ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

একজন গর্বিত মায়ের বিদায়ে আমরা শোকাহত

ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৪
একজন গর্বিত মায়ের বিদায়ে আমরা শোকাহত আয়েশা ফয়েজ

প্রয়াত কিংবদন্তি কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ, লেখক এবং অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং কার্টুনিস্ট ও রম্য লেখক আহসান হাবীবের জননী আয়েশা ফয়েজ শনিবার সকালে আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন। বার্ধক্যজনিত কারণে অনেকদিন ধরেই তিনি কিডনিসহ নানা ধরনের শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন।



খবরটি শুনে আমার খুবই খারাপ লাগছিলো, তাই তাঁর সম্পর্কে কিছু কথা না লিখে থাকতে পারলাম না।

তবে কয়েকদিন যখন শুনলাম তাঁকে ল্যাবএইড হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়েছে, তখনই কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলাম, হয়তো আর তাঁর ফেরা হবে না।

এর আগে ১৮ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার দুপুরে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে অবস্থার অবনতি হলে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়।

শুরু থেকেই আয়েশা ফয়েজের মেঝো ছেলে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, ছোট ছেলে কার্টুনিস্ট আহসান হাবিবসহ অন্য সন্তানেরা মায়ের পাশে ছিলেন। তাঁর তিন কন্যা সুফিয়া হায়দার, মমতাজ শহীদ ও রোখসানা আহমেদও পাশে ছিলেন।

আয়েশা ফয়েজ কোনো সাধারণ মা ছিলেন না।

আয়েশা ফয়েজের জন্ম ১৯৩০ সালের ২৩ মার্চ, নানাবাড়ি বারহাট্টার কৈলাটি গ্রামে। বাবা শেখ আবুল হোসেন এবং মা খায়রুন নেসা। ১৯৪৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি পরিচয় সূত্রে আবদ্ধ হন ফয়জুর রহমানের সঙ্গে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি তাঁর স্বামীকে হারান। অতঃপর যুদ্ধবিদ্ধস্ত বাংলাদেশে সহায়সম্বলহীন এই নারী পুরোপুরি এক অনিশ্চিত জীবনের মুখোমুখি হন এবং জীবনযুদ্ধে জয়ী হন।

আয়েশা ফয়েজ হুমায়ূন আহমেদ, জাফর ইকবাল এবং আহসান হাবীব তিন জনপ্রিয় লেখকের গর্বিত জননী। এছাড়াও তাঁর তিন কন্যা সুফিয়া হায়দার, মমতাজ শহীদ ও রোখসানা আহমেদও প্রতিষ্ঠিত নারী। ফলে আয়েশা ফয়েজ হুমায়ূন-জাফর ইকবালের গর্বিত মা নন, তিনি বাংলার নারীদের জন্য একজন অনন্য নারী।   

আয়েশা ফয়েজ এর লেখা জীবন যে রকম বইটি পড়লেই জানা যায় তার জীবন সংগ্রামের নানা কথা। আত্মজীবনীর শুরুতেই তিনি ১৯৪৪ সালের একজন বেকার ছেলের গল্প দিয়ে শুরু করলেন। ঠিকই মনে রেখেছেন ১৯৪৪ সালের ফেব্রুয়ারির আট তারিখে একজন বেকার ছেলের সাথে তাঁর বিয়ে হয়েছিল।

বেকার লোকটির নাম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ফয়েজুর রহমান। নতুন বউ হিসেবে নতুন পরিবারের দায়িত্ব- কর্তব্য কিভাবে পালন করলেন সবই উঠে এসেছে এই বইটিতে।

গ্রামের চলমান কুসংস্কার নিয়ে সেসময়ের অনেক কথা জীবন্ত হয়ে উঠে এসেছে এই বইটিতে। আরও কিছু পৃষ্ঠা উল্টালেই পাঠক খুঁজে পাবেন নতুন মা হওয়ার একটি খবর। আয়েশা ফয়েজ মা হয়েছেন। যে শিশুটি এখন আমাদের হুমাযূন আহমেদ।

গর্ভবতীদের ভিটামিন খাওয়ার ঘটনাটি সত্যিই হাস্যরসে ভরপুর। সে যুগে মুরুববীরা বিশ্বাস করতেন, গর্ভবতীদের ভিটামিন খাওয়ানো নিষেধ।
ভূতের ঝাড়ু দিয়ে ঝাড় দেবার ঘটনাও সত্যিই কৌতুকময়। বইটি পড়তে পড়তে মনে হবে এই ঘটনাটি এখনই ঘটলো বুঝি।

এরপরের গল্পগুলোতে উঠে এসছে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ এর  হুমাযূন আহমেদ এর নানার বাড়ির কিছু ঘটনা। আজমীর শরীফের ফুল নিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোও উল্লেখ করার মতো। এতো নাটকীয় ঘটনার পর যে ছেলেটির জন্ম হলো তাঁর নাম রাখা হলো কাজল। সেই কাজল হলো আমাদের জনপ্রিয় লেখক হুমাযূন আহমেদ। সেই কাজলের আসল নাম রাখা হয়েছিল শামসুর রহমান।

কাজলের দাদা ও দাদী এই নামটি রেখেছিলেন। কিন্তু কাজলের বাবা ফয়জুর রহমান এই নামটি গ্রহণ করেননি। তিনি নাম বদলে রাখলেন হুমাযূন আহমেদ। তারপর একে একে উঠে এসেছে হুমাযূন আহমেদ এর শৈশবের দুরন্তপনা, টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাগুলো।

হুমায়ুন আহমেদ এর বোন শেফুকে নিয়েও তিনি লিখতে ভুলে যাননি। বর্ননায় এসেছে ইকবাল, শাহীন এবং শিখুকে নিয়ে উল্লেখযোগ্য রচনা। ইকবালকে নিয়ে লিখেছেন ছোটবেলা থেকেই। ইকবাল ছিল পড়াশোনায় বেশ মনোযোগী, কিন্তু কাজল দুষ্ট প্রকৃতির। মনিকে নিয়ে লেখাগুলোর ভেতরে রয়েছে আদর মাখানো কিছু উক্তি। যেমন মনি কথা বলতে পারে না, কিন্তু সত্যিই সে ছিল মিষ্টি স্বভাবের একটি মেয়ে।

তারপর ফয়েজুর রহমান এর বদলির চাকরির কারণে আয়েশা ফয়েজ ঘুরেছেন সিলেট, পঞ্চগড়, রাঙামাটি, বান্দরবান, চট্টগ্রাম, বগুড়া, কুমিল্লা এবং অবশেষে ফিরোজপুর। ১২ নভেম্বর ১৯৭০ সাল থেকে উঠে এসেছে সেসময়ের রাজনীতির বিখ্যাত পুরুষদের কথা। এভাবেই শেখ মুজিব, ভাসানী, ইয়াহিয়াসহ অনেকের কথা তিনি অকপটে বলে গেছেন।

ফলে জাতি হারালো একজন আলোকিত মানুষ তথা মহিয়সী নারীকে। যার অবদান কখনো ভুলে যাবার নয়। আল্লাহ পাক তাকে বেহেশত দান করুন। আমিন।
ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান: গবেষক

বাংলাদেশ সময়: ১১৪৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।