ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

সাংবাদিকতায় নীতি-নৈতিকতা ও আত্মজিজ্ঞাসা

জাহিদ নেওয়াজ খান, কনট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৪
সাংবাদিকতায় নীতি-নৈতিকতা ও আত্মজিজ্ঞাসা ছবি : লেখক

একটা গল্প বলি। গল্প ঠিক না, একটা ঘটনা।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন চিকিৎসক দু’দিন আগে তার ফেসবুকে ছবিসহ ঘটনাটি লিখেছেন। সংক্ষেপে ঘটনাটি এরকম: তার কাছে মধ্যবয়স পার হওয়া এক নারী এসেছেন। সঙ্গে তার ৭/৮ বছর বয়সী নাতি। ছেলেটির জন্মের কয়েক বছর পর বাবা তাদের ছেড়ে চলে গেছেন। বেঁচে থাকার সংগ্রামে মা গ্রাম ছেড়ে ঢাকায়, চাকরি করছেন একটি গার্মেন্টসে। ছেলেটি নানীর সঙ্গে গ্রামে থাকে। কিন্তু বাবার জন্য সে অস্থির। সারাক্ষণই বাবা-বাবা বলে কান্না করে। কান্না থামানোর কোনো পথ না পেয়ে নানী তার নাতিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে এসেছেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানীসহ বাচ্চাটির ছবি দেওয়াটা নৈতিক হয়েছে কি না সেই প্রশ্ন থাকলেও পারিবারিক জটিলতার ঘটনাটি লিখে ওই চিকিৎসক যে পর্যবেক্ষণ রেখেছেন, তা অবশ্যই চিন্তার বিষয়। তিনি লিখেছেন, এখন যদি এ ঘটনাটি নিয়ে সংবাদ মাধ্যম অনুসন্ধান করে, তা হলে তারা যে বিষয়গুলো খুঁজে দেখবে সেগুলো এরকম:

১.ছেলেটির মা ঢাকায় কার সঙ্গে থাকছেন?
২. কার সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছেন?
৩. কার সঙ্গে কোথায় কী করছেন?

একজন পাঠক এবং দর্শক হিসেবে ডাক্তার সাহেব যে পর্যবেক্ষণ রেখেছেন, তা কি বাস্তবতার খুব বাইরে? আমাদের গণমাধ্যমের আধেয় বিশ্লেষণ করলে তার পর্যবেক্ষণকে ঠিকই মনে হয়।

নারী ও শিশু
সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরায় দুটি শিশুর দুঃখজনক মৃত্যুর ঘটনার পর তো সেই অমানবিক চিত্রই আমরা দেখেছি। সাত বছর আগে বাচ্চা দুটির মা-বাবার মধ্যে বিচ্ছেদ হলেও এখন মায়ের বন্ধু কে, সেই বন্ধুর সঙ্গে তার সম্পর্কের মাত্রা কী; সেসবই কিছু কিছু পত্রিকার মূল বিষয়। এখানে বাচ্চা দুটির মা একজন সাংবাদিক, তাদের বাবাও সাংবাদিক। তাতে কী! নারীর দিকে আঙুল উঠানোর সাম্যনীতিতে বিশ্বাসী গণমাধ্যম তো কোনো মেয়েকেই ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। মনে আছে নিশ্চয়ই, সহকর্মী-বন্ধু সাগর-রুনি নিহত হওয়ার পর এমনকি তারা যেসব জায়গায় কাজ করেছেন, যাদের অধীনে বা সঙ্গে কাজ করেছেন, তারাও রুনিকে টার্গেট করে একের পর এক গাল-গল্প ছেপে গেছেন; শিরোনাম হয়েছে: রুনিই কি কারণ?

সাগর-রুনি এবং এখন জয়শ্রী জামানের ঘটনায় সাংবদিকরা প্রতিবাদী হয়েছেন। সেটা হয় তো তাদের কম্যুনিটি ফিলিংস। কিন্তু নিজেদের ক্ষেত্রে তাদের এ প্রতিবাদেই বোঝা যায়, অন্যদের বেলায় কী করছে আমাদের গণমাধ্যম!

এমনকি দুর্বিনীত গণমাধ্যম শিশুদেরও ছেড়ে দিচ্ছে না। উত্তরার ঘটনাতেই বাচ্চা দুটিকে নিয়ে নীতি-নৈতিকতার সবচেয়ে বেশি চর্চা করা একটি পত্রিকা একজন দোকানদারের বরাতে যেসব খবর ছেপেছে তা ছিলো দুঃখজনক। আমরা কথিত অনুসন্ধানে অনেক নেতিবাচক বিষয়-আশয় আবিস্কার করতে পারলেও পরিবারটিকে যে মাঝেমধ্যে শুধু মুড়ি খেয়েও দিন কাটাতে হয়েছে, সেটা জানতে পারি নি।

নারী-শিশুতেই প্রমাণ নীতি-নৈতিকতার মান
সাংবাদিকতার সাধারণ নীতিমালা সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তবে নারী ও শিশু, বিশেষ করে নারী সংশ্লিষ্ট ঘটনায় বারবারই প্রমাণ হয়, নীতি-নৈতিকতার বিষয়টা খুব একটা পরোয়া আমরা করি না। পত্রিকার কাটতি বা টেলিভিশনের দর্শক কিংবা অনলাইনের হিট বাড়ানোর জন্য মুখরোচক কাহিনীর প্রকাশ ও প্রচার করে অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ যে নীতিমালা আমরা নিজেরাই ভাঙি তার একটা ছোট তালিকা করলে সেটা দাঁড়াবে এমন:

*    সূত্রহীন সংবাদ, গুজব এবং অসমর্থিত তথ্যের প্রকাশ ও প্রচার
*    অসত্য ও ভুল তথ্য প্রকাশ ও প্রচার
*    ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ
*    ব্যক্তিগত অধিকার ও সংবেদনশীলতার প্রতি অসম্মান
*    খবরের কুরুচিপূর্ণ প্রকাশ ও প্রচার
*    ব্যঙ্গ ও বিদ্রুপাত্মক পথে সত্য বা অসত্য তথ্যের প্রকাশ ও প্রচার
*    কুৎসামূলক তথ্য প্রকাশ ও প্রচার করে ব্যক্তি ও সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠি বিশেষের মর্যাদাহানি
*    নিরপরাধকে অপরাধী হিসেবে প্রদর্শন

আমাদের প্রতিদিনের চর্চার অভিজ্ঞতায় ইচ্ছা করলেই এ তালিকা অনেক বড় করা সম্ভব। শুধু নারীর ক্ষেত্রে নয়, সাধারণভাবে অনেক ক্ষেত্রেই এমন অ-খবরকে আমরা খবর করি। ‍অসত্য তথ্যে রং চড়িয়ে তাকে সংবাদ বানাই। সেটার এক কারণ আমাদের মানসিকতা, অন্য কারণ বা লক্ষ্য: কাটতি বাড়ানো।

রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব
নারীর জন্য বিষোদগারের পাশাপাশি আমাদের গণমাধ্যমের একটি অংশের আরেক সমস্যা রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব। বিস্ময়করভাবে গণমাধ্যমের পাশাপাশি গণমাধ্যম কর্মীদের একটি বড় অংশও রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের দোষে দুষ্ট। তারা কেউ আওয়ামী লীগ, কেউ বিএনপি, আবার কেউ বা জামায়াত বা কমিউনিস্ট পার্টি। তাদের মধ্যে নিজের দলের অ-খবরকে খবর হিসেবে দেখানোর চেষ্টা যেমন প্রবল, তেমনই আসল খবরকে লুকিয়ে রাখার প্রবণতাও কম নয়।

আবার দু’ অংশে বিভক্ত ইউনিয়নের দু’ প্রাণপুরুষের একজন শেখ হাসিনার উপদেষ্টা, অন্যজন খালেদা জিয়ার। তাদের কার্যক্রম শুধু ইউনিয়ন বা নেত্রীকে ভালো উপদেশ দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ক্ষমতায় থাকলে বিরোধীপক্ষ সমর্থিত গণমাধ্যম এবং সামগ্রিকভাবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় কিভাবে হস্তক্ষেপ করা যায় সেই উপদেশ দিতেও তারা যথেষ্ট পারঙ্গম। এজন্য অবশ্য হাততালি দেওয়ার সাংবাদিকের সংখ্যাও অনেক।

রাজনৈতিক দলের ঘোষিত-অঘোষিত সাংবাদিক উপদেষ্টাদের কাছে নীতিমালার বিষয়টা একেক সময় একেক রকম। এখন যে হরতালে সাংবাদিক ডেকে নিয়ে গাড়িতে আগুন দেওয়ার চর্চা চালু হয়ছে, এর কাভারেজ বিরোধীদলের সমর্থকদের কাছে নীতিমালার লংঘন মনে হয় না। আবার এখন যারা সরকারপক্ষে আছেন, তাদের কাছেও একইরকম মনে হবে যদি তাদের অবস্থানটা শুধু পাল্টে যায়।

কিন্তু প্রকৃত সাংবাদিকতায় সবসময়ই এটা নীতিমালার লংঘন কি লংঘন নয়, সেই আত্মঅনুসন্ধান আজ জরুরি। কোথাও সমাবেশে পুলিশের হামলা হলে, কিংবা নাশকতা হলে তার সত্য চিত্র তুলে ধরা সাংবাদিকের কাজ। কিন্তু শুধু টেলিভিশনের পর্দায় প্রচারের জন্য সাংবাদিকদের গোপনে আমন্ত্রণ জানিয়ে বাসে আগুন, কিংবা কয়েকটা ককটেলের বিষ্ফোরণ; এরকম প্রি-অ্যারেঞ্জড নাশকতার প্রচার আসলেই সাংবাদিকতা কি না সেটা ভাবার সময় এসেছে। রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বে সেই ভাবনা অবশ্য আজ একরকম এবং ক্ষমতার দৃশ্যপট পাল্টে গেলে ভিন্নরকম হলে তা অবশ্য কোনো আদর্শ অবস্থান হবে না।

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আধাঘোষিত যুদ্ধ
তবে আমাদের গণমাধ্যমের রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের সমালোচনা করতে গিয়ে একটি বিষয় আমরা অনেক সময় গুলিয়ে ফেলি। সেটা হচ্ছে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার। এ বিচারে সংখ্যাগরিষ্ঠ গণমাধ্যমের যে বিচারের পক্ষে অবস্থান তা নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন। কিন্তু তারা ভুলে যাচ্ছেন, এটা মিডিয়ার আওয়ামী লীগ অথবা বিএনপির প্রতি পক্ষপাতিত্ব না। এটা আসলে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশবিরোধী শক্তির মধ্যে চেতনার লড়াই। কোনো কোনো মতলববাজ এটাকে সাংবাদিকতার সাধারণ তুল্য-মূল্যে ফেলতে চান।

এখানে চেতনা হচ্ছে সেইসব মৌলিক বিষয় যার ওপর জনমানস গড়ে উঠে। একটি দেশের জন্য যা একটি দর্শন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাও এরকম কিছু মৌলিক বিষয়ের ওপর গড়ে উঠেছে। তাই গণমাধ্যম যখন সেই দেশ এবং তার সমাজের আয়না, ওই আয়নায় তার মৌল দর্শন বা চেতনাও প্রতিফলিত হবে। সেই দর্শন যখন আঘাতপ্রাপ্ত হবে, প্রতিফলিত হবে সেটাও। এখনকার বিতর্ক সেই আঘাতকে কেন্দ্র করে। এই আঘাতটা যারা করছে, তারা বাংলাদেশের মৌল চেতনার ওপরই আঘাত করছে। এবং এটা তাদের আধা ঘোষিত যুদ্ধ। সুতরাং যে মিডিয়া বাংলাদেশের, সেই গণমাধ্যম ওই আধা ঘোষিত যুদ্ধটাকে বাংলাদেশের চোখ দিয়ে দেখবে, এটাই স্বাভাবিক।

সাংবাদিকতার মৌল নীতিমালা
দেশের মৌল নীতিমালা থেকে আলোচনাটা আবারো সাংবাদিকতার মৌল নীতিমালায় নিয়ে আসা যাক। একসময় রাজতন্ত্র নীতিমালা ঠিক করে দিতো। অবশ্যই সেটা হতো তাদের স্বার্থে, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে। পশ্চিমা বিশ্বে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত হওয়ার পর সেটা ধীরে ধীরে গণমাধ্যম কর্মীদের দায়িত্বের মধ্যেই চলে আসে।

আনুষ্ঠানিকভাবে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকে সাংবাদিকতার আচরণবিধি, নীতিমালা বা নৈতিকতার বিধিমালা ঠিক করা শুরু হয়। প্রথমে এগুলো আসে সাংবাদিকদের কিছু সংগঠন বা সংঘের কাছ থেকে। পরে নাগরিকদের অভিযোগ এবং ক্ষোভের সমাধান হিসেবে দেশে দেশে মালিক-প্রকাশক ও পেশাজীবীদের অংশগ্রহণে প্রেস কাউন্সিল প্রসার পায়। মিডিয়া হাউসগুলোও নিজেদের জন্য নীতিমালা ও আচরণবিধি তৈরি করে।

দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের বেশিরভাগ গণমাধ্যমেরই নিজস্ব নীতিমালা নেই। কিছুটা কাণ্ডজ্ঞান, কিছুটা সাংবাদিকতার সহজ পাঠ, কিছুটা বিভিন্ন দেশের সম্পাদক-সাংবাদিক সংগঠন ও আন্তর্জাতিক সংস্থার তৈরি আর কিছুটা সার্বজনীন যে নীতিমালা তাতেই চলে এখানকার গণমাধ্যম। এছাড়া আমাদের আছে প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অ্যাক্ট, আর অতি সম্প্রতি হওয়া সম্প্রচার নীতিমালা। সম্প্রচার নীতিমালার কয়েকটি নেতিবাচক দিক বাদ দিলে এর নির্যাস আসলে আছে প্রেস ‍অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অ্যাক্টের মধ্যে।

সম্প্রচার নীতিমালা আলাদাভাবে আলোচনার দাবি রাখে। ওই আলোচনা চলছে। তবে সাংবাদিকতার সার্বজনীন যে নীতিমালা তা বিশ্লেষণ করে আমরা সাংবাদিকতা এবং গণমাধ্যমের সাধারণ যে মৌল নীতিমালা পাই সেগুলো অনেকটা এরকম:
*    মানুষের সঠিক তথ্য জানার অধিকার
*    বস্তুনিষ্ঠ তথ্যের প্রতি সাংবাদিকের দায়বদ্ধতা
*    সাংবাদিকের সামাজিক দায়বদ্ধতা
*    সাংবাদিকের পেশাদারিত্ব এবং সততা
*    জনগণের অংশগ্রহণ এবং জবাব জানানোর অধিকার
*    ব্যক্তিগত অধিকার ও সম্মানের প্রতি সাংবাদিকের সম্মান
*    জনগণের আগ্রহের প্রতি গণমাধ্যমের সম্মান
*    সার্বজনীন মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের প্রতি উপযুক্ত সম্মান
*    মানবতাবিরোধী কার্যক্রম এবং যুদ্ধ বন্ধে উপযুক্ত অবস্থান
*    একটি নতুন তথ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেখানে সকলের তথ্য জানার অধিকার থাকবে, কিন্তু ব্যক্তি অধিকারের লংঘন হবে না।

প্রয়োগের ক্ষেত্রে এ নীতিমালা যেসব দিক তুলে ধরে তার কিছু উল্লেখ করলে যা দাঁড়ায়:

*    সঠিক ও যথাযথ তথ্য প্রকাশ
*    উপযুক্ত সূত্রে তথ্য প্রকাশ: তথ্যসূত্র সুনির্দিষ্টকরণ, তথ্য যাচাই ও সূত্রের নাম গোপন রাখার শর্তের তথ্যে আরো বেশি যাচাই-বাছাই, সূত্র কেনো গোপন

তার ব্যাখ্যা, সূত্রের সুরক্ষা, সর্বোচ্চ সতর্কতার পরও ভুল হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে সংশোধনী

*    ঘটনা বা খবরের পূর্ণাঙ্গ চিত্র
*    পক্ষপাতশূন্যতা ও ন্যায্যতা
*    ভারসাম্য
*    বস্তুনিষ্ঠতা ও সত্যনিষ্ঠতা
*    মানুষের প্রেক্ষাপট
*    সংক্ষিপ্ত ও সুস্পষ্ট উপস্থাপনা
*    সামাজিক মূল্যবোধ কিংবা সাম্প্রদায়িক শান্তি নষ্ট করতে পারে এমন তথ্য প্রকাশে সতর্কতা
*    ভয়ংকর ছবি প্রকাশ বা ফুটেজ প্রচার না করা
*    সার্বিক দায়িত্বশীলতা

আরো সংক্ষেপ করে বললে, একজন নবীন সাংবাদিককে সম্পাদক যে শিক্ষা দেন সেটাই সাংবাদিকতার মৌলনীতি যাকে এ বি সি বলা হয়, যেখানে:
*    এ: একিউরেসি (সঠিকত্ব, সত্যতা)
*    বি: ব্রেভিটি (সংক্ষিপ্ততা)
*    সি: ক্ল্যারিটি (সুস্পষ্টতা)
channel_i
পথ হারায়ে খুঁজি
সবাই হয় তো না, তবে নিজেদের যদি আমরা নিজেরা প্রশ্ন করি, তা হলে উত্তর পাবো; অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণ নীতিমালা আমরা লংঘন করি। কিছু বিষয়ে আমাদের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বা ডিলেমা থাকে। ওই দ্বিধা নিয়েই কখনো আমরা কিছু বিষয় প্রকাশ বা প্রচার করি না, আবার কিছু বিষয় প্রচার বা প্রকাশে প্রশ্ন উঠে।

আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ফটিকছড়ির ভুজপুরে ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর’ আর ‘আল-কোরআনের আলো, ঘরে ঘরে জ্বালো’ স্লোগানে কুপিয়ে কয়েকজনকে মেরে ফেলার ঘটনার ভিডিও টিভিতে দেখানো নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সমস্যা হলো, যারা প্রশ্ন তুলেছেন, তারাই কিন্তু বিশ্বজিতকে কুপিয়ে মেরে ফেলার ঘটনার ভিডিওর রেফারেন্সে মধ্যরাতের আলোচনায় মুখে ফেনা তুলেছেন।

আবার বিশ্বজিতের নিহত হওয়ার ঘটনার পর ওই ছবি দেখানো নিয়ে আরেকপক্ষের প্রশ্ন ছিলো। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট, দু’ ধরণের মিডিয়াই সোচ্চার ছিলো বলেই বিশ্বজিতের খুনিরা এখন গারদের ভেতরে। একইভাবে ভুজপুরের ঘটনায় ভিডিও দেখে মানুষ বুঝতে পেরেছে জঙ্গি সংগঠন আইএসের ভাই-বেরাদররা এ দেশেও আছে।

তারপরও এ রকম ছবি প্রচারে এথিক্যাল ডিলেমা থেকেই যাবে।

সেই ডিলেমা আরো বড় আলোচনার বিষয়। কিন্তু সাধারণ বিষয়গুলো নিয়েও আমাদের সমস্যা কম নয়। মনে আছে নিশ্চয়ই বেশ কয়েক বছর আগে ঢাকার আদালত এলাকায় একটি ধর্ষণের ঘটনায় ‘মরা’ নামে এক লোকের বিরুদ্ধে পত্রিকা দিনের পর দিন রিপোর্ট করে গেছে। পরে পুলিশের তদন্তে প্রমাণ হয়েছে, মরা নন; সেখানকার পুলিশ ক্যাম্পে দায়িত্ব পালন করা পুলিশ সদস্যরাই ধর্ষণ করেছিলেন।

অথবা, ধরুন কয়েক বছর আগে এক্সক্লুসিভ উত্তেজনায় আমাদের চ্যানেলে ওই আদালত এলাকায়ই পুলিশ দ্বারা এক কিশোরীর যৌন হয়রানির খবর প্রথম কয়েক দফা তার মুখ না ঢেকেই প্রচার হয়েছে। পরে মুখটি ঝাপসা করা হলেও্ ততোক্ষণে যা হওয়ার তা হয়েই গেছে। কিংবা ধরুন, পিলখানার ঘটনায় প্রথমদিন বুঝে না বুঝে কিভাবে বিদ্রোহ উস্কে দেওয়ার কারণ হয়েছে গণমাধ্যম।

আগে খবর দেওয়ার প্রতিযোগিতায় কেউ কেউ শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক আতাউস সামাদের মৃত্যু খবর প্রচার করেছে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগেই। অথচ আতাউস সামাদ ছিলেন সেই সাংবাদিক যিনি সারাজীবন তাঁর ছাত্রদের ক্রস-চেকের কথা শিখিয়ে গেছেন; নিজে যেমন চর্চা করতেন তেমনই অন্যদেরও বলতেন, যাচাই-বাছাইয়ের আগে কোনো তথ্য সংবাদ মাধ্যমে যাওয়া উচিত নয়। কেনো তার উদাহরণও তিনি দিয়ে গেছেন অনেক। তারপরও তাঁর মৃত্যু সংবাদই প্রচার হয়েছে তিনি মারা যাওয়ার আগে।

গণমাধ্যমের দায়িত্ববোধ সাংবাদিকদের নৈতিকতা
আমাদের সংবাদপদত্রের ইতিহাস অনেক পুরনো। কিন্তু নতুন হচ্ছে পত্রিকা-পত্রিকা ব্যক্তিগত পর্যায়ে লড়াই। এক পত্রিকার সঙ্গে অন্য পত্রিকার প্রতিযোগিতা স্বাভাবিক। কিন্তু সেটা যখন ব্যক্তিগত চরিত্র হনন কিংবা অন্য ব্যবসায়িক লড়াইয়ের মঞ্চ হয় তখন তা ভয়ংকর। এক পত্রিকার সম্পাদকের বিরদ্ধে অন্য পত্রিকার রিপোর্টে প্রেস কাউন্সিলের মামলার রায়ই প্রমাণ করে, নীতি-নৈতিকতার কোন পর্যায়ে আছে আমাদের সাংবাদিকতা।

আবার তুলনামূলক কিশোর বয়সে পৌঁছানো টেলিভিশন অনেকটাই গণমাধ্যমের চেয়ে বেশি ধারণ করছে প্রচার মাধ্যমের চরিত্র। সেটা কখনও রাজনৈতিক দল, কখনও রাজনৈতিক নেতা, কখনও কর্পোরেট পুঁজির প্রচার মাধ্যম। কর্পোরেট পুঁজির পক্ষে পত্রিকাও অবশ্য কম পিছিয়ে নেই।

আবার পত্রিকা বা টেলিভিশন__ গণমাধ্যমে গণ’র উপস্থিতি থাকার কথা থাকলেও কিছু ক্ষেত্রে ‘গণ’ অনুপস্থিত। সাধারণ রিপোর্টিং এর জন্য একটি পত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেলের যে বিনিয়োগ সেটা বাদ দিয়ে গত কয়েক বছরে বিশেষ ইভেন্ট এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য যে খরচ তার হিসাব নিজেরা করলেই বোঝা যাবে গণমানুষকে আসলে কতোটা তুলে আনছে গণমাধ্যম।

আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, অভিষেক বচ্চন-ঐশ্বরিয়া রাইয়ের বিয়ে আমাদের গণমাধ্যম কাভার করেছে। সেই তুলনায় বাল্যবিয়ে বন্ধে রিপোর্ট করার জন্য কতোটা বাজেট বরাদ্দ করেছি আমরা?

কিংবা, যে ফুটবলে আমরা বিশ্বে ১৭০তম, সেই ফুটবলের বিশ্বকাপ কাভার করতে আমরা কতো বিনিয়োগ করেছি, তুলনায় ফুটবলে আমাদের ক্রমশ: পিছিয়ে পড়ার কারণ অনুসন্ধানে তৃণমূলে গিয়ে অনুসন্ধানে আমাদের খরচ কতো? আদৌ কি আমরা কোনো খরচ করেছি? অথবা জেলায় জেলায় যে ক্রিকেট লীগ হয় না, তার কারণ অনুসন্ধানে রিপোর্টিং টিমের জন্য কি আমরা কোনো বাজেট রাখি? কিন্তু ক্রিকেট টিম সেই ওয়েস্ট ইন্ডিজই হোক অথবা সাউথ আফ্রিকা; যেখানেই ট্যুরে যাক আমরা কিন্তু অনেক খরচ করে সেটা কাভার করছি।

বলছি না যে ক্রিকেট বা ফুটবলের আন্তর্জাতিক আসর আমরা কাভার করবো না, কিন্তু নিজেদের ফুটবল বা ক্রিকেটে দৈন্যদশার কারণ অনুসন্ধানে আমাদের কেনো বাজেট থাকবে না সেটা এক বড় প্রশ্ন।

যেমন ধরুন, আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারত সফরে গেলেন। দু’ দেশের নতুন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর আমাদের পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে এ সফর অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। আমরা কি খরচ করে কাউকে সেটা কাভার করতে পাঠিয়েছি? কিন্তু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ অধিবেশন যেটা আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ না, তার কাভারেজে কিন্তু আমরা ঠিকই রিপোর্টার-ক্যামেরাম্যান পাঠাচ্ছি। জাতিসংঘ কাভার করবো, খুব ভালো; কিন্তু ওই খরচটা করতে পারলে মানুষের আসল স্বার্থ যে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফরে, তার জন্য কেনো আমরা রিপোর্টার পাঠিয়ে খরচ করতে পারবো না!

প্রশ্নগুলো এজন্য যে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক এরকম চরিত্রে আমাদের গণমাধ্যমের দর্শনটা টের পাওয়া যায়।

আর গণমাধ্যমের এভাবে প্রচার মাধ্যমের চরিত্র নেওয়ার কারণে গণমাধ্যম কর্মীদের নৈতিক স্খলনের আশংকাও তৈরি হয়। আমাদের গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকদের বড় অংশের রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের কারণে গণমাধ্যমের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন অনেক, এখন তার সঙ্গে গণমাধ্যম কর্মীদের নৈতিক মান নিয়ে প্রশ্ন উঠলে আমাদের আর যাওয়ার জায়গা থাকবে না। ভয়ের বিষয় হচ্ছে, সেই নৈতিকতা নিয়ে এরইমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে অনেক।

জাতীয় চরিত্র যখন গোলাপি আর গোপালি
আমাদের সমস্যা হচ্ছে, নীতিনির্ধারকরা নিত্যদিন গণমাধ্যমকে নীতি-নৈতিকতা মেনে সাংবাদিকতা করতে বলেন; কিন্তু তারা নিজেরা কোনো নৈতিকতার ধার ধারেন না। রাজনীতিকদের এক পক্ষ প্রতিদিন যেভাবে অন্যপক্ষকে গালি-গালাজ করেন; সেই ভাষা আর যাই হোক গণমাধ্যমে প্রচারযোগ্য নয়। মাঠের বক্তৃতা বাদ দিয়ে সংসদে উনারা যেভাবে কথা বলেন, সেটাও হজম করা কঠিন। তারপরও সেটা আমরা প্রচার ও প্রকাশ করে যাচ্ছি। এমনকি এক পক্ষ অন্যকে ‘গোলাপি’ আর অন্য পক্ষ ‘গোপালি’ বললে সেটাও আমাদের প্রচার করতে হচ্ছে। তা না হলে সেটা আবার রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের দোষে দুষ্ট হবে। হয় তো বৃহত্তর জায়গায় এভাবে নীতি-নৈতিকতায় আপোষের কারণেই তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সাংবাদিকতার সামগ্রিক নীতি-নৈতিকতায়।

তবে এর মানে এই না যে আমাদের নীতি-নির্ধারকরা তাদের নীতি-নৈতিকতার মাথা খেয়ে বসলেও সাংবাদিকতাও তাই করবে। গণমাধ্যম আলু-পটলের ব্যবসা নয়, সংবাদও কোনো কসমেটিক্স পণ্য নয়। যে কারণে নিজের দায়বদ্ধতা থেকে গণমাধ্যমকে দায়িত্বশীল হতে হবে। এ দায়িত্বশীলতা সব সময়ের। তবে এখনকার প্রেক্ষাপটে এ নীতি-নৈতিকতার বিষয়টি আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এমন এক সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি যখন সংসদে বিরোধীদলও সরকারের অংশ, রাজপথের বিরোধীদল বিএনপি যদি জামায়াতসহ হয় তা হলে সে জঙ্গিবাদি চরিত্রের আর জামায়াত ছাড়া বিএনপি নির্বিষ। গণজাগরণকে টুকরো টুকরো করে নতুন জাগরণের সম্ভাবনাও ঠেকিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রের ফোর্থ এস্টেট বা চতুর্থ স্থম্ভ হিসেবে গণমাধ্যমের ভূমিকা তাই অন্য যে কোনো সমরে চেয়ে এখন অনেক বেশি। কিন্তু সেই ভূমিকা পালনে নীতি-নৈতিকতার শক্তিও খুবই জরুরি।

জাহিদ নেওয়াজ খান: বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল আই।

বাংলাদেশ সময়: ১৫২৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।