ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

নো মোর কাশ্মীর ইস্যু, নিউ বাংলাদেশ ইন পাকিস্তান!!

ডঃ বিজন সরকার, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ৬, ২০১৪
নো মোর কাশ্মীর ইস্যু, নিউ বাংলাদেশ ইন পাকিস্তান!!

পাক-ভারতের ভূ-রাজনৈতিক এবং প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে জম্মু-কাশ্মীর এখনো প্রধান প্রতিবন্ধক। সমস্যাসঙ্কুল জম্মু-কাশ্মীরের সীমান্ত লাইন অব কন্ট্রোল বা এলওসি নামে পরিচিত।

বিশ্বের সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ সীমান্তের মধ্যে এটি অন্যতম এবং এই এলওসির দৈর্ঘ্য ৭৪০ কিলোমিটার। পারমাণবিক শক্তিধর দেশ দুইটির মধ্যে চারবার যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে এবং তিনটি যুদ্ধই হয়েছে জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে।

জম্মু-কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে দেশ দুইটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিভিন্ন ভূ-রাজনৈতিক কৌশল প্রণয়ন এবং নিজেদের আনুকূল্যে মেরুকরণের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি দেশ দুইটির আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও জম্মু-কাশ্মীর ইস্যুটি গুরুত্বপূর্ণ।  

ভারতের বর্তমান আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে জম্মু-কাশ্মীর একটি তাৎপর্যপূর্ণ ইস্যু হলেও স্বাধীন ভারতে অতীতের লোকসভা নির্বাচনে ইস্যুটির তেমন প্রভাব ছিল না। এই বছরের লোকসভার নির্বাচনে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের কাশ্মীর কেন্দ্রিক ভুল নীতির সমালোচনা করে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি বেশ সুবিধা পেয়েছে।

লোকসভার নির্বাচনের সময়েই বিজেপি ভারতের সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করবে বলে একটা প্রচারণা বিভিন্ন পর্যায়ে পরোক্ষভাবে চালিয়েছিল। উল্লেখ্য, জম্মু-কাশ্মীরের বাসিন্দারা দেশটির অন্যান্য অংশের চেয়ে আলাদা আইনে বসবাস করে, সংবিধানের ৩৭০ আইনের আওতায়। রাজ্যের সম্পত্তির মালিকানা, নাগরিকত্বসহ বেশ কিছু অধিকার ভারতীয় সংবিধান মেনে পরিচালিত হয় না।  
 
প্রধানমন্ত্রীর দফতর বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং জানালেন, মোদী সরকার ৩৭০ ধারা বাতিলের পরিকল্পনা করছে এবং এ নিয়ে জম্মু-কাশ্মীরের জনগণের সাথে কথা বলবে। এর প্রতিক্রিয়ায় জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ বলেন “৩৭০ ধারা বিলুপ্তি কাশ্মীরের জন্য বিপদজনক হবে এবং এই ধারা না থাকলে কাশ্মীর আর ভারতের অংশ থাকবে না”। জম্মু ও কাশ্মীরের বিরোধী দলের নেত্রী মেহবুবা মুফতিও জিতেন্দ্র সিংয়ের এই মন্তব্যের তীব্র নিন্দা জানান এবং জম্মু-কাশ্মীর আবারো ভাগ হতে পারে বলে হুমকি দেন।

ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি কাশ্মীর ইস্যুতে দুই ভাগে বিভক্ত। বিজেপিসহ ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদি রাজনৈতিক দলগুলো এই ধারাটির বিলুপ্তি চান। তাদের অনেকেরেই অভিযোগ, কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা এই ধারাটির অপব্যবহার করে পাকিস্তানি বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীকে সহায়তা দিচ্ছে। আবার উদারপন্থি কংগ্রেস ও বামদলগুলো এখনই এ বিষয়ে কথা না বলার জন্য সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে এবং অনেকেই এই ধারাটি অব্যাহত রাখার পক্ষে মত দিচ্ছেন।   

বিজেপির আদর্শিক অনুপ্রেরণায় ভারতের জনগণের মননে কট্টর হিন্দুত্ববাদি–জাতীয়তা বোধ গভীরতর হচ্ছে। উদারপন্থি কংগ্রেস ও বামদলগুলো গণ-মানুষের মননের পরিবর্তনকে রোধ করতে পারবে না বলেই মনে হয়। আরব বিশ্বের উগ্র ইসলামিক মূল্যবোধ এবং জঙ্গিবাদি তৎপরতা, প্রতিবেশী পাকিস্তানে ইসলামি মূল্যবোধ রক্ষার নামে ভারত বিরোধী জঙ্গি তৎপরতা, এমনকি বাংলাদেশেও ভারত বিরোধী রাজনীতি ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিতাড়নের রাজনীতি কট্টরপন্থি হিন্দুত্ববাদি বিজেপি, শিব-সেনা এবং আরএসএসের মত দলগুলোকে ভারতের সাধারণ মানুষের মনস্তত্ত্বে ঠাঁই করে নিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।

ভারতের প্রতি দশ জনের সাথে কথা বললে দেখবেন, পাঁচ  থেকে ছয় জনেই হিন্দুত্ববাদি জাতীয়তাবাদের পক্ষে। এই বাস্তবতায় সংবিধানে ৩৭০ ধারা কতদিন টিকে থাকবে, সেটি এখন বড় প্রশ্ন।

১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধের সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ীর পর প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নরেন্দ্র মোদী দুইবার জম্মু-কাশ্মীর সফর করলেন। এতে জম্মু-কাশ্মীর যে মোদী সরকারের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটি প্রকাশ পায়।
 
গত আগস্ট মাসে জম্মু-কাশ্মীরে দেওয়া এক ভাষণে পাকিস্তানকে প্রক্সি-ওয়ার না চালাতে মোদী আহ্বান জানিয়েছেন। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাত-উদ-দাওয়া (আমেরিকা এবং জাতিসংঘ নিষিদ্ধ করেছে) সহ অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনগুলি আইএসআইয়ের সহায়তায় ভারতে প্রবেশ করে যে হামলা চালায়, মোদী সেটির দিকেই ইঙ্গিত করলেন।  

কাশ্মীরে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মোদী মুসলিমদের মন জয় করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মোদীর দুইটি সফরের উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন করা। পাশাপাশি ১৯৮০ এবং ১৯৯০ দশকে কাশ্মীর ভ্যালি থেকে বিতাড়িত হিন্দু পণ্ডিতদেরকে পূর্ব পুরুষের ভিটে বাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের কথাও জানান।

অপর পক্ষে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কাশ্মীর ইস্যুটি ঐতিহাসিকভাবেই প্রাধান্য পেয়েছে। পাকিস্তানে ভারত বিরোধী রাজনীতি অনেকাংশে কাশ্মীর কেন্দ্রিক। পাকিস্তান এখনো ভারত-শাসিত কাশ্মীরকে নিজেদের অংশ এবং ইতিহাসের অমীমাংসিত অধ্যায় বলেই বিশ্বাস করে।

জম্মু-কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান প্রায় একই। এমনকি দেশটির নাগরিক সমাজের আদর্শিক অবস্থানও অভিন্ন। তবে ২০১৩ সালের মে মাসে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে দুটি বড় রাজনৈতিক দল ‘পাকিস্তান পিপলস পার্টি’ এবং নওয়াজ শরীফের মুসলিম-লীগ ভারত বিরোধী কার্ড খেলে নাই। অন্যদিকে ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক ইনসাফ, জামায়েত ইসলামসহ অন্যান্য সুবিধাবাদী এবং উগ্র ধর্মীয় রাজনৈতিক দল ভারত বিরোধী কার্ড খেলেছে হাত খুলে। উপজাতি অধ্যুষিত নর্থ ওয়েস্ট ফ্রন্টিয়ার প্রদেশ, নর্থ এলাকাতে ভারত বিরোধী কার্ড খেলে আশানুরূপ ফলও পেয়েছে।

নওয়াজ শরীফ ক্ষমতায় আসীন হয়ে জম্মু-কাশ্মীর ইস্যুতে এমন কোন রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেয়নি, যার ফলে পাক-ভারত আলোচনার পরিবেশের অবনতি হতে পারে। পাক-ভারত সম্পর্কের স্বাভাবিক অবস্থার প্রয়োজনিয়তা নওয়াজ শরীফ গভীরভাবেই উপলব্ধি করেছেন। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, জঙ্গিবাদের বিষাক্ত ছোবল থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে ভারতের সাথে সু-সম্পর্কের বিকল্প নেই। বিশেষ করে, দীর্ঘদিন সামরিক শাসিত পাকিস্তানে ধর্মের মোড়কে যে ভারত বিরোধী রাজনীতি বাজারজাতকরণ হয়েছে, তার কুফল আজ নিজেরাই ভোগ করছে। সারা বিশ্বে পাকিস্তানকে এখন জঙ্গিবাদের প্রধান রপ্তানিকারক দেশ হিসাবেই গণ্য করা হয়।

সেনাবাহিনী ও কট্টর ভারত বিরোধীদের আপত্তি উপেক্ষা করে নরেন্দ্র মোদীর অভিষেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নওয়াজ শরীফ। জম্মু-কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী হুরিয়াদ নেতাদের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও শরীফ সাক্ষাৎ করেন নাই। শরীফের এই সিদ্ধান্তটি পাক-ভারত সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলেও পাকিস্তানের ভারত বিরোধী গোষ্ঠী ও সেনাবাহিনীকে ক্ষেপিয়ে  তোলে।

দেশব্যাপী, বিশেষ করে জিন্নাহ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জঙ্গিদের হামলার পর সেনাবাহিনীর তেমন আগ্রহ না থাকা স্বত্বেও পাকিস্তানি সরকার বিশ্ব সম্প্রদায়ের চাপে জঙ্গি বিরোধী অভিযান শুরু করতে বাধ্য হয়। কিন্তু বেশি দূর আগাতে দেওয়া হয়নি। আইএসআইয়ের নির্দেশনায় কানাডা থেকে আমদানিকৃত ক্ল্যারিক তাহির-উল-কাদেরি এবং জামায়াতে ইসলামের আশীর্বাদ-পুষ্ট ইমরান খানের নেতৃত্বে আন্দোলনকারীরা নওয়াজ শরীফের ক্ষমতার ভিত নাড়িয়ে দেয়।
 
পাক-সেনাবাহিনী নওয়াজ শরীফকে শর্ত দেয়, দুটি বিষয়ে সেনাবাহিনীর উপদেশের বাইরে যাওয়া যাবে না। প্রথমটি জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে ভারতের সাথে আলোচনার প্রক্রিয়াতে এবং দ্বিতীয়টি কৌশলগত শক্তি জঙ্গি গোষ্ঠীর  বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করার সিদ্ধান্তে।  

সরকার বিরোধী আন্দোলনের সময় পাকিস্তানের হাইকমিশনার আবদুল বাসিতের সাথে হুরিয়ত কনফারেন্স নেতা মিরওয়াজ ওমর ফারুক দিল্লিতে দেখা করেন। উদ্দেশ্য পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও উগ্র-গোষ্ঠীকে খুশি করা। যেখানে নওয়াজ শরীফ ভারতে নিজের সফরের সময় দেখা করেননি, সেইখানে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন চলাকালে হুরিয়ত নেতাদের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যটি বেশ পরিষ্কার।

একই সাথে ২৬/১১ মুম্বাই হামলার প্রধান অভিযুক্ত হাফিজ সৈয়দকে ক্লিন চিট দিয়েছেন পাকিস্তানের আদালত। সাইদকে পাকিস্তানি সেনা-অফিসারদের সাথে উপজাতীয় এলাকাতে বন্যা দুর্গতের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করতে দেখা যায়। ভারতে নিয়োজিত পাকিস্তানের হাইকমিশনার বলেছেন, সাইদ এখন মুক্ত এবং সে যে কোন স্থানে প্রকাশ্যেই যেতে পারবে।

ভারত পাকিস্তানের এই ঘটনাগুলির প্রতিক্রিয়ায় জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে সচিব পর্যায়ের নির্ধারিত দ্বি-পাক্ষিক মিটিংটি বাতিল করে দেয়। এমনকি গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদানকারী মোদীর একশ ঘণ্টার মার্কিন সফরে পঞ্চাশটির মত কর্মসূচি থাকলেও নওয়াজ শরিফের সাথে সাক্ষাতের কোন কর্মসূচি ছিল না।  

জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে নওয়াজ শরীফ সাত মিনিটের ভাষণে কাশ্মীর ইস্যুটি বরাবরের মতই উত্থাপন করেন। নওয়াজ শরীফ নিজেও জানেন যে, বিশ্ব দরবারে এই ইস্যুটির গুরুত্ব কতটুকু। দেশের ভেতরকার রাজনীতি এবং ক্ষমতার জন্যই উত্থাপন করাটা অনস্বীকার্য ছিল।

আদালত হাফিজ সৈয়দকে ক্লিন চিট দেওয়ার পাঁচ দিন পর গত ২০ সেপ্টেম্বর মুলতানের এক সমাবেশে পিপিপির তরুণ নেতা বিলাওয়াল ভারতের  কাছ থেকে কাশ্মীরকে পুনরুদ্ধার করে আনবেন বলে ঘোষণা দেন। এই সময় পাশে ছিলেন প্রাক্তণ প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি এবং রাজা পারভেজ আশরাফ। ঘটনার পরম্পরায় এটি পরিষ্কার যে, পাকিস্তানের রাজনীতি কাশ্মীর ইস্যু থেকে বাইরে আসাটা দৃশ্যত অসম্ভব।

ভারত কূটনৈতিক দক্ষতায় পাক-ভারত মধ্যকার দ্বি-পাক্ষিক আলোচনা বাতিল হওয়ার দায় যৌক্তিকভাবেই পাকিস্তানের উপর চাপিয়েছে। তাছাড়া, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কাশ্মীর নিয়ে নয়, বিশ্বব্যাপী জঙ্গিবাদ এবং জলবায়ু নিয়ে উদ্বিগ্ন। জঙ্গিবাদের জন্য বিশ্ববাসীর এই উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার পেছনে পাকিস্তানের দায় অনেক। তাই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সাধারণ পরিষদে জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে কি বললেন, তা নিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায় অতীতের মতই এবারও কোন প্রতিক্রিয়া দেখাল না।    

বিশ্বব্যাপী আইএস, বোকো হারাম, আল কায়েদা, তালেবানের উত্থানের ফলে বিশ্ব সভ্যতা আজ হুমকির মুখে। বিশ্ব নেতৃত্বকে তা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে দেখা যাচ্ছে। পাকিস্তান জঙ্গি রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে আফগানিস্তানের চেয়েও এগিয়ে। আল কায়েদা, তালেবান, হাক্কানি নেট ওয়ার্ক, লস্কর–ই-তৈয়বার মত ভয়ানক জঙ্গি গ্রুপগুলো পাক-সেনাবাহিনীর কৌশলী স্বার্থেই ব্যবহৃত হচ্ছে। এমতাবস্থায় বিশ্ব সম্প্রদায় পাকিস্তানের তথাকথিত ঐতিহাসিক অমীমাংসিত বিষয় সমাধানের জন্য কেন এগিয়ে আসবে ? বিশ্ববাসীর কি দায় পড়েছে ?

অনেকেই আবার পাকিস্তানের এই অবস্থানকে নিয়ে হাস্যরস করেন। জঙ্গি হামলার কারণে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলতে কিছু নেই। সারা বিশ্বের গোয়েন্দারা বলে আসছে যে আল কায়েদা নেতা জাওয়াহিরি এবং তালেবান নেতা মোল্লা ওমর পাকিস্তানেই আছেন। অথচ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই জঙ্গিবাদকে মোকাবেলা না করে জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে রাজনীতি করাটা যে কেবল অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জন্য,তা বাইরের দুনিয়া ভাল করেই বুঝে।  

পাক-ভারত ছাড়া অন্য কোন দেশ, এমনি কোন পরাশক্তির কাছেও এই জম্মু-কাশ্মীর ইস্যুটির কৌশলগত মূল্য নেই। এমনকি এই ইস্যুটিতে পাকিস্তানের দুই বন্ধু-প্রতিম রাষ্ট্র আমেরিকা ও চীনের কোন কালেই আগ্রহ ছিল না। তাই পরাশক্তি দেশ দুইটি এই ইস্যুতে নিজেদের অবস্থান আজও স্পষ্ট করেনি।      

বিশ্বের বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতাও আগের মত নেই। ইচ্ছা করলেই জাতিসংঘে জম্মু-কাশ্মীর ইস্যুটিকে আলোচনার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া পাকিস্তানের পক্ষে সম্ভব নয়। সেই রাজনৈতিক শক্তি এবং গ্রহণযোগ্যতাও দেশটির নেই। জঙ্গিবান্ধব রাজনীতি ও জঙ্গি গোষ্ঠীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল হওয়ার ফলে পাকিস্তান বিশ্বব্যাপী ইমেজ সংকটে পড়েছে। তাছাড়া জম্মু-কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের এবং ভারতের ভিতরে গিয়ে হামলা পরিচালনা করার জন্য জঙ্গিদের সমর্থনের ফলে পাকিস্তান জম্মু-কাশ্মীরের ইস্যুটিতে আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে।  
 
শিংজিয়াং প্রদেশের জঙ্গিবাদি কর্মকাণ্ড বেড়ে যাওয়ায় চীনের ঘুম হারাম। তারা বিভিন্নভাবে এই জঙ্গিবাদের জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে আসছে এবং এর পেছনে মার্কিনীদের অর্থায়ন রয়েছে বলে অভিযোগ করছে। তাছাড়া চীন নিজেও কাশ্মীরের একটি অংশকে ভারত পাকিস্তানের মতই দখল করে নিয়েছে। একইভাবে, চীন শিংজিয়াং প্রদেশটি ১৯৪৯ সালে দখল করে নেয়। তাই চীনের তেমন কোন নৈতিক শক্তি নেই যে, জম্মু-কাশ্মীর ইস্যুটিতে পাকিস্তানকে সাহায্য করবে।

পাকিস্তান যে জম্মু-কাশ্মীরে plebiscite দাবি করে আসছে, তা বাস্তবায়িত হলে চীনের অভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতাবাদিতাও উস্কানি পাবে। যে চীন ইরাকে কুর্দিস্তান নামক নতুন রাষ্ট্রের বিরোধিতা করে আসছে, বাড়ির পাশে জম্মু-কাশ্মীরের স্বাধীনতার জন্য plebiscite এর পক্ষে কথা বলবে, তা অকল্পনীয়।  

একইসাথে সিনো-ইন্ডিয়া সম্পর্কটিও বিবেচনায় নিতে হবে। ভারতের নর্থ ফ্রন্টে চীনের সাথে সীমানা নিয়ে বিরোধ থাকলেও এই বিরোধের তুলনায় তাদের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আগামী দুই বছরে আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ১০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছুবে।
  
অতীতে আমেরিকা জম্মু-কাশ্মীর ইস্যুটিকে দ্বি-পাক্ষিক বিষয় বলে এড়িয়ে যেত। পাকিস্তান অনেক চেষ্টা করেও ইস্যুটিতে আন্তর্জাতিক ফোরামে গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে আমেরিকাকে পাশে পায়নি। তবে বর্তমান বাস্তবতায় আমেরিকা যে ভারতের চাপে জম্মু-কাশ্মীরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জঙ্গি মদদ বন্ধের বয়ান দিবে, তার জন্য হয়ত আর কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

ওবামার সাথে আলোচনায় মোদী বিশ্বব্যাপী জঙ্গি দমনে আমেরিকার দ্বিমুখী নীতি বাদ নিয়ে সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান পরিচালনার জন্য বলেছেন। তা না হলে জঙ্গিবাদকে যে পরাজিত করা সম্ভব নয়, তাও জানিয়ে দিয়েছেন। একইসাথে, ভারত যে আমেরিকার পরীক্ষিত কৌশলগত বন্ধু, তা আফগানিস্তানে প্রমাণিত বলে মোদী জানিয়েছেন। এখন আমেরিকা ভারতের নিরাপত্তার জন্য কতটুকু আন্তরিক, সেটির প্রমাণ সাপেক্ষে ভারত আমেরিকার সাথে সম্পর্ক আরও গভীরতর  করতে চায়।  

আমেরিকাও চায় ভারত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আরও সোচ্চার হোক। বিশ্বব্যাপী চীনের উত্থানকে রুখতে হলে ভারতের সাথে গভীর সম্পর্ক রাখা ছাড়া আমেরিকার কোন বিকল্প হাতে নেই। তাছাড়া এশিয়াতে আমেরিকার এলায়েন্স, বিশেষ করে জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে ভারতের সম্পর্কটি গভীরতর। এমনকি আমেরিকার নীতি নির্ধারকরাও চায় আগামীতে ভারত নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসাবে আসুক। ভারত সফরের সময় ওবামা তা স্পষ্ট করেই বলেছেন। তবে সিরিয়া এবং ইরানের ব্যাপারে ভারতের অবস্থান আমেরিকার অনুকূলে না হওয়ায় আমেরিকা কিছুটা হতাশ হয়ে পড়ে। ভারতের স্থায়ী সদস্যের বিষয়ে আর কোন বক্তব্যও তারা দেয়নি।  

মোদী সরকার জম্মু-কাশ্মীর ইস্যুতে আর ডিফেন্সিভ খেলবে না বলেই মনে হয়। বিজেপি, শিব সেনা এবং আরএসএসের উচ্চ পর্যায়ের নেতারা বিভিন্ন ফোরামে পাক-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে সেই রকম ইঙ্গিত দিচ্ছেন। এমন কি ভারতের গণমাধ্যমের বিভিন্ন আলোচনায় পাকিস্তানকে কিভাবে একাত্তরের ন্যায় আরেকটি শিক্ষা দেওয়া যায়, তা গুরুত্বের সাথে উঠে আসছে।  

মোদীর আমেরিকা সফরের সময় ভারতের কৌশল প্রণয়নকারীরা মার্কিন প্রশাসনের নীতি নির্ধারকের সাথে একের পর এক সভা করেছেন। ভারত-আমেরিকা সম্পর্কের উন্নয়নের বেলায় পাক-ভারতের ইস্যুগুলোতে আমেরিকা ভারতের অনুকূলে কি ভূমিকা রাখতে পারে সে আলোচনায় বেশি স্থান পায়। ভারতের বক্তব্য ছিল ‘ভারত চীনের চেয়ে পাকিস্তানকে নিয়েই বেশি চিন্তিত’।

ভারত পাকিস্তানকে ঘায়েল করার জন্য পাকিস্তানের ইমেজ সংকটটিকে ব্যবহার করছে। উত্তর কোরিয়ার ন্যায় পাকিস্তানকে বিশ্ব সম্প্রদায় থেকে আলাদা করার জন্য ভারত জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক বাস্তবতাও ভারতের অনুকূলে। পাকিস্তানের ক্ষমতা বিভিন্ন গোষ্ঠীর হাতে থাকায় দেশটি ভারতের গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের বিপরীতে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে সব সময়ই ব্যর্থ হচ্ছে।

ভারতের কৌশল নিরূপণকারীদের একাংশ এবং পাকিস্তান বিরোধী কট্টর রাজনৈতিক অংশটি বাংলাদেশের ন্যায় নির্যাতিত বেলুচিস্তানকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে চেষ্টা করছে বলেই মনে হচ্ছে। এমনি বিজেপির প্রাক্তণ ও বর্তমান আধ্যাত্মিক নেতারা বেলুচদের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেওয়ার জন্য ভারতের সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে পরামর্শ দিতে শুনা যায়। পাকিস্তানেরও অভিযোগ যে ভারতের সেনা গোয়েন্দারা বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহযোগিতা করছে।   

বেলুচিস্তানের সর্বস্তরের জনগণ স্বাধীনতার পক্ষে। পাকিস্তানের সরকারগুলোর প্রতিদিনের নিপীড়ন, নির্যাতন ও শোষণের ফলে বেলুচরা অসহায়। পাক-সরকারের হিসাবেই ১৯৭০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৮ হাজার বেলুচকে পাওয়া যায়নি। এমনকি আইএসআই বেলুচদের জাতীয়তাবাদী নেতা নওয়াব আকবর বুগতিকে গুলি করে হত্যা করে। বেলুচিস্তান পাকিস্তানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ হলেও সেই সম্পদ বেলুচের জন্য ব্যবহার করা হয় না। ঠিক পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণের মতই বেলুচদের অবস্থা।

বেলুচিস্তান আলাদা হলে ভারতের পাশাপাশি আমেরিকা ও ইরানেরও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা হয়। ইরানের স্বার্থটি কিভাবে রক্ষা হয় তা বিশ্লেষণ করা এই পরিসরে সম্ভব নয়। আরেকটি লেখা প্রয়োজন।

বেলুচিস্তানে রয়েছে চীনের বিশাল ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ। চীনের অর্থায়নে নির্মিত গুয়াদার সমুদ্র বন্দরের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার দায়িত্ব চীনের হাতে তুলে দেওয়াতে ভারত এবং আমেরিকার উদ্বিগ্নতা বেড়ে যায়। স্থানীয় বেলুচরা বিশ্বাস করে, চীন সেখানে একটি সামরিক ঘাটি নির্মাণের চেষ্টা চালাচ্ছে। কৌশলগত দিকে দিয়ে গুয়াদার গুরত্ব অনেক। এটি  দক্ষিণ এশিয়া, মধ্য এশিয়া এবং মধ্য প্রাচ্যের সংযোগস্থলে অবস্থিত। এটি ইরান সীমান্তের কাছে এবং হরমুজ প্রণালীর প্রবেশদ্বার এবং সেই প্রবেশদ্বার দিয়ে তেলবাহী জাহাজ চলাচল করে।   

বেলুচদের প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকাংশ চীনেই রপ্তানি হয়। বেলুচদের মধ্যে চীনা বিরোধী মনোভাব প্রকট। আমেরিকাকে এই পর্যন্ত বেলুচদের স্বাধীনতা নিয়ে কোন অবস্থান নিতে দেখা যায়নি। তবে ভারতের ক্রমবর্ধিষ্ণু চাপে কতদিন এই অবস্থান ধরে রাখতে পারে তাই দেখার বিষয়।

আরেকটি নিউ বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে স্থান পাওয়ার বহু ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা রয়েছে এবং এই বাস্তবতাগুলি পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক মেরুকরণে পাকিস্তানের জন্য যে কঠিনতর হবে, সেই রকম ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

ডঃ বিজন সরকার: গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, চন্নাম ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সাউথ কোরিয়া, bipoly3001@yahoo.com 

বাংলাদেশ সময়: ১৬১০ ঘণ্টা, নভেম্বর ৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।