হুমায়ূন ভাইয়ের সাথে আমার খাতির তিনি যখন বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষক, শহীদুল্লাহ হলের প্রভোস্ট। আমি তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পত্রিকা ‘প্রতিরোধে’ কাজ করি।
লেখা জোগাড় করতে গিয়ে আরো পরিচয় হয় ইব্রাহিম খাঁ’র নাতনি গোলতেকিন বেগমের সাথে, পিচ্চি শিলার সাথে। জাফর ভাই তখন নিউ জার্সিতে। মোহাম্মদ উল্লাহ—জ্যোতিদা-নবী ভাই-জাফর ভাইয়েরা তখন নিউ ইয়র্কের প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক ‘প্রবাসী’ বের করেন।
আমি তখন তাঁদের ঢাকা প্রতিনিধি। সেই সূত্রে জাফর ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ। আর তাঁদের ছোট ভাই শাহীন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। প্রতিবেশীও। আমরা থাকি মিরপুরে। শাহীন তাঁর মা-বোনদের নিয়ে থাকেন পল্লবীতে। তারা মোহম্মদপুর থেকে এখানে এসেছেন। বাসার কাগজপত্র ঠিক ঠাক করার জন্য আমি সচিবালয় থেকে যৎসামান্য সহযোগিতা করি, খালাম্মার কথায়। আমি প্রতি শুক্রবার পল্লবীতে সারাদিনের আড্ডায় জমে থাকতাম।
আবদার রশীদ, মিনু আপা, সুজয় দা, শুভ্র, মাকসুদের বাসার সকালসন্ধ্যা ম্যারাথন আড্ডা। আর সেই ফাঁকে কখনো আমার ছোট খালার বাসায়, কখনো শাহীনদের বাসায় ঢুঁ মারা। আয়শা খালাম্মা তখন ছেলের কথা, নাতিদের কথা বলতেন আনন্দে। তিনি ছিলেন রত্নগর্ভা জননী। দেশসেরা সন্তানদের মা! তাঁর প্রত্যেকটি কৃতী সন্তানই এক একটি মানিক-রত্ন!
এই রত্ন-মানিক তৈরি করতে একজন স্বামীহারা নারীকে কিভাবে সারাটা জীবন সংগ্রাম করতে হয়েছে, তা একবার ভাবলে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। একটি শহীদ পরিবারকে তিনি বিকশিত করে আলোকিত করেছেন সমস্ত বাংলাদেশকে।
এক দিন বাসায় গেছি। শাহীন নেই। ছোটবোনটি দৌড়ে ভেতরে গিয়ে মা’কে টেনে আনলেন। তিনি তখন অত্যন্ত স্নেহের সুরে বললেন, বসো বাবা। শাহীন নেই, তাতে কী। চা খাও। চা খেতে খেতে অনেক কথা বললেন। মীরপুরের বাসাটার অফিসিয়াল কাজ করে দেয়ার পেছনে আমার সামান্য ভূমিকার জন্য ধন্যবাদ দিলেন।
মণিকে বিয়ে দেয়ার জন্য তাঁর মতোই সমমনা সম পর্যায়ের একটি বোবা ছেলে খুঁজছেন। তাহলে মনির মনের ভেতরের বিষয়গুলো বুঝতে পারবে। পরে আয়শা খালাম্মার আশা পূর্ণ হয়েছিলো। সেই ধরনের একটি ছেলের সাথে বিয়ে হবার পর মিরপুর ১১ বাসস্ট্যান্ডের মসজিদ সংলগ্ন একটি মনিহারি দোকান দিয়েছিলো। আমি ছিলাম সেই দোকানের প্রায় নিয়মিত ক্রেতা।
এভাবেই তিনি তাঁর জীবনসংগ্রামের কথা বলতেন। বিশেষ করে মোহনগঞ্জের-কেন্দুয়ার কথা, মুক্তিযুদ্ধের সময় পিরোজপুরের কথা। হুমায়ুন আহমেদ কাজল ওরফে বাচ্চু-শাহীনদের ‘ছোটবেলা’র কথা! যা পরে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে, লেখায় এবং তাঁর ‘জীবন যখন যেমন’ স্মৃতিকথায় ঘুরে ফিরে এসেছে। সে-ও অসাধারণ গ্রন্থটি যেনো বাংলার এক সংগ্রামী নারীর জীবনের সাফল্যের ইতিহাস। তুলে ধরছি, সেই ‘জীবন যখন যেমন’এর সারসংক্ষেপঃ
“১৯৪৪ সালের ফেব্রুয়ারীর আট তারিখে একজন বেকার ছেলের সাথে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। বেকার লোকটির ফয়েজুর রহমান। নতুন বউ হিসেবে নতুন পরিবারের দায়িত্ব, কর্তব্য, গ্রামের চলমান কুসংস্কার নিয়ে সেসময়ের অনেক কথা জীবন্ত হয়ে উঠে এসেছে বইটিতে।
উঠে এসেছে হুমায়ুন আহমেদ-এর নানার বাড়ির নানান মজার ঘটনা। তাঁর জন্মের পর দাদা ও দাদী নাম রাখা হলো কাজল। কিন্তু কাজলের বাবা ফয়জুর রহমান এই নামটি গ্রহন করেননি। তিনি নাম বদলে রাখলেন হুমায়ুন আহমেদ। তারপর একে একে উঠে এসেছে হুমায়ুন আহমেদ শৈশবের দুরন্তপনা, টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার টুকরো টুকরো স্মৃতি। বর্ননায় এসেছে ইকবাল, শাহীন, শিখু, মনি সবাই। ইকবালকে নিয়ে নিয়ে লিখেছেন ছোটবেলা থেকেই ইকবাল ছিল পড়াশোনায় বেশ মনোযোগী কিন্তু কাজল দুষ্ট প্রকৃতির। মনিকে নিয়ে লেখাগুলোর ভেতরে রয়েছে আদর মাখানো উক্তি। মনি কথা বলতে পারে না কিন্ত সে এক অসাধারণ মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে...
স্বামীর পুলিশী চাকরী বদলির কারণে তিনিও ঘুরেছেন সিলেট, পচাগড়, রাঙামাটি, বান্দরবান, চট্রগ্রাম, বগুড়া, কুমিল্লা এবং অবশেষে ফিরোজপুর। তাঁর স্মৃতিকথায় সেসময়ের রাজনীতির বিখ্যাত পুরুষদের কথা। শেখ মুজিব, ভাসানী, ইয়াহিয়াসহ অনেকের কথা অকপটে বলে গেছেন,” আয়শা ফয়েজ।
হুমায়ুন আহমদের প্রথম বই ‘নন্দিত নরকে’র বোবা মেয়েটি যেনো তাঁর বড় আদরের ছোটবোন মনি’র কথাই মনে করিয়ে দেয়।
তাই আয়শা ফয়েজের দুঃখ ছিলো, ১৯৭১-এ স্বামী ফয়জুর রহমান আহমদকে হারানোর বেদনা এবং তাঁর প্রিয় বোবা মেয়ে মনিটি। সেখানে এসে আমিও যেনো ‘বোবা’ হয়ে যেতাম। আজ সকালে আবার আমি ‘বোবা’ হয়ে গেলাম।
আজ তিনি নেই। তিনি মানে- আয়শা ফয়েজ নেই। আজ সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে অনলাইন ইত্তেফাকে দেধি, তিনিও চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে গেছেন। তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল: প্রবাসী কবি, লেখক, saifullahdulal@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ২২১৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৪