা সম্ভব, শিশু বা কিশোরীদের না।

অন্যদিকে যে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নিবন্ধিত রাষ্ট্রের নাগরিক অর্থাৎ ভোটার হতে হলে ১৮ বছর হতে হয়, সেখানে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৬ এবং ছেলেদের ১৮ করা হলে তা হবে একটি বিতর্কিত এবং অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত। এই আইন বাস্তবায়ন হলে পারিবারিক এবং রাষ্ট্রীয় যেকোনো সিদ্ধান্তগ্রহণে নারীরাই বঞ্চিত হবে। তাছাড়া আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং প্রথানুযায়ী আমরা ১৬ বছরের একটি মেয়েকে কি ‘শিশুশ্রমের’ বেড়াজালে আবদ্ধ করছি না?

বিয়ের বয়স কমানোর ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে আরেকটি যুক্তি দেখান হচ্ছে যে, ইউরোপের অনেক দেশেও বিয়ের বৈধ বয়স ১৬। এখন প্রশ্ন হচ্ছে শিক্ষাসহ অন্যান্য আর্থ-সামাজিক অবস্থানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারীরা ইউরোপীয় নারীদের সমপর্যায়ভুক্ত কিনা? অনেক ক্ষেত্রে ইচ্ছার বিরুদ্ধে পড়াশুনা বন্ধ করে বিয়ে বা বিয়ের পর স্বামী বা তার পরিবার কর্তৃক পড়াশুনা বা চাকরির স্বপ্ন জলাঞ্জলি, সংসারে নারীর মতামতে গুরুত্ব না দেয়ার ঘটনা ইউরোপীয়দের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কিনা তাও ভেবে দেখতে হবে। পারিবারিক সম্পদে সমান অধিকার, বহুবিবাহ অবৈধ ঘোষণা এমন অনেক কিছুই তো ইউরোপীয় আইনে আছে, সেগুলো গ্রহণ না করে কেন বিয়ের বয়সের ক্ষেত্রে তাদের উদাহরণ হিসেবে নেয়া হবে? তবে কি ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া মেয়েদের আরও পিছিয়ে দেয়াই সরকারের লক্ষ্য?

লেখক: যথাক্রামে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক।

বাংলাদেশ সময়: ২১২৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।