ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

হরতাল বন্ধে আইন চাই

জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০২ ঘণ্টা, নভেম্বর ৫, ২০১৪
হরতাল বন্ধে আইন চাই ছবি: প্রতীকী

দিনের পর রাত আসে। রাতের পর দিন।

আর বাংলাদেশে দিন-রাতের পিছে পিছে আসে হরতালের পর হরতালের পর হরতাল। হরতালে-হরতালে দিন যায় রাত যায় এদেশের কোটি মানুষের। মানুষকে ভয়ে-দুর্ভোগে-উদ্বেগে-আতংকে ডুবিয়ে, অর্থনীতির বারোটা বাজিয়ে, দিনমজুর-শ্রমিকের পেটে লাথি মেরে, কারখানার চাকা বন্ধ করে চলছে হরতাল নামের সর্বনাশা ছলনার পাশাখেলা। হরতাল বাংলাদেশের মানুষের একমাত্র ললাটলিখন। বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে কতো শত-সহস্র হরতাল যে হয়েছে তার লেখাজোখা নেই। বন্দে আলী মিয়ার কবিতার মতো: ‘‘ফেউ নাকি চলে বাঘের পিছনে গাঁয়ের লোকেরা বলে’’-র মতো হরতালের সঙ্গে আসে যাবতীয় অশুভ-অরাজকতা। মানুষের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া এই হরতালীয় অন্যায়, এইসব বোমা ও ককটেলবাজি, খুনাখুনি, সংঘর্ষ-সংঘাত, এইসব ভয়াল-করাল সন্ত্রাস, গাড়িতে আগুন, ভাংচুর, ঢিল-পাটকেল। হরতালে-হরতালে ছয়লাপ আজ বাংলাদেশের রাজনীতি। যেন এক মগের মুল্লুক। যার যেমন খুশি। যেন ডালভাত-- কিছু হলেই ডেকে আনো হরতাল। যেন পাড়ার দোকানে পাওয়া সস্তার পান-দোক্তা। এই বদভ্যাস, এই হরতালের সেঁকো বিষ গেলানোর অদ্ভুতুড়ে ‘গণতান্ত্রিক বদভ্যাস’ থেকে মুক্তি নেই যেন আর।

যখন যা-খুশি তা-ই করবার খেলা। এক সর্বনাশা খেয়াল-খুশির নাম হরতাল। হরতাল দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো অর্থনীতির বারোটা বাজাচ্ছে; খেটেখাওয়া মানুষের আয় রোজগারের পথ বন্ধ করছে। আর মুখে বলছে গণতন্ত্রের কথা। ভয়াল হরতালকেই ‘গণতান্ত্রিক অধিকার’ বলে চালু করেছে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল; এ-যেনবা রাজনৈতিক মোল্লাদের দেওয়া কোনো অবশ্যমান্য ফতোয়া! মানতে হবেই হবে; না মানলেই দোররা, শাস্তি, পদে পদে কঠিন বিপদ! সিন্দাবাদের ভূতের মতো নাছোড় হরতাল সংস্কৃতি চেপে বসেছে গোটা জাতির কাঁধে। রাজনৈতিক দলগুলো যখন যা খুশি করছে। কিছু তাদের মনপুত না হলেই হলো! ব্যস, বলা নেই কওয়া নেই ডেকে বসবে হরতাল। দেবে দেশ অচল করার হুমকি; তারা হরতাল দেয় জ্বালাও পোড়াও করে আর নির্মম ঠাট্টার মতো উন্নয়নের গালভরা বুলি আওড়াতে আওড়াতে মুখ ফেনিল করে তোলে।

তারা চর্চা করছে ফ্যাসিবাদের আর মুখে ফেনা তুলছে ‘গণতন্ত্র গণতন্ত্র’ বলে। তাদের দাবিস হরতাল নাকি তাদের ন্যায্য  গণতান্ত্রিক অধিকার। বেশ তো, কিন্তু হরতাল না-মানার অধিকারও তো মানুষের আছে! কিন্তু সে অধিকার তারা মানতে নারাজ। ‘বিচার মানি  তবে তালগাছটা আমার’’—এটাই তাদের যুক্তি। কেউ যদি হরতাল না মেনে রাস্তায় নামে, কাজের ধান্দায় যদি বের হয় হতদরিদ্র শ্রমিক-মজুর-চাকুরিজীবী? সেক্ষেত্রে প্রাণ হাতে নিয়েই বেরোতে হবে তাদের। তাদের জীবন মরণ রাস্তার জল্লাদরূপে আবির্ভূত হরতালকারী দলগুলোর মারমুখি কর্মীদের হাতে। তারা গণতান্ত্রিক অধিকারের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে মানুষকে মারলে-কাটলে-খুন করলে-পোড়ালে-কোপালেও কারো বলার কিছু নেই। সবই ‘গণতান্ত্রিক অধিকার’ হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার চল এদেশে। রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের, মায় নেতা, তস্য নেতাদেরও সাত খুন মাফ। তাই প্রতিবার হরতালে চলে নৈরাজ্য আর অরাজকতা। প্রতিবারই হরতাল আহবানকারীদের আস্তিনের ভাঁজ থেকে, ঝোলা থেকে বের হতে থাকে গণতন্ত্র কায়েমের নানা ভয়ানক যন্ত্রপাতি---ককটেল, বোমা, পেট্রল, আগুন, গুলি-বুলেট, গজারি কাঠের লাঠি, গান পাউডার, দা-কুড়াল, ছুরি চাকু কিরিচ।

হরতালে যে বাসটি রওয়ানা হলো গন্তব্যে নারী-শিশু-যুবক-বৃদ্ধ-অফিসগামী মানুষ নিয়ে, সেই বাসটিতে বোমা মেরেও  হরতালকারীরা এদেশে রাজনৈতিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকারের চরম পরাকাষ্ঠা দেখাতে পেছপা হয় না, বুক এতটুকু কাঁপে না পিকেটাররূপী অমানুষের। মায়া, মমতা, ভালোবাসা, স্নেহ, করুণা---এসব কিছুই নেই এইসব মারমুখি ক্যাপার পিকেটারের অভিধানে। ওদের অভিধানে আছে কেবল কয়েকটা শব্দ---জ্বালাও, পোড়াও, কোপাও, মারো, রক্ত, হত্যা, বন্দু, গুলি, ঢিল-পাটকেল, বোমা-ককটেল। যুগের পর যুগ চলছে এসব; বাসে গান পাউডার ছিটিয়ে ভেতরের মানুষ পুড়িয়ে মারাও দেখতে দেখতে হয়ে গেছে ‘গণতান্ত্রিক অধিকার’। সত্যি কী বিচিত্র দেশ, সেলুকাস!

২৬ অক্টোবর রোববার সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দিয়েছিল ধর্মভিত্তিক সম্মিলিত ইসলামী দল।   হজ ও তাবলিগ নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করার দাবিতে তারা নরক গুলজার করেছে। সে হরতালের রেশ না ফুরাতেই আবার হরতাল –দফায় দফায়। এবার ডেকেছে একাত্তরের ঘাতকদের দল, মুক্তিযুদ্ধের সহিংস বিরোধিতাকারীদের দল, রাজাকার-আর বদর আল শামসদের সূতিকাগার জামায়াতে ইসলামী। আদালতের রায়, যুদ্ধাপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে পৃথিবীর ইতিহাসে স্বচ্ছতম, মানবিকতম, সুষ্ঠুতম আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে তাদের এই ধৃষ্ঠতা। এরা নির্বিচারে লাখো মানুষ হত্যা করেছিলো, করিয়েছিল একাত্তরে। আর এখন চার দশক পরও তারা টুঁটি টিপে ধরতে চাইছে বাংলাদেশের। তারা চায় পাকিস্তানের মতো অকার্যকর রাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশেও বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু করতে। বিচারালয়ের প্রতি শ্রদ্ধা তাই তাদের থাকার কথাও নয়। তাদের পেয়ারের পাকিস্তানই তাদের পরম আদর্শ। চরম ও ধারবাহিক অবিচারের মূর্ত প্রতীক এই পাকিস্তান দিনে দিনে নিজেরই কবর খননে ব্যস্ত; অকার্যকর রাষ্ট্রের তকমাটা নিজের জন্য চিরকালীন প্রাপ্য করে তুলছে জঙ্গীবাদের পৃষ্ঠপোষক পাকিস্তান। আর জামায়াতে ইসলামী নামের খুনে দলটির প্রেম আর আনুগত্য বাংলাদেশের প্রতি নয়, বরং তা ‘ধরার নরক’ পাকিস্তানের প্রতি। সবুজ শ্যামলিম বাংলার চেয়ে ‘‘পাক সার জমিন’’—এর মায়াতেই তারা সদা গদগদ। এজন্যই তারা বারংবার ঘোষনা দিয়েছে, বাংলাদেশকে তারা বানাতে চেয়েছে পাকিস্তান-আফগানিস্তান। কিন্তু তা তারা পারেনি, পারবে না কস্মিনকালেও। তবু ‘সারমেয়ের বাঁকা লেজ’ সহজে সোজা হয় না। একাত্তরের খুনীদের দল জামায়াতও বাঁকা পথ ছেড়ে কখনো সোজা পথে হাঁটবে না। গত চার দশকেও তারা সেই সদিচ্ছা দেখায়নি। তাদের অতীত কৃতকর্মের জন্য একটিবারও দু:খ প্রকাশ করেনি, ক্ষমা চায়নি। আজো তারা সারমেয়ের লেজই রয়ে গেছে।    

কিন্তু এভাবে আর কতো? জামায়াতের হরতালের পেছনে যুক্তি কি? একাত্তরের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের, ধর্ষণযজ্ঞের বিচারকেও না মানার এই ধৃষ্ঠতা রীতিমতো অমার্জনীয় অপরাধ! বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধে এই অবস্থানের জন্যও জামায়াতে ইসলামীকে বিচারের মুখোমুখি করা যায়; করা উচিতও। দল হিসেবে জামায়াতকে এজন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য করা উচিত। এই অহেতুক হরতাল ডাকার সংস্কৃতিকে ‘না’ বলবার সময় এসেছে। আর জামায়াতের জবাবদিহিতা দিয়ে, জবাবদিহিতায় বাধ্য করার মধ্য দিয়ে এর সূচনা হতে পারে।

এই সময়টা বছরশেষের নানা কর্মযজ্ঞ সম্পাদনের সময়। বিশেষ করে ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার সময়, পরীক্ষার প্রস্তুতির সময় এটা। এই সময়ে অন্যায় হরতাল ডেকে জামায়াত লাখো ছাত্রছাত্রী ও তাদের অভিভাবকদের নিরাপত্তাহীন করে তুলেছে, আতংকিত-সন্ত্রস্ত করেছে, উদ্বিগ্ন করেছে। এই টেনশনের কারণে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে, তাদের মনযোগের ব্যাঘাত ঘটছে, অনেকেরই এসব কারণে পরীক্ষায় আশানুরূপ ফললাভ হবে না। আর এর জের টানতে হবে তাদের সারাজীবন। এই যে ক্ষতি, ব্যক্তিগত ও সর্বজনীন ক্ষতিটা যারা দেশের ও দেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে, তার কোনো বিচার হবে না? কেন হবে না?

সরকার ও রাষ্ট্র ছাড়া বিচার তাহলে কে করবে? রাষ্ট্রের মুখপাত্র হিসেবে সরকার কতোকাল আর এইসব জুলুম-নৈরাজ্য চেয়ে চেয়ে দেখবে? নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন সরকারকে মানায় না। সরকারকে আন্তরিকভাবে জানান দিতে হবে আসলে সে কি চায়! সরকার যদি হরতালের নামের বাংলাদেশের রাজনীতির চিরদুষ্ট ক্ষতটি থেকে এর জনগণকে মুক্তি দিতে চায় তাহলে ‘বেড়ালের গলায় ঘণ্টা’ এবার বাঁধতেই হবে—হরতালরোধী কার্যকর উপায় নিয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে হবে। সরকার তা করতে পারে এ ব্যাপারে আইন করে। হরতালে কি কি করা যাবে বা যাবে না সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট ধারা সংযোজন ও তা চালু করে।

হরতালে গাড়ি  পোড়ালে তার ক্ষতিপূরণ, কারো অঙ্গহানি হলে তার ক্ষতিপূরণ আদায়ের ব্যবস্থা যেন থাকে সেই আইনে। যে দল বা জোট হরতালের সময় সন্ত্রাসী কাজ করবে সেইসব দল বা জোটের ভবিষ্যতে হরতাল ডাকার অধিকার কেড়ে নেবার বিধান রেখেও আইন করা যেতে পারে। খুন করলে যেমন দায়মুক্তি দেওয়া চলে না, তেমনি হরতালে গাড়ি পোড়ালে মানুষ পোড়ালে, সম্পদহানি করলেও যেন কোনো দল দায়মুক্তি না পায়। আইন একজন সাধারণ নাগরিকের জন্য যেমন, একজন রাজনীতিকের জন্যও  যেন হয় অনুরূপ। বিশেষ করে তার প্রয়োগের বেলায় যেন হয় সবার জন্য সমান। রাজণীতিকেরা যেন উপলব্ধি করেন –অন্তত প্রথমবারের মতো  যেন উপলব্ধি করেন –যে, আইনের চোখে সবাই সমান। আইনের সমান ও পক্ষপাতহীন, সর্বনিরপেক্ষ প্রয়োগ না হলে, অন্যায়ের গোড়ায় ধরে টান না দিলে বাংলাদেশ হরতালের দুষ্টচক্রে ক্রমাগত পাক খেতেই থাকবে। মুক্তি আর মিলবে না। কিন্তু অচলায়তন থেকে যে বের হয়ে আসতেই হবে। হরতালের গ্যাঁড়াকল থেকে বের হয়ে আসাটাই হোক রাজনীতি-সংস্কারের প্রথম ধাপ। এভাবেই বাংলাদেশকে একের পর এক ধাপ এগোতে হবে নিজের মুক্তির পথে। হরতাল দিয়ে হোক এর সুচনা। শুভস্য শীঘ্রম---দেরি করা চলবে না।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৮ ঘণ্টা,নভেম্বর ০৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।