প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে এ প্রার্থিব জগতে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে শক্তিপূজার প্রচলন ছিলো। অসুর শক্তি নিধনে শক্তিপূজার মাহাত্ম বিশ্বজুড়ে বিদ্যমান রয়েছে।
অতি প্রাচীনকালে মিশর, ইউরোপ, জাপান, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে শক্তিপূজার প্রচলন ছিলো। জাপানে এবং চীনের ক্যান্টন শহরে ১০৮ বাহু বিশিষ্ট চনষ্টিদেবীর মন্দির এখনো আছে। এ দেবী দূর্গারই প্রতিরূপ।
অসুররা যখন দেবতাদের স্বর্গরাজ্য থেকে বিতাড়িত করে ফেলল তখনই ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিবের তেজের ঘনিভূত রূপ থেকে আবির্ভূত হলেন দেবী দুর্গা। তাঁর তিন নয়ন হচ্ছে সূর্য, চন্দ্র ও অগ্নির প্রতীক।
দু’টি শিক্ষা আমরা আদ্যাশক্তি এই দুর্গা পূজা থেকে পাই। একটি হলো দুষ্টের দমন, অপরটি হলো শিষ্টের পালন। সেখানে দেখা যায়, জনগণের কল্যাণে ব্রতী হয়ে রাজা সুরথ অসুরদের দ্বারা স্বর্গরাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে দেবী দুর্গার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। তাদের সবারই প্রার্থনায় সন্তুষ্ট হয়ে দেবী স্বীয় শক্তিতে আবির্ভূত হয়েছেন দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের জন্য।
আরেকটি হলো মানুষের পশুশক্তিকে মানবীয় শক্তিতে পরিণত করার সাধনা। আর এ জন্যই মানুষ নিজের পশুত্বকে বিসর্জন দেয়ার জন্য পশুবলি দেয়। কিন্তু, আসলে কি আমরা আমাদের পশুত্বকে বিসর্জন দেই?
মহাভারতের দুর্গাপূজা প্রাচীনকাল থেকে হয়ে আসছে। রাজা সুরথ এবং সমাধি বৈশ্যের পর দুর্গাপূজার আয়োজন করেন ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের রাজশাহীর তাহিরপুরের রাজা কংস নারায়ণ। ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে ভারতের কলকাতার জমিদার লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার অত্যন্ত জাকজমকের সঙ্গে দুর্গাপূজা করেন। এরপর থেকে সনাতন ধর্মাবলম্বী বাঙালি হিন্দু জমিদাররা নিয়মিতভাবে ভগবতী মা দুর্গার পূজা করে আসছেন।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে শারদীয়া দুর্গাপূজা বাঙালি হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসবে পরিণত হয়। তখন থেকেই পূজার চেয়ে উৎসবের দিকটা প্রাধান্য পায়।
আজ এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে অর্থাৎ মহাবিশ্বে যে হানাহানি চলছে, দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার চলছে, তার মূলে রয়েছে আসুরিক শক্তির প্রবণতা। যুগে যুগে আমাদের সমাজে অসুরের আগমন ঘটে। আর সেই অশুভ শক্তির প্রতীক অসুরের হাত থেকে পরিত্রাণ পাবার আশায় শুভশক্তির প্রতীক দুর্গাপূজা করতে হয়। অশুভ শক্তি কারো কাম্য নয়, সবাই কিন্তু শুভ শক্তির প্রার্থনা করে। মা দুর্গা এজগতের সর্বশান্তি ও মঙ্গলের বিধাত্রী স্বরূপা।
দুর্গাপূজার মূলে রয়েছে সৌভ্রাতৃত্ববোধ। এই মহাপূজায় ধনী-দরিদ্র, উচ্চ-নীচ সবাই মিলিত হয় পরমানন্দে। কারণ মা দুর্গার কাছে সকল সন্তানের সমান অধিকার। তিনি যে বিশ্বমাতা, আদ্যাশক্তি মহামায়া। তাই তিনি বিশ্বজননী। সকল প্রকার মানুষের মিলিত প্রয়াসই দুর্গাপূজা। তাইতো এটি সার্বজনীন মহামিলনোৎসব। দুর্গাপূজা সম্পর্কে পুরাণ ও হরিবংশে উল্লেখ রয়েছে। মহাভারতের বিরাট পর্বে ও ভীম্ম পর্বে দেবী দুর্গার বিভিন্ন স্তবের বর্ণনা পাওয়া গেছে। সকল স্থানেই ভগবতী মহামায়ার উপর ভগবানের সত্তা আরোপ করা হয়েছে। লক্ষনীয় বিষয় হলো, দেশাচারের সঙ্গে মিলিয়ে এবং পারিবারিক পরিবেশের প্রভাবে প্রভাবিত করে দেবীকে স্বজন-পরিজনরূপে পূজা করার প্রয়াস একমাত্র এদঞ্চলেই সম্ভব হয়েছে।
সনাতন ধর্মাবলম্বী বাঙালি হিন্দুরাই একমাত্র ভগবতী মা দুর্গাকে সাংসারিক জীবনের প্রতিটি স্তরে শ্রদ্ধার অর্ঘ্য দেয়ার নিদর্শন দেখিয়েছে। তিনি যেন আমাদেরই মা। আর মায়ের পূজাই হচ্ছে মাতৃপূজা। রাজনীতি যেখানে ব্যর্থ, অর্থনীতি অচল, নৈতিকতার অবক্ষয় দেশে বিরাজমান, আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি- অসুর শক্তি ধ্বংসকারী মা দুর্গার পূজা, মাতৃপূজাই তখন হয়ে উঠে মুক্তির একমাত্র অবলম্বন। মাতৃপূজাই যেন হয় শান্তির পূজা।
“ওঁ সর্ব্বমঙ্গল্য মঙ্গল্যে শিবে সর্ব্বার্থসাধিকে
স্বরণ্যে এ্যাম্বকে গৌরী নারায়ন নমোহস্তুতে”॥
সুনির্মল সেন সাংবাদিক ও কলামিস্ট
বাংলাদেশ সময়: ১৩১৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৪