ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনে নানান সংকট ।। জিয়া হাসান

উদ্যোক্ত/মুক্তমত | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ৬, ২০১৪
উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনে নানান সংকট ।। জিয়া হাসান ছবি: সংগৃহীত

পর্ব ২

আপনি চিন্তা করলেন, আপনার ৬ মাসের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লাগবে। সেক্ষেত্রে মনে করুন, আপনি নিজে বেতন নিলেন না, কিন্তু কোম্পানির স্টাফ খরচ যাবে মাসে দেড় লাখ টাকা হিসেব ধরে ছয় মাসে ৯ লাখ।



এরসঙ্গে আপনার পরিবহন খরচও যোগাতে হবে। তাতে একটা পিকআপ ভ্যান লাগবে। এতেও মোটামুটি ১০ লাখ টাকা খরচ হবে। এই পিকআপ আবার আপনাকে রাস্তায় পদে পদে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঠেকাবে,  আপনাকে ঢাকা মেট্রপলিটান পুলিশের একটা পাস নিয়ে সেই চান্দাবাজি ঠেকাতে হবে। এতেও আপনার যাবে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। লোকাল পুলিশের হাত-খরচ ও স্থানীয় প্রশাসন এসব ম্যানেজ করতেই আপনার প্রায় ১ লাখ থেকে ৫ লাখ ধরে রাখতে হবে। আপনি কি করছেন, কোথায় আছেন, কিভাবে করছেন তার অনেক কিছুর উপরে ভিত্তি করে এসব অর্থ যোগান দিতে হবে। আলোচনার সুবিদার্থে আমি ধরলাম ৫০ হাজার টাকা।

তাহলে মেশিন ৫০ লাখ, ইউটিলিটি এবং ল্যান্ড ১০ লাখ, লাইসেন্স ২ লাখ, ছয় মাসের বেতন ৯ লাখ, পিকআপ ১০ লাখ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ৫০ হাজার, চান্দা ৫০ হাজার, মোট ৮২ লাখ।

এখন আপনি মার্কেটে প্রডাক্ট নিয়ে যাবেন। মার্কেটে গিয়ে দেখলেন, পুরো মার্কেট চলে বাকির উপরে। গ্রামদেশে একটা কথা আছে, কাঁঠাল খেতে হয়, একটা মুখে, একটা হাতে, একটা চোখে বাংলাদেশের বাকির সংস্কৃতিটাও সে রকম। আপনাকে মার্কেটে থাকতে হলে আপনার প্রডাক্টের একটা  ব্যাচ দোকানে রাখতে হবে। একটা ব্যাচ রাখতে হবে স্টোরে এবং একটা ব্যাচ প্রডাকশনে।  

তাহলে মনে করেন, আপনার টার্গেট হলো আপনি ২০ লাখ টাকার প্রডাক্ট করবেন। আর তা থেকে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মুনাফা বা দুই লাখ থেকে তিন লাখ টাকা লাভ করবেন। কিন্তু দেখুন এতে আপনার এই বিশ লাখ টাকাতে খরচ হবে ৬০ লাখ টাকা। ২০ লাখ টাকা মার্কেটে, ২০ লাখ টাকার মাল স্টোরে আর ২০ লাখ টাকা স্টকে।

এর মধ্যে আপনার প্রথম ব্যাচের ২০ লাখ মার্কেট থেকে রিকভারি ধরে(যেটা আসলে হয় না) আপনাকে অবশ্যই ৪০ লাখ ইনভেস্টমেন্টের জন্য রাখতে হবে। তাহলে আপনার খরচ লাগবে ৮২ লাখ যোগ ৪০ লাখ, ১ কোটি ২২ লাখ টাকা।

এখন ১ কোটি ২২ লাখ টাকায় আপনি আপনার বেতন বাদে মাসে, লাভ পাবেন ২ লাখ। এর মধ্যে বেশ কিছু বাকি ‘ফেরত আসবে না’ ধরে নেয়ার পরও আরো অন্যান্য ঝুঁকিগুলোর কথা বাদই দিলাম। তবে যদি ব্যাংকে রাখেন তাতে আপনাকে এক কোটি বাইশ লাখ টাকা আমানত রাখতে হবে। এতে আপনি ১০ শতাংশ সুদে মাসে এক লাখ টাকা পেতে পারেন।  

এই এক লাখের জন্যে উদ্যোক্তা হিসেবে আপনি কেন এতো ঝুঁকি নিবেন। কারণ যদি এক কোটি টাকা আপনার থাকেও, কিন্তু  কোনো কারণে যদি আপনি ক্ষতির মুখে পড়েন, সফল না হোন, তাহলে তো  আপনার পরিবারের সকল সঞ্চয়সহ আপনাকে পথে বসতে হবে। আইন ও বিচার বিভাগের অনুপস্থিতিতে এই ধরনের ধরা খাওয়ার অনেক সম্ভাবনা আছে। যার ফলে আপনি কোনো মতেই মার্কেট থেকে টাকা তুলতে পারবেন না। এই ঝুঁকি আপনি ফাইনালি আর নিবেন না।

এজন্যই আমরা নতুন উদ্যোক্তা দেখি না। যাদের এক্সজিস্টিং বিল্ডিং আছে, অবকাঠামো আছে, নেটওয়ার্ক আছে তাদেরই বাড়ছে। কারণ এখানে অবকাঠামো, ট্রান্সপোর্টসহ অনেক খরচই তাকে করতে হয় না। সে এগুলো ইতিমধ্যেই করে ফেলেছে। তাকে শুধু এর বাইরে ইমেডিয়েট বা তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় পয়সাটুকু খরচ করলেই চলে।  

প্রাণ কোম্পানিকে দেখেন, একটার পরে একটা প্রডাক্ট তারা বাড়াচ্ছে। মার্কেটে এমন কোনো গ্রসার প্রডাক্ট নাই যে তারা প্যাকেজিং করে সেল করছে না। এই রকম আরো অনেক কোম্পানি দেখবেন, বড় করপোরেট। যাদের মার্কেটে অনেক প্রডাক্ট আছে। যা তারা একটার পর একটা প্রডাক্ট বাড়িয়েই যাচ্ছে।

মার্কেটের কাছে ২০ লাখ টাকার প্রডাক্ট খুব অল্প টাকা। কিন্ত এর জন্যে তাকে খাটাতে হচ্ছে দেড় দুই কোটি টাকা। যা একটা এসএমই সাইজের কোম্পানির পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে বাংলাদেশে কোন বিজনেসে আপনি ২০ লাখ টাকার প্রডাক্ট দিয়ে প্রতি লটে ১০ শতাংশ প্রফিট তুলে আনবেন? খুব বেশি প্রডাক্ট তো নাই।

যে কারণে বাংলাদেশে নতুন উদ্যোক্তা দাঁড়াচ্ছে না অন্ততপক্ষে ম্যানুফাকচারিং-এ। ওয়েব সাইটগুলোতে চাইনিজ মাল বিক্রেতা, প্যাকেজার, আর চালডাল.কম-গুলো বাদে নতুন উদ্যোক্তাদের নতুন প্রডাক্ট সার্ভিস  আপনি দেখেছেন? উত্তর হবে না। যা দেখছেন সব বড় বড় কোম্পানি, যার এই বাধা ও প্রয়োজনগুলো নাই।

কে ঝুঁকি নিতে পারে
বাংলাদেশে অনেক পরিবার আছে যারা জমি, পিতার ডিপিএস, মাতার গয়না ইত্যাদি বেছে ৪০-৫০ লাখ জোগাড় করতে পারবে।   এখন একটা নতুন উদ্যোক্তার যদি মেরে কেটে ৫০ লাখ থাকে, তবে তার এ-ই সম্বল। কিন্তু উদ্যোক্তা হওয়ার ঝুঁকি নিতে গিয়ে কোনোভাবে এই সম্পদ যদি তার চলে যায়, তার পরিবারকে পথে বসে ভিক্ষা করতে হবে। ফলে এই টাকা থাকলেও সে ঝুঁকি নিতে পারে না। বাংলাদেশে এ সমস্যার প্রাথমিক হলো উদ্যোক্তাবান্ধব পরিবেশের খুবই অভাব।  

অনেক বলবেন ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে।   ঋণ নিয়ে বাংলাদেশে ব্যবসা করে যার কোটি কোটি টাকা আছে তারা। তারা ব্যাংককে ব্যবহার করে। ব্যাংকগুলো নতুন উদ্যোক্তাদের ব্যাংক লোন দেয়ও না। আবার একারণে নতুন উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে ঋণও নেয় না। কারণ তারা জানে, এই লোন নিয়ে তা পরিশোধ করতে এর মাসিক ইন্সটলমেন্টও সে তুলতে পারবে না। এক কোটি ২২ লাখ টাকার মাসিক ইন্সটলমেন্ট হবে দেড় লাখ টাকার মতো যা তার প্রফিটের সমান।  

লেখক: প্রাবন্ধিক

বাংলাদেশ সময়: ১৩০৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।