ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

ভারত চীন কি সীমান্ত দ্বন্দ্বের সমাধান করতে পারবে?

শ্যানন তেইজি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৪
ভারত চীন কি সীমান্ত দ্বন্দ্বের সমাধান করতে পারবে?

চীন ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত ইস্যু নিয়ে বহুদিন ধরে বিতর্ক চলে আসছে। দুদেশের দিক থেকে সম্পর্ক অটুট রাখার প্রতিশ্রুতির পরও চীন-ভারত সম্পর্কে সীমান্ত নিয়ে সংঘাত বরাবরই চাপ তৈরি করছে।

 

অদ্যাবধি ভারতে চীনা প্রধানমন্ত্রী শি জিনপিং সফররত আছেন (সম্প্রতি ভারত সফরে আসেন জিনপিং)। মোদি আর শি’র বৈঠক এখন গুজরাট থেকে রাজধানীতে চলে এসেছে।

তবে ‘দি ডিপ্লোমেট’ জানিয়েছে, বিতর্কিত সীমান্তে চীন ও ভারতের বাহিনীর মধ্যে আগে থেকে যে দূরত্ব চলে আসছিল তার ফলে শি’র এই সফর অংশত ব্যর্থ হয়েছে। বরং এই ঘটনা নতুন করে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে যে, দুদেশের সীমান্ত বিতর্কের সমাধান ছাড়া কিভাবে ভারত-চীনের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক যুগপৎভাবে এগিয়ে যেতে পারে?     

সে কারণেই দেখা গেছে, এই সফরে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী শি’র প্রধান গুরুত্বের জায়গা হয়ে ওঠে বাণিজ্য ইস্যু। এরইমধ্যে ভারত ও চীনের অর্থনীতির মধ্যে সংগতিপূর্ণ জায়গাগুলোর উপর জোর দিয়েছে ‘দি হিন্দু’। পত্রিকাটি সারমর্ম করে এক কথায় চীনকে বলেছে ‘বিশ্বের কারখানা’ অার ভারতকে বলেছে ‘বিশ্বের সমর্থনের অফিস’। দুই দেশের সম্পর্কে নিজ নিজ অবস্থান থেকে যে সফলতা এসেছে তাতে পত্রিকাটি এই দুই জাতির চিত্র এক কথায় তুলে ধরেছে।
শি বলেছেন, চীন-ভারত সম্পর্ক খুবই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। একুশ শতকে এটি হয়ে উঠছে দুদেশের মধ্যে প্রতিশ্রুতিশীল সম্পর্ক। ’   

শি’র এ কথার পেছনের কথা মানে আসল কথা হল, আগামী পাঁচ বছরে ভারতে ২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে চীন। এ বিনিয়োগের জন্যই আসলে তিনি অঙ্গীকার করেছেন। এই বিনিয়োগের অধিকাংশই থাকবে ভারতের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরো উন্নত করার প্রকল্পকাজে। সাথে সাথে ভারতের পারমাণবিক শক্তি খাতেও সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছে দুদেশ।

চীনের পরিকল্পনা হল, ভারতে দুটি শিল্পপার্ক প্রতিষ্ঠা করা। একটি গুজরাটে। অপরটি মহারাষ্ট্রে। এ অবস্থায় ‘দি টাইমস অব ইন্ডিয়া’র মতো ভারতের সংবাদ মাধ্যমগুলো খুব তড়িঘড়ি করে জানিয়েছে, ভারতে বিনিয়োগ করতে চীন যে অর্থের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তা তুলনামূলকভাবে খুবই কম। কারণ ইতিমধ্যে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজু আবে পাঁচ বছরে ৩৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছেন।     

অবশ্য কে কি পরিমাণ বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে তা মোটেও মেটার করে না। কারণ চীন ও ভারতের মধ্যে চলমান সীমান্ত বিতর্কের মতো কঠিন সময়ে শি’র প্রতিশ্রুতি উঠে এসেছে। এটাই গুরুত্বপূর্ণ।

একজন ভারতীয় সেনা কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, গত সপ্তাহের শুরুতে মানে শি’র সফরের আগ মুহূর্তে চীন-ভারতের সীমান্তে দুদেশের কমপক্ষে ৫শ’ সদস্যের বাহিনী মোতায়েন ছিল। দুদেশের এই বাহিনী বিতর্কিত লাদাখ সীমান্তে প্রায় মুখোমুখি না হলেও যথেষ্ট সক্রিয় ছিল। লাদাখ হল, ভারত শাসিত কাশ্মির ও চীন শাসিত অক্ষয় চীনের মধ্যে অবস্থিত।   

চলমান এই পরিস্থিতিতেই, মোদি প্রকাশ্য এক মন্তব্যে চীনের সাথে সীমান্ত ইস্যু তুলেছেন। এটি মোটেও বিস্ময়কর নয়। মোদি বলেছেন, ‘সীমান্তে বারবার যে ঘটনা ঘটছে তাতে ভারতের ঘোরতর উদ্বেগ রয়েছে। ’ মোদি আহবান জানিয়ে বলেন, ‘প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার (লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (এলএসি)) সমাধান হয়ে গেলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিয়ে আমাদের উদ্যোগ ও চেষ্টাগুলো ভালো কাজ করবে। ’

ভারত ও চীন শাসিত সীমান্তগুলোর মধ্যে এলএসিই মূলত আসল সমস্যা। এলএসিই তা চিহ্নিত করছে। প্রকৃত সীমান্ত রেখার আসল জায়গা কোনটি তা নিয়ে যে সংশয় ও সন্দেহ নিয়ে দোষাদুষি চলে আসছে দুদেশের বাহিনীর মধ্যে সেটা ঠিক হয়ে যাবে এলএসি ইস্যুর সমাধান হলেই। দি হিন্দুকে ভারতের সেনাবাহিনী জানিয়েছে, ২০১৩ সালে চীনা বাহিনী অন্তত ১৫০ বার সীমান্তে আকস্মিক হামলা চালিয়েছে। মোটকথা চীনের সাথে এই সীমান্ত সমস্যা সমাধানে এলএসি নির্ধারণ নিয়ে স্তিমিত প্রক্রিয়া পুনরায় সক্রিয় করতে শি-কে আহবান জানিয়েছেন মোদি।     

ভারতীয়দের জন্য চীনের ভিসা নীতির বিষয়েও উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন মোদি। চীন বরাবরই অরুণাচলের ভারতীয়দের জন্য স্ট্যাম্প ভিসা না দিয়ে স্টাপলিং ভিসা দিয়ে আসছে। এ ভিসা ছাড়া সেখানকার ভারতীয় পর‌্যটকদের জন্য চীনে প্রবেশ নিষিদ্ধ।

অবশ্য মোদি আস্থা প্রকাশ করে বলেছেন, সীমান্ত এবং ভিসা নীতি নিয়ে ‘সন্তোষজনক সমাধান’ হয়ে গেলে দুদেশের পারষ্পরিক আস্থার সম্পর্ক নতুন দিগন্তে উন্নীত হবে’।   

দুদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে এই সীমান্ত জনিত সমস্যা বারবারই সমস্যা তৈরি করছে। ফলে এই মুহূর্তে চীনের যে সীমান্ত দাবি তার সাথে কিভাবে ভারসাম্যপূর্ণ সমাধান সম্ভব তা নিয়ে আলোচনা জরুরি। ভারতের সাথে চীনের উৎপাদনশীল অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রয়োজনেই এটি করতে হবে। চীন বেশ আগে থেকেই বলে আসছে, তাদের উত্থান শান্তিপূর্ণ। আসলে চীনের অব্যাহত উত্থানের স্বার্থেই দেশটির এই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ জরুরি। কিন্তু চীনের নেতারা একইসাথে এই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ দেখতে চান আবার তারা তাদের সীমান্তের শেষ ইঞ্চি পর‌্যন্ত রক্ষায় পুরাপুরি অটল থাকছেন। চীনের এই মিশ্রিত বা স্ববিরোধী অবস্থান থেকে সহজেই এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, চীন যে ‘শান্তিপূর্ণ উত্থান’র কথা বলছে এটি ডাহা মিথ্যা।

তারপরও মোদির সাথে বৈঠকে শি জিনপিং তার দেশেরে শান্তিপূর্ণ ইচ্ছার ব্যাপারে আবারো গুরুত্বারোপ করেন। ভারতের সাথে শান্তিপূর্ণ  অবস্থান ও উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে শি বলেন, ‘একটি যুদ্ধপ্রিয় রাষ্ট্র বড় হতে পারে কিন্তু এই বড়ামি শেষ পর‌্যন্ত ধ্বংস হয়ে যায়। ’ 

তবে সীমান্ত ইস্যুতে শি প্রস্তাব দিয়ে বলেন, চীন ও ভারত ‘উভয় পক্ষের গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়ায় সুষ্ঠু ও যৌক্তিক সমাধানের সন্ধানে বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা চালিয়ে যাবে’। তবে এ সময় শি একথাও বলেছেন যে, সীমান্তের বিতর্কিত ইস্যু দুদেশের বড়ধরনের সম্পর্কে কোনো ধরনের প্রভাব ফেলবে না। ’

ধারণা করা হয়, চীনের দুর্বলতার সময় অন্যান্য দেশের মধ্যে চীনের অনেক সীমান্ত ‘চুরি’ হয়ে গেছে। তবে চীনকে নিয়ে শি জিনপিংয়ের রয়েছে বিখ্যাত ‘চীনা স্বপ্ন’। শি’র এই স্বপ্নকে ‘চীনা জাতির মহা রূপান্তর’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। অার শি’র এই অভিযাত্রায়ই সীমান্তে চীনের পুন নিয়ন্ত্রণ ফিরে আসার ব্যাপারটি আলোচনায় যোগ হয়েছে। তাহলে বেইজিং কিভাবে তার ‘শান্তিপূর্ণ উত্থান’র সাথে ভারসাম্য তৈরি করবে? কারণ চীনের চূড়ান্ত লক্ষ্যই হল এই ‘চীনা স্বপ্ন’। আর এই চীনা স্বপ্নের উপর নির্ভর করবে, চীন-ভারত সহযোগিতার সম্পর্ক কতদূর এগিয়ে যেতে পারে?   

*লেখাটি ১৯ সেপ্টেম্বর জাপান ভিত্তিক ‘দি ডিপ্লোমেট’-এ প্রকাশিত হয়েছে



শ্যানন তেইজি: দি ডিপ্লোমেটের সহযোগী সম্পাদক




অনুবাদক: শাহাদাৎ তৈয়ব

বাংলাদেশ সময়: ১৮২৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।