১.
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে সব সময়েই আমার বুকের মাঝে এক ধরনের গভীর শ্রদ্ধাবোধ এবং ভালোবাসা কাজ করে। মাঝে মাঝেই পথে ঘাটে রেলস্টেশনে কিংবা কোনো অনুষ্ঠানে আমার হয়তো একজন মাঝবয়সী কিংবা বৃদ্ধ মানুষের সাথে দেখা হয়।
আমি তখন সব সময়েই দ্বিতীয়বার তার হাত স্পর্শ করি এবং সেই মাঝবয়সী কিংবা বৃদ্ধ মানুষটির মাঝে আমি টগবগে তেজস্বী একজন তরুণকে খুঁজে পাই। আমি জানি, সেই তরুণটি কিন্তু নিজের জীবনকে দেশের জন্যে উৎসর্গ করতেই যুদ্ধে গিয়েছিলেন।
এখন আমরা সবাই জানি, কাপুরুষ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মাত্র নয় মাসের ভেতর আত্মসমর্পণ করেছিল। একাত্তরে যারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে গিয়েছিলেন, তারা কিন্তু তখন সেটি জানতেন না। তারা সবাই কিন্তু বছরের পর বছর যুদ্ধ করার জন্যেই গিয়েছিলেন। তাই সবসময়েই আমি মুক্তিযোদ্ধা মানুষটির হাত স্পর্শ করে বলি, ‘থ্যাংক ইউ! আমাদেরকে একটি দেশ উপহার দেবার জন্যে’।
মাঝে মাঝে কোনো তরুণ কিংবা তরুণীর সাথে আমার দেখা হয়। যে লাজুক মুখে আমাকে বলেন, ‘আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা’। আমি তখন আবার তার মুখের দিকে তাকাই। তার লাজুক মুখের পেছনে তখন আমি তার মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে নিয়ে গর্ব করে গৌরবের আলোটুকু খুঁজে পাই। আমি তখন তার বাবার খোঁজ-খবর নেই। বেশিরভাগ সময়ই আবিষ্কার করি, তিনি আর বেঁচে নাই। যদি বেঁচে থাকেন তাহলে আমি সেই তরুণ কিংবা তরুণীকে বলি, তার কাছে আমার শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা পৌঁছে দিতে।
একাত্তর সালে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। দেশ স্বাধীন হবার পর যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হয়েছে তখন আমার পরিচিত বন্ধু-বান্ধবেরা, যারা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন তারাও ক্লাসে ফিরে আসতে শুরু করেছেন। কম বয়সী তরুণ, কিন্তু এর মাঝে তাদের ভেতর কী বিস্ময়কর দেশের জন্যে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা। আমি তাদের দেখি এবং হিংসায় জ্বলে পুড়ে যাই!
একাত্তরের নয় মাস মুক্তিযুদ্ধে যাবার জন্যে আমি কম চেষ্টা করিনি। পিরোজপুরের মাঠে দুই একদিন লেফট রাইট করা ছাড়া খুব লাভ হয়নি। আমার বাবাকে মেরে ফেলার পর পুরো পরিবারকে নিয়ে একেবারে বনের পশুর মত দীর্ঘদিন দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়াতে হয়েছে।
একটু থিতু হয়ে যখন বর্ডার পার হবার পরিকল্পনা করছি তখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মাত্র তেরো দিনের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে গেল। আমার মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। সেই নিয়ে আমার ভেতরে বহুদিন একটা দুঃখবোধ কাজ করতো এবং আমার বয়সী মুক্তিযোদ্ধা দেখলেই আমি হিংসায় জর্জরিত হতাম।
খুব ধীরে ধীরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমার সেই (হাস্যকর এবং ছেলেমানুষী) হিংসাটুকু গভীর শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায় পাল্টে গেছে। আমি বুঝতে শিখেছি, দেশের জন্যে যুদ্ধ করার সেই অবিশ্বাস্য গৌরব সবার জন্যে নয়। সৃষ্টিকর্তা অনেক যত্ন করে সৌভাগ্যবান কিছু মানুষকে তার জন্যে বেছে নিয়েছেন।
বাংলাদেশে ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী কিংবা সাহিত্যিক হবেন, ফিল্ড মেডেল বিজয়ী গণিতবিদ হবেন, অস্কার বিজয়ী চিত্র পরিচালক হবেন, অলিম্পিকে স্বর্ণ বিজয়ী দৌড়বিদ হবেন, ওয়ার্ল্ডকাপ বিজয়ী ক্রিকেট টিম হবে এমন কী মহাকাশ বিজয়ী মহাকাশচারী হবেন, কিন্তু আর কখনোই মুক্তিযোদ্ধা হবেন না! এই সম্মানটুকু সৃষ্টিকর্তা যাদের জন্যে আলাদা করে রেখেছেন শুধু তারাই তার প্রাপ্য, অন্যেরা নন। (তাই আমি যখন দেখি অল্প কিছু সুযোগ-সুবিধার জন্যে কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদ বের করে ফেলছেন, তখন আমার মনে হয় গলায় আঙুল ঢুকিয়ে তাদের ওপর হড় হড় করে বমি করে দেই। )
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি আমার ভেতর এখন গভীর ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা। আমি সব সময়েই চেষ্টা করে এসেছি, নতুন প্রজন্মের ভেতরে সেই অনুভূতিটুকু সঞ্চায়িত করতে যেভাবে সম্ভব মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু পৌঁছে দিতে।
একটি সময় ছিল যখন এই দেশে রাজাকারদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়তো, মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করে দেখানো হত, মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননা করা হতো- তখন এই দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের বুকের ভেতর যে গভীর অভিমান জমা হয়েছিল, আমি সেই কথা কখনো ভুলতে পারবো না। আমাদের খুব সৌভাগ্য আমরা সেই সময়টি পেছনে ফেলে এসেছি। এই দেশের মাটিতে আমরা আর কখনো কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে অবমাননা করতে চাই না।
তাই যখন আমি আবিষ্কার করেছি, একটি বইয়ের বিষয়বস্তুর কারণে এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারকে অপমান করার চেষ্টা করা হচ্ছে, তখন বিষয়টি আমাকে গভীরভাবে আহত করেছে। এ কে খন্দকার শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধা নন, তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ। ষোলই ডিসেম্বর যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পণ করে, তখন তিনি আমাদের বাংলাদেশের প্রতিনিধি ছিলেন।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি তিনি এবং তার সহযোদ্ধারা মিলে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম তৈরি করে নতুনভাবে আমদের সামনে নিয়ে এসেছিলেন। আমাদের তরুণেরা সেটা সাগ্রহে গ্রহণ করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধের জন্যে ভালোবাসা এদেশে আবার নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছেন, দেশের মানুষকে সংগঠিত করেছেন।
মনে আছে, তিনি এবং তার সহযোদ্ধারা একবার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন এবং এয়ারপোর্ট থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পর্যন্ত পথটুকু আমি গাড়িতে তার পাশে বসে এসেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের এরকম একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের পাশে বসে আছি চিন্তা করেই আমি শিহরিত হয়েছিলাম। তিনি এবং তার সহযোদ্ধারা আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে কথা বলেছিলেন, তাদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন। আমরা তাদের নিয়ে আমাদের একটা খোলা চত্ত্বরে তাদের হাতে কিছু গাছ লাগিয়েছিলাম। এতোদিনে গাছগুলো বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি নিয়ে অনেক বড় হয়েছে। আমরা সেই চত্ত্বরটিকে সেক্টর কমান্ডারস চত্ত্বর বলে ডাকি।
সে কারণে যখন আমি দেখি, এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারকে তীব্র ভাষায় শুধু সমালোচনাই নয়, অপমান করার চেষ্টা করা হচ্ছে, তখন সেটি আমাকে তীব্রভাবে আহত করে। যারা তাকে নানাভাবে অপমান করার চেষ্টা করছেন, তারা কী বুঝতে পারছেন না, তাকে এভাবে আসলে আমরা শুধু আমাদের নিজেদেরকেই খাটো করে দেখার চেষ্টা করছি!
খবরের কাগজে দেখেছি, বার্ধক্যের কথা বলে তিনি সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের নেতৃত্বে থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। কাউকে নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না, তাকে নিয়ে তীব্র সমালোচনা, বিতর্ক এবং অপমানই হচ্ছে এর মূল কারণ।
আমরা আমাদের দেশের একজন মানুষকে তার নিজের মতপ্রকাশের জন্যে এভাবে অসম্মান করবো, আমি সেটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না।
২.
এটি অবশ্যি কেউ অস্বীকার করবেন না যে, এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের বইটি পড়ে আমাদের সবারই কম বেশি মন খারাপ হয়েছে। আমরা সবাই আশা করেছিলাম, তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তার যে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা লিখবেন, সেটি ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে। কিন্তু তিনি যেটুকু নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন তার চেয়ে বেশি ইতিহাসকে নিজের মত করে বিশ্লেষণ করে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
তিনি একজন সৈনিক, তার বিশ্লেষণ হয়েছে সৈনিকের চোখে, ইতিহাসবিদ সাধারণ মানুষ কিংবা রাজনৈতিক মানুষের সাথে তার বিশ্লেষণ মিলবে তার গ্যারান্টি কোথায়? সবচেয়ে বড় কথা, এই বইয়ে তিনি তা লিখেছেন সেখানে তার নিজের অভিজ্ঞতার কথাগুলো ছাড়া অন্য সব কথাই কিন্তু আমরা সবাই অন্য জায়গায় শুনেছি! আমার দুঃখ হয়, অন্য মানুষের মুখে আগে শুনে থাকা কথাগুলোর জন্যে আজকে তার মতো একজন মানুষকে এতো অসম্মান করা হলো।
আমি মোটেই বইটি নিয়ে আলোচনা করবো না। শুধু বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি বিষয় নিয়ে কথা বলবো। এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার লিখেছেন ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তার ভাষণটি শেষ করেছেন ‘জয় পাকিস্তান’ বলে। হুবহু এই বিষয়টি লিখেছিলেন বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান তার ‘বাংলাদেশের তারিখ’ বইটিতে। তিনি অবশ্য ‘জয় পাকিস্তান’ লেখেননি, তিনি লিখেছিলেন ‘জিয়ে পাকিস্তান’। পরবর্তী কোনো একটি সংস্করণে তিনি বই থেকে কথাটি সরিয়ে দিয়েছিলেন।
আমি ধরে নিচ্ছি, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তার এই তথ্যটি ভুল ছিল, তিনি ভুল সংশোধন করেছেন। এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার যেহেতু দাবি করেননি তিনি নিজের কানে বঙ্গবন্ধুকে ‘জয় পাকিস্তান’ বলতে শুনেছেন, তাই আমি ধরে নিচ্ছি, বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান যেখান থেকে এই তথ্যটি পেয়েছেন, তিনিও সম্ভবতঃ একই জায়গায় সেটি পেয়েছেন।
এই বিচিত্র তথ্যসূত্রটি কী? আমার মনে হয় এর সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য ব্যবস্থা দিয়েছেন সৈয়দ বদরুল আহসান ডেইলি স্টার পত্রিকায়। তিনি লিখেছেন, ‘৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর দেয়া ভাষণটি যখন পশ্চিম পাকিস্তানে প্রচার করা হয় তখন স্থানীয় পত্রিকাগুলো তাদের দেশের মানুষ যেন বিচলিত না হয় সেজন্যে বক্তৃতার শেষে এই কথাটুকু জুড়ে দিয়েছিল। সেই কথাটিই এখনো নানাজনের কথায় নানাভাবে চলে এসেছে’।
দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে। তিনি লিখেছেন তাজউদ্দীন আহমদের অনুরোধের পরও তিনি একটি স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে রাজি হননি। আমি ইতিহাসবিদ নই, আমি নির্মোহ ভাবে চিন্তা করতে পারি না। কিন্তু আমার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আগ্রহ আছে, ছোটদের জন্যে ২২ পৃষ্ঠার একটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখার জন্যে আমাকে অনেক বই পড়তে হয়েছিল! আমি পাকিস্তানি মিলিটারি অফিসার সিদ্দিক সালিকের বইয়ে দেখেছি, তিনি লিখেছেন, পঁচিশে মার্চ রাতে খুবই ক্ষীণভাবে একটি স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারিত হয়েছিল।
ঘোষণাটি কোথা থেকে এসেছিল তাজউদ্দীন আহমদের বড় মেয়ে শারমিন আহমদের বইটিতে (তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা, পৃষ্ঠা ১৪৬-১৪৭) দেয়া আছে। ট্রান্সমিটার বানানোতে পারদর্শী ইঞ্জিনিয়ার নুরুল হক ঘোষণাটি প্রচার করেছিলেন বলেই হয়তো পাকিস্তানি মিলিটারির হাতে তাকে প্রাণ দিতে হয়েছিল!
যাই হোক, আমি আগেই বলেছি, আমি আসলে এই বইটির বিষয়বস্তু নিয়ে লিখতে বসিনি, অনেকেই সেটা লিখছেন। সবচেয়ে বড় কথা, একাত্তরে বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু সমার্থক দুটি শব্দ ছিল। এতদিন পর দু’টি শব্দকে আলাদা করে দেখার সুযোগ কোথায়? বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে কী বাংলাদেশের জন্ম হত?
৩.
আগেই বলেছি, এয়ার বাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের বইটি পড়ে আমার একটু মন খারাপ হয়েছে। শুধু আমার নয়- আমার মতো অনেকেরই। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের মত যে সব মানুষের এক ধরনের ছেলেমানুষী উচ্ছাস রয়েছে, তারা সবচেয়ে বেশি মনে কষ্ট পেয়েছেন।
তবে আমার ধারণা, সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের। যে ভাষায় এবং যে প্রক্রিয়ায় তাকে অসম্মান করা হয়েছে, সেটা মেনে নেয়া কঠিন। আমার ধারণা তিনি নিজেও নিশ্চয়ই ভাবছেন, যে কথাগুলো ইতিহাসের সত্য বলে প্রকাশ করতে চাইছি, সেই কথাগুলো তো বঙ্গবন্ধুকে খাটো করে দেখানোর জন্যে আরো অনেকেই আগে এভাবে বলেছেন। তাহলে এই বইয়ে সেটি লিখে কার লাভ হলো?
আমিও ভাবছিলাম, কার লাভ হলো? তখন হঠাৎ করে উপলব্ধি করেছি যে লাভ হয়েছে বইয়ের প্রকাশকের! বইটি প্রকাশ করেছে প্রথম আলোর প্রকাশনা সংস্থা এবং তারা একটু পরে পরে বইটির বিজ্ঞাপন দিয়ে বইটির বিক্রি বাড়ানোর চেষ্টা করছে। খুবই স্থুলভাবে বলা যায়, একটি করে বই বিক্রি হচ্ছে, একজন সেই বই কিনছেন। সেই বই পড়ছেন আর মন খারাপ করছেন। আর প্রথমা প্রকাশনীর ক্যাশ বাক্সে একটু করে অর্থ যুক্ত হচ্ছে।
আমি যদি একজন প্রকাশক হতাম তাহলে কী শুধুমাত্র কিছু অর্থ উপার্জন করার জন্যে এরকম একটি বই প্রকাশ করে এই দেশের সবচেয়ে সম্মানী মানুষটিকে এরকম অসম্মানের দিকে ঠেলে দিতাম? কিছুতেই দিতাম না।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা বলে একটা কথা আছে। মাওলানা আবুল কালাম আজাদও তার মত প্রকাশ করার জন্যে ‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’ নামে একটা বই লিখেছিলেন। সেই বইয়ের সংক্ষিপ্ত একটা রূপ ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। পুরো বইটি পড়ে অনেকে মনে কষ্ট পেতে পারেন বলে তিনি বলেছিলেন, তার মৃত্যুর ৫০ বছর পরে যেন পুরো বইটি প্রকাশ করা হয়। তার মৃত্যুর ৫০ বছর পর আমরা সেই বইটি পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম।
কাজেই ইতিহাসে সত্য যুক্ত করার জন্যে সময় নেয়ার উদাহরণ পৃথিবীতে আছে। একজন মানুষের অসম্মান করা হবে জানলে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। দ্রুত অর্থ উপার্জনই পৃথিবীর একমাত্র পথ নয়।
বইটি পড়ে আমার ভেতরে এক ধরণের অস্বস্তি খচ খচ করছিল। বারবার মনে হচ্ছিল, সত্যিই কী বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে খন্দকার এই বইটি নিজের হাতে কাগজের ওপর কলম ঘষে ঘষে লিখেছেন? আমার কৌতুহলটি মেটানোর জন্যে আমি প্রথম আলোর প্রকাশনা সংস্থা ‘প্রথমা’কে ফোন করলাম। তাদের কাছে অনুরোধ করলাম, তার হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিটি কী আমি এক নজর দেখতে পারি? তারা একটু ইতস্তত করে আমাকে জানালেন, সেভাবে হাতে লেখা পুরো পাণ্ডুলিপি তাদের কাছে নেই। কিছু আছে। তবে তার সাথে আলাপ আলোচনা করেই পুরোটা প্রস্তুত করা আছে। এবং এই বইয়ের পুরো বিষয়বস্তুর সাথে তিনি পুরোপুরি একমত, সে রকম সাক্ষ্য-প্রমাণ তাদের কাছে আছে।
আমি লেখালেখি করি। তাই এই উত্তর শুনে আমি কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। আমার মনে হতে লাগল, এই বইটি কেমন করে লেখা হয়েছে কিংবা ‘প্রস্তুত’ করা হয়েছে সেটা খুব কৌতুহল উদ্দীপক একটা বিষয় হতে পারে।
বই লেখা আর বই প্রস্তুত করার মাঝে অনেক বড় পার্থক্য। আমরা কি প্রথমা প্রকাশনীর কাছ থেকে এই বই প্রস্তুত করা সংক্রান্ত একটা পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পেতে পারি, আমাদের মনের শান্ত্বনার জন্যে?
৪.
আমরা সবাই জানি, এই বইটি লেখার জন্যে এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারকে সম্ভবত তার জীবনের সবচেয়ে কষ্টকর একটা সময়ের ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। তিনি সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের নেতৃত্ব দেবেন না, আমি সেটা কল্পনাও করতে পারি না। তার বই পোড়ানো হয়েছে, খন্দকার মুশতাকের সাথে তুলনা করা হয়েছে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে কী বলা হচ্ছে, সেগুলোর কথা তো ছেড়েই দিলাম।
কিন্তু সবার কাছে আমার একটি খুব সোজা একটি প্রশ্ন। এই বইটি দেখার দায়ভার কী শুধু লেখকের? প্রকাশককেও কী খানিকটা দায়ভার নিতে হবে না? আপত্তিকর কিংবা বিতর্কিত কিছু লিখে একজন লেখক সমালোচনা আর অসম্মান সহ্য করবেন এবং সেই সমালোচনা আর অসম্মান বিক্রি করে প্রকাশক অর্থ উপার্জন করবেন, সেটি কেমন কথা? আমরা কী কোনোভাবে প্রকাশককেও দায়ী করতে পারি?
হুবহু এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের দেশে এর একটি ‘ক্লাসিক’ উদাহরণ আছে। এবং আমাদের অনেকেরই নিশ্চয়ই ঘটনাটি মনে আছে।
২০০৭ সালে প্রথম আলোর রম্য সাপ্তাহিকী আলপিনে একটা অত্যন্ত নিরীহ কার্টুন ছাপা হয়েছিল। এই দেশের ধর্মান্ধ গোষ্ঠী সেই নিরীহ কার্টুনটিকে একটা ইসলামবিরোধী রূপ দিয়ে হাঙ্গামা শুরু করে দেয়। এবং আমরা সবিস্ময়ে আবিষ্কার করি, অত্যন্ত দ্রুততার সাথে কার্টুনিস্টকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হল। শুধু তাই নয়, এটা প্রকাশ করার অপরাধে আলপিনের সম্পাদক সুমন্ত আসলামকে বরখাস্ত করা হল। এখানেই শেষ নয়, আমরা দেখলাম প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে পরিচিত বায়তুল মোকাররমের খতিবের কাছে হাত জোর করে ক্ষমা চেয়ে নিষ্কৃতি পেলেন। (আমার ধারণা ছিল, সংবাদপত্র আদর্শ এবং নীতির কাছে কখনো মাথা নত করে না। সেদিন আমার সেই ধারণাটিতে চোট খেয়েছিল!)
এই অত্যন্ত বেদনাদায়ক এবং নাটকীয় ঘটনা থেকে আমরা জানতে পারলাম, কোনো বিতর্কিত বা আপত্তিকর কিছু ছাপানো হলে লেখকের সাথে সাথে প্রকাশকদের সেই দায় গ্রহণ করতে হয়।
আগে গ্রহণ করেছেন। তাই আমার খুব ইচ্ছে আমাদের সবার কাছে সম্মানিত বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে খন্দকারে বক্তব্যের দায়ভার প্রকাশক খানিকটা হলেও গ্রহণ করে তাকে যেন তার সম্মানটুকু ফিরিয়ে দেন।
২৩.৯.১৪
বাংলাদেশ সময়: ০০০৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৪