একটি দেশকে উন্নতির স্বর্ণ-শিখরে পৌঁছাতে হলে, সেই দেশের শিক্ষার দিকে প্রথমে তাকাতে হয়। সে দেশটির জনগোষ্ঠীকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হয়।
কিছুদিন আগে এদেশের পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে সারাদেশে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছিল। দেশের বিশাল একটি শিক্ষিত জনগণ বলেছিলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে, দ্রুত এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন।
এর বিপরীতে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী উত্তর দিলেন প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি! সারাদেশে যখন এ নিয়ে আলোড়ন চলছে তখন মাননীয় মন্ত্রীর এহেন বক্তব্য এ দেশের শিক্ষিত সমাজকে হতাশ করে তোলে, এ দেশের শিক্ষিত সমাজ বারবার বলেছে মাননীয় মন্ত্রী প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে, আপনি সজাগ হোন, প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের গ্রেফতার করুন। কিন্তু মাননীয় মন্ত্রী একে নিছক সাজেশন হিসাবে অ্যাখ্যায়িত করেছেন যা প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের একপ্রকার বাহবা দেওয়ার সমতুল্য। অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল থেকে শুরু করে অনেকেই এ নিয়ে বিভিন্ন লেখালেখিও করেছেন, প্রতিবাদ করেছেন, তারপরেও বিশেষ অজ্ঞাত কারনে থেমে থাকেনি প্রশ্নপত্র ফাঁস। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল সেই প্রশ্ন, যার ফলে শিক্ষার্থীরা রাত জেগে অনলাইনে প্রশ্নপত্র সংগ্রহে ব্যস্ত ছিল। এমন অনেক শিক্ষার্থীকে দেখেছি যারা শুধু প্রশ্নপত্র পেয়ে তারপর পড়ার টেবিলে বসতে গিয়েছে।
শিক্ষাবিদরা ধারণা করেছিল এর ভয়াবহ পরিণাম খুব সহজেই খুঁজে পাওয়া যাবে। এ বছর দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশাবিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলের দিকে তাকালেই এর বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায়।
চলতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, ‘ক’ ইউনিটে পাস করেছে ২১.৫০ শতাংশ, ‘খ’ ইউনিটে ৯.৫৫ শতাংশ, ‘গ’ ইউনিটে ২০.৬১ শতাংশ, ‘ঘ’ ইউনিটে ১৬.৫৫ শতাংশ ও ‘চ’ ইউনিটে মাত্র ৩.১০ শতাংশ। ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচটি ইউনিটে পাসের গড় হার ১৪.২৬ শতাংশ। মোট তিন লাখ এক হাজার ১৩৮ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছে ৫৫ হাজার ২৭৮ জন। অথচ এবারের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়েছে ৭০ হাজারের উপরে। অর্থাৎ তাদের অনেকেই ভর্তি পরীক্ষায় পাস করতে পারেনি। গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার পাঁচটি ইউনিটে অংশগ্রহণ করেছিল দুই লাখ ১৭ হাজার শিক্ষার্থী। এর মধ্যে উত্তীর্ণ হয় ৪১ হাজার ৮৯১ জন। পাসের হার ছিল ১৯.৩০ শতাংশ। গত বছরের তুলনায় এ বছর প্রায় ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী কম পাস করেছে।
গত কয়েক বছরের পাশের হার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় 'ক’ ইউনিটে পাশের হারের দিকে তাকালে দেখা যায়, ২০০৯ সালে এসএসসি পাসের হার ৬৭ দশমিক ৪১ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৪৫ হাজার ৯৩৪ জন, ঢাবিতে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণের হার ছিল ৪৬ দশমিক ২ শতাংশ। ২০১০ সালে পাসের হার ৭৮ দশমিক ৯১ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৬২ হাজার ১৩৪ জন, ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণের হার ছিল ৪৫ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ; ২০১১ সালে পাসের হার ৮২ দশমিক ১৬ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৬২ হাজার ৭৮৮ জন, ভর্তি পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৪১ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ; ২০১২ সালে পাসের হার ৮৬ দশমিক ৩২ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৬৫ হাজার ২৫২ জন, ভর্তি পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৩৯ দশমিক ৪৫ শতাংশ; ২০১৩ সালে পাসের হার ৮৯ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৯১ হাজার ২২৬ জন, ভর্তি পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৩১ দশমিক ৮৮ শতাংশ; ২০১৪ সালে পাসের হার ৯১ দশমিক ৩৪ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছিল ১ লাখ ২২ হাজার ৩১৩ জন, ভর্তি পরীক্ষায় পাসের হার ২১ দশমিক ৫ শতাংশ।
২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পরীক্ষায় পাশের হার এবং ঢাবি ক ইউনিটে পাসের হারের তুলনামূলক গ্রাফ চিন্তা করলে দেখা যায়, যতই পাশের এবং এ প্লাসের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে ততই ঢাবির ভর্তি পরীক্ষায় পাশের হার কমে যাচ্ছে। গ্রাফটা দেখলেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সেই অমর গানটির কথা মনে পড়ে যায়-
"আজ দুজনার দুটি পথ ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে"
শুধু 'ক' ইউনিট নয়, সব ইউনিটের রেজাল্ট গত কয়েক বছরের চেয়ে অনেক বেশি খারাপ হচ্ছে। তবে সবাইকে হতবাক করে প্রকাশিত হয় ‘খ’ ইউনিটের ফলাফল ২৩ সেপ্টেম্বর। পাসের হার মাত্র ৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ। কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার শব্দ শোনার মতোই জানা গেল ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন মাত্র দুজন। 'চ' ইউনিটের ক্ষেত্রে আরও নাজুক অবস্থা, এখানে পাশের হার মাত্র ৩ দশমিক ১০ শতাংশ।
শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়- জগন্নাথ, জাহাঙ্গীরনগরসহ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।
এখন প্রশ্ন, এত সব জিপিএ-৫ এবং গোল্ডেন জিপিএ-ধারীরা কোথায়? সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বন্যার বেগে জিপিএ-৫ বা গোল্ডেন জিপিএ যারা পাচ্ছে, তাদের মান নিয়ে উদ্বেগ শোনা যাচ্ছিল। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের ফল বের হওয়ার পর হাসিমুখে বলে থাকেন, শিক্ষার উন্নতি হচ্ছে বলেই ছেলেমেয়েরা ভালো ফল করছে। ৯০ শতাংশ পাস করে, লক্ষাধিক জিপিএ–৫ পায়। এদেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীও শিক্ষার হার বৃদ্ধি এবং জিপিএ-৫ বৃদ্ধিতে অখুশি নয়। কিন্তু তারপরেও একটি প্রশ্ন থেকে যায়, যখন সব জায়গায় আলোচনার ঝড় উঠে প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে।
বারবার প্রশ্নপত্র ফাঁস, ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেওয়া, অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের উদ্বেগ-অনশনের উত্তরে শিক্ষামন্ত্রীর লেখা এদেশের মানুষ পড়েছে। শিক্ষামন্ত্রী কখনো প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে এমনটা স্বীকার করতে চাননি বরং তিনি রাজনৈতিক চাটুকারিতার পরিচয় দিয়েছেন। ফলে এদেশের লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী হতাশ হয়ে পড়েছিলেন।
জাতিকে এই বিষাদময় সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এ বছরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল। যেসব শিক্ষার্থী ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিয়ে পেয়েছিল জিপিএ-৫, গোল্ডেন জিপিএ-৫ আজ তারা ভর্তি পরীক্ষায় পাস মার্ক তুলতেই ব্যর্থ। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হচ্ছে- মাননীয় মন্ত্রী এখনো প্রকৃত সত্যকে মানতে নারাজ বরং তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতিকে ত্রুটিপূর্ণ আখ্যায়িত করেছেন যা একজন মন্ত্রীর কাছ থেকে মোটেও আশা করা যায়না।
মাননীয় মন্ত্রী, এখনো সময় আছে একটি দেশের প্রধান মেরুদণ্ড শিক্ষাকে নিয়ে আর রাজনৈতিক খেলা খেলবেন না। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হলে এ দেশের শিক্ষিত সমাজকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। তাই এ দেশকে বাঁচাতে হলে প্রশ্নপত্র ফাঁসরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিন। আপনিই যদি শিক্ষামন্ত্রী হয়ে প্রথমে এগিয়ে না আসেন তাহলে শিক্ষার শিক্ষা দেখবে কে?
মামুনুর রশিদ: শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক, গণিত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, mamunurrashidmiajee@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ২১৩৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ৪, ২০১৪