২০০৯ সালে কোপেনহেগেনের পর জাতিসংঘের উদ্যোগে আয়োজিত এবারের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সম্মেলন ছিল সবচেয়ে বড়। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মতো দেশগুলো এ সম্মেলনে কার্বন নিঃসরণের ব্যাপারে বেশ আশাব্যঞ্জক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
যখন জাতিসংঘভুক্ত দেশগুলো কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনতে একটি সুনির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়ার ব্যাপারে সমঝোতায় পৌঁছতে ব্যর্থ হয়, তখন এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এ সম্মেলনের ইতিবাচক ফলাফলের কথা ব্যক্ত করেছেন। এক বক্তৃতায় মুন বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে উদ্যোগ নেয়ার অঙ্গীকার করতে এত বেশি সংখ্যক নেতা এর আগে কখনো একসঙ্গে সমবেত হয়নি। ’
এ সম্মেলনে যেভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও চীনের মতো দেশ কার্বন নিঃসরণ কমাতে জোরকণ্ঠে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এর আগে কোনো সম্মেলনে তারা এতটা সোচ্চার হয়নি। যে কারণে এবারের সম্মেলনকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।
চীনের উপ-প্রধানমন্ত্রী জং গাওলি ২০২০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ কমানোর অঙ্গীকার করেছেন। জিডিপির হিসাব অনুযায়ী পার ইউনিটে ৪০ শতাংশেরও বেশি কার্বন নিঃসরণ করছে চীন। দেশটির ২০০৫ সালের কার্বন নিঃসরণের সঙ্গে তুলনা করলে এটি হবে ৪৫ শতাংশ।
জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর জন্য দায়ী কার্বন নিঃসরণ সম্পর্কে নিজেদের দায়িত্বশীল ভূমিকা সম্পর্কেও অবস্থান পরিষ্কার করেছে চীন। জং গাওলি বলে বলেছেন, ‘একটি প্রধান দায়িত্বশীল ও উন্নয়নশীল দেশে হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুর সমাধানে চীন বড় ধরনের উদ্যোগ নেবে। ’
একইসঙ্গে কার্বন নিঃসরণ কমাতে ২০২০ সাল পরবর্তী সময়ের জন্য একটি পরিকল্পনা প্রকাশ করবে বলে অঙ্গীকার করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। আগামী বছরের শুরুতেই এ পরিকল্পনা প্রকাশ করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। চীনকেও তিনি আহবান জানিয়েছেন। চীনকে উদ্দেশ্য করে ওবামা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে কার্বন কমানোর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। পাশাপাশি সবারই অবদান রাখা উচিত। তার মতে, ‘কেউ এককভাবে এগিয়ে যেতে পারে না’।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদও অঙ্গীকার করেছেন। ওলাঁদ বলেছেন, ফ্রান্স জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত গরিব দেশগুলোকে এক বিলিয়ন ডলার সহযোগিতা দেবে। এছাড়া ২০২০ সালের মধ্যে বনায়ণহীনতার অবসান ঘটাতে লাইবেরিয়াকে ১৪৭ মিলিয়ন ডলার সহযোগিতা দেবে নরওয়ে।
মনে রাখা দরকার, প্রথমবারের মতো চীন কার্বন নিঃসরণ কমাতে জোর পদক্ষেপের কথা জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও একই প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। বিশ্বেরে এই দুই পরাশক্তি যারা জলবায়ু পরিবর্তনে কার্বনের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী তাদের কাছ থেকে এর আগে কখনো এভাবে কোনো বক্তব্য আসেনি।
প্রায় ৪৫ শতাংশ কার্বন নিঃসরণের জন্য চীন ও যুক্তরাষ্ট্র দায়ী। এছাড়া ইইউ, ভারত, রাশিয়া, জাপান ও ব্রাজিলও বিপুল পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ করে যাচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। খুবই কম কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ; মাথাপিছু মাত্র ০.৪ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ করে। সে তুলনায় ভারত নিঃসরণ করছে শতকরা ১.৪, যুক্তরাষ্ট্র একাই ১৭.৩ এবং চীন ৫.৫ এবং জার্মানি ৯.৩ টন। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশ মারাত্মকভাবে বিশ্ব উষ্ণায়নের শিকার হচ্ছে।
এবারের এ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়কণ্ঠে ক্ষতিপূরণের দাবি তুলে বলেছেন, যাদের কার্বন নিঃসরণের ফলে বিশ্ব উষ্ণায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ তাদের কাছ থেকে তার ক্ষতিপূরণের দাবির অধিকার কখনো ছাড়বে না।
বিশ্বে প্রতিবছর কার্বনের মত মানব উৎপাদিত প্রায় ৪৯.৫ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হয়। এর প্রায় অর্ধেক শোষণ করে নেয় প্রকৃতি। সমুদ্র প্রতিদিন ৩০ মিলিয়ন টন কার্বন শোষণ করে। তবে এতে কার্বন থেকে নিঃসরিত এসিড সাগর ও মহাসাগরগুলোর জীববৈচিত্র্যের উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
অপরদিকে বিশ্ব উষ্ণায়ন কার্বন নির্গমনের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি সরাসরি দায়ী। জ্বালানির প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে যেমন উৎপাদনের বিষয় রয়েছে তেমনি রয়েছে জনসংখ্যার সম্পর্ক। কারণ জনসংখ্যার ঊর্ধ্বগতির কারণে জ্বালানি ও উৎপাদনের চাহিদা মারাত্মকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে জনসংখ্যা বর্তমান ৭০০ থেকে ৮০০ কোটি হয়ে যাবে। এতে জ্বালানি চাহিদা বাড়বে নিঃসন্দেহে। অন্যদিকে জীবাশ্ম ভিত্তিক জ্বালানি থেকেই তৈরি হচ্ছে কার্বন। ফলে একদিকে যেমন জনসংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে, জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন ও জ্বালানির চাহিদাও বেড়ে যাচ্ছে। এতে জীবাশ্ম জ্বালানিও এভাবে পাল্লা দিয়ে বেড়ে গেলে কার্বন নিঃসরণের অবস্থা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি আউটলুক জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি তথ্য প্রশাসন বলেছে, তারা আগামী ২০৪০ সালের মধ্যে বিশ্বে জ্বালানির ব্যবহার ৫২৪ কোয়াড্রিলিয়ন বিটু (জ্বালানি পরিসংখ্যান বিষয়ক ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট) থেকে ৮২০ কোয়াড্রিলিয়নে গিয়ে দাঁড়াবে। চীন ও ভারতসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর দ্রুত শিল্পায়নের জন্য বিশ্বের এই জ্বালানির অর্ধেকেরও বেশি প্রয়োজন। বর্তমান বিশ্বে নবায়নযোগ্য ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ থেকে জ্বালানি উৎপাদন হচ্ছে প্রতিবছর ২.৫ শতাংশ। কিন্তু প্রতিবছর জীবাশ্ম থেকে যে জ্বালানি উৎপাদিত হচ্ছে ২০৪০ সাল পর্যন্ত তা কমপক্ষে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত জ্বালানি সরবরাহ করতে পারবে।
অতএব ২১০০ সাল পর্যন্ত যদি এই জ্বালানি উৎপাদন অব্যাহত থাকে তাহলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেটেরও বেশি বেড়ে যাবে। বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যে এ নিয়ে কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। বিজ্ঞানীরা তাই পৃথিবীর তাপমাত্রা বর্তমানে ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেট পর্যন্ত নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কিন্তু সেজন্য তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি সেন্টিগ্রেটে সীমিত রাখতে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর কমপক্ষে ৪৪ গিগা টন কার্বন নিঃসরণ কমানো জরুরি।
লেখক : অধ্যাপক, ফলি রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও
সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ স্টাডি এন্ড রিসোর্স ইউটিলাইজেশনের পরিচালক
বাংলাদেশ সময় ১১০৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ১২, ২০১৪