ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

খন্দকারের বইয়ে জিয়াই ঘোষক!

আসাদ জামান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৩৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১, ২০১৪
খন্দকারের বইয়ে জিয়াই ঘোষক!

২৭ সেপ্টেম্বর জামালপুর জনসভায় ঘণ্টাব্যাপী ভাষণের শেষ দিকে বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া এ কে খন্দকারের বহুল আলোচিত বই ‘১৯৭১: ভেতরে বাইরে’ উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন ‘শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি, জিয়াউর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। ’
 
খালেদা জিয়ার বক্তব্যের ওই অংশটুকু ছিলো অনেকটা এ রকম- ‘‘আপনারা (আওয়ামী লীগ) কথায় কথায় জিয়াউর রহমানকে রাজাকার বলেন, আইএসআই ও পাকিস্তানের চর বলেন।

অথচ এই জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে মুক্তিযুদ্ধ হতো না। দেশ স্বাধীন হতো কি না, তা নিয়েও সন্দেহ আছে। ...... এই যে এ কে খন্দকার সারাজীবন আওয়ামী লীগ করেছেন। কয়েকদিন আগে তিনি একটি বই লিখেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘‘শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। জিয়াউর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। ’’
 
ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে জামালপুর জেলা সেটেলমেন্ট অফিসের বারান্দায় বসে নিজ কানে খালেদা জিয়ার এই বক্তব্য শোনার পর কিছুটা থ’ খেয়ে গেলাম।   
 
কেননা খালেদা জিয়া এ কে খন্দকারের যে বইটিকে রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করলেন সেই বইয়ের ৬০ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, ‘মেজর জিয়ার ঘোষণাটিকে কোনোভাবেই স্বাধীনতার ঘোষণা বলা চলে না। মেজর জিয়া রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না বা ঘোষণা দেওয়ার মতো উপযুক্ত ব্যক্তিও ছিলেন না। যে ঘোষণা চট্টগ্রাম বেতার থেকে তিনি দিয়েছিলেন ঠিক একই ধরনের একাধিক ঘোষণা ২৬ ও ২৭ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার থেকে বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতাও দিয়েছিলেন, এমন কি বেতারকর্মীরাও একই ধরনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। ’
 
দুই.
বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দলটির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করতেই পারেন। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান আরেক ধাপ এগিয়ে জিয়াউর রহমানকে দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতিও দাবি করতে পারেন। এতে দোষের কিছু দেখি না! নিজ দলের প্রয়াত নেতাকে স্বাধীনতার ঘোষক এবং প্রথম রাষ্ট্রপতি দাবি করে তারা হয়তো ইতিহাসের স্বাভাবিক গতির সামনে ছোট্ট একটা স্পিড ব্রেকার খাড়া করেছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটি নতুন কোনো ঘটনা নয়।
 
কিন্তু যখন দেখি খালেদা জিয়া তার দাবির পক্ষে এ কে খন্দকারের ‘১৯৭১: ভেতরে বাইরে’ বইটিকে সাক্ষী মেনেছেন তখন খটকা লাগে। কারণ, ওই বইয়ের কোনো জায়গায় মেজর জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলা হয়নি। বরং স্বাধীনতার ঘোষক হওয়ার জন্য যে ন্যুনতম যোগ্যতার প্রয়োজন সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বইয়ের লেখক। এমনকি জিয়াউর রহমানের ঘোষণাটিকে কালুরঘাট স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের স্বাধারণ কর্মীর ঘোষণার সঙ্গে তুলনা করেছেন।
 
এখন প্রশ্ন হলো বিএনপির চেয়ারপার্সন এ কে খন্দকারের বইটি কি পড়েননি? এ বিষয়ে কয়েকটি সম্ভবনার কথা বলা যেতে পারে- ১. বইটি প্রকাশের পর দেশব্যাপী হৈ চৈ হলেও খালেদা জিয়া এখন পর্যন্ত সেটি পড়ার সুযোগ পাননি। ২. বইটি পড়েছেন, কিন্তু বইয়ের ৬০ নম্বর পৃষ্ঠা তার চোখ এড়িয়ে গেছে। ৩. বইটি পড়েছেন এবং ৬০ নম্বর পৃষ্ঠায় যা আছে সেটিও তার চোখ এড়িয়ে যায়নি। কিন্তু মঞ্চে ভাষণ দেওয়ার সময় বিষয়টি গুলিয়ে ফেলেছেন।
 
তিন.
বাংলাদেশের রাজনীতি কয়েকটি দূরারগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত। এগুলোর মধ্যে স্ট্যানবাজি, মিথ্যাচার, তথ্য ও ইতিহাস বিকৃতি অন্যতম। এ কে খন্দকারের সর্বশেষ বই ‘১৯৭১: ভেতরে বাইরে’ এগুলো থেকে মুক্ত নয়। বইটির পরতে পরতে স্ট্যানবাজি, মিথ্যাচার, তথ্য ও ইতিহাস বিকৃতি স্পষ্ট।
 
সে কারণেই কি না বইটি প্রকাশের পর প্রতিপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধ জয়ের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্রহ্মাস্ত্র হিসেবে গ্রহণ করল বিএনপি। নাওয়া-খাওয়া ভুলে গিয়ে, সব কিছু ছেড়ে দিয়ে বইয়ের সব তথ্যকে শতভাগ সত্য হিসেবে প্রচারে মাঠে নেমে পড়ল দলটির নেতারা। বইটি পড়া তো দূরের কথা এর প্রচ্ছদটি দেখার সুযোগ যেসব নেতার হয়নি তারাও এর প্রতিটি শব্দকে বেদবাক্য হিসেবে সনদ দিতে শুরু করলেন। অথচ তারা জানতেই পারলেন না দীর্ঘদিন ধরে তাদের নেতাকে স্বাধীনতার ঘোষক বানানোর জন্য যে প্রাণান্তকর চেষ্টা তারা চালিয়ে যাচ্ছেন সে চেষ্টার মুখে কতটা ছাই ঢেলে দিয়েছেন বইয়ের লেখক।
 
বইটি প্রকাশের ১১ দিন পর ১৩ সেপ্টেম্বর প্রকৌশলীদের মহাসমাবেশে প্রথম বক্তৃতা দেন খালেদা জিয়া। ঘণ্টাব্যাপী ওই বক্তৃতায় বই সম্পর্কে কোনো কথা বলেননি তিনি। এর পর ২৩ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জনসভায়ও যখন এ বিষয়ে কোনো কথা খালেদা জিয়ার মুখ থেকে বের হলো না তখন আশাবাদি হয়েছিলাম এই ভেবে যে, দলের চাটুকার ও পাতি নেতারা না বুঝলেও খালেদা জিয়া ঠিকই বুঝেছেন এ কে খন্দকারের বই নির্দিষ্ট কোনো নেতা বা দলের প্রতিপক্ষ নয়, ইতিহাসের প্রতিপক্ষ। কিন্তু জামালপুর জনসভায় খালেদা বুঝিয়ে দিলেন নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করার সংস্কৃতিতে তিনিও পিছিয়ে নন।
 
চার.
বিএনপি নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা সব সময় বলে থাকেন বাংলাদেশের সব চেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী হলেন খালেদা জিয়া। তাদের এই বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসীরা দ্বিমত পোষণ করতেই পারেন। তবে গত ৭ বছরে দেশের প্রায় ৪০টি জেলায় খালেদা জিয়ার জনসভা কাভার করতে গিয়ে মনে হয়েছে বাংলাদেশের সব চেয়ে জনপ্রিয় দুই নেত্রীর একজন তিনি। জনপ্রিয়তার বিচারে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া খালেদা জিয়ার সমকক্ষ আর কোনো রাজনীতিক এই মুহূর্তে বাংলাদেশে নেই।
 
কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়। দেশের সব চেয়ে জনপ্রিয় এই নেত্রী মাঝে মধ্যে কিছু ‘ধান্দাবাজ’ দ্বারা প্রভাবিত হন। ফলে আমরা দেখি জনৈক স্বঘোষিত তাত্ত্বিক ও দার্শনিক এবং তথাকথিত ‘নির্ভিক’ সম্পাদকের পরামর্শে ভারতের রাষ্ট্রপতিকে ফিরিয়ে দেন। সুবিধাবাদী ‘হেফাজত গোষ্ঠীর’ জন্য জান কোরবান করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার হিসাবের খাতা শূন্যই থেকে যায়।
 
বিএনপি এখন মহাসংকটে। ১৯৭৮ সালে দলটির জন্মের পর এত বড় সংকট আর কখনো আসেনি। এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য বিএনপি নেত্রীকে আস্থা রাখতে হবে জনগণের ওপর। চাটুকার ও সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শ উপেক্ষা করে কঠোর কর্মসূচি থেকে সরে এসে জনগণকে আস্থায় আনার কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে সেদিকেই হাঁটছেন তিনি। হরতাল-অবরোধ-ঘেরাও, জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচির পরিবর্তে জেলায় জেলায় জনসভার মতো সময়োপযোগী কর্মসূচি পালন করছেন। কিন্তু সেই জনসভা মঞ্চে দাঁড়িয়ে লাখো জনতার সামনে ভাষণ দিতে গিয়ে কোনো পতিতজনের লেখা বিকৃত ইতিহাস টেনে আনলে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছা আরো কঠিন হয়ে যাবে।  
 
আসাদ জামান, সংবাদকর্মী  
 
বাংলাদেশ সময়: ০১৩৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ০১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।