ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

লেটার টু তারেক রহমান

মনোয়ার রুবেল, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ৬, ২০১৪
লেটার টু তারেক রহমান তারেক রহমান

জনাব তারেক রহমান,
আমরা যারা কলাম লিখি যেভাবে লিখি সেভাবেই লিখা শুরু করলাম। সালাম বা আদাব নয়, স্বভাবজাত আলোচনা-সমালোচনা টাইপ লেখার মতো করে লেখা।

সালাম আদাবের কমতির কারণে ইতিমধ্যে স্বজাতি সাংবাদিক ভাইরা সরকারি কতিপয় মন্ত্রীর চক্ষুশূল হয়েছেন। নেতারা গালাগাল দিয়েছেন। কিছুদিন আগে সমাজকল্যাণমন্ত্রী মহোদয় সাংবাদিকদের অত্যন্ত স্পর্শকাতর স্থানে আক্রমণ করা হবে বলে হুমকিও দিয়েছেন। আপনি নিশ্চয় আমাদের এই দুর্ভোগ সম্পর্কে অবগত। বিদেশে বসে দেশের সম্পর্কে খবরের অবগতি রাখেন  সে আমরা জানি। পত্রিকায় এবং ইউটিউবে দেশ ও দেশের মানুষের অবস্থা সম্পর্কে আপনার উদ্বেগ আমাদের নাড়া দেয়। দেশের বাইরে বসে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভাবছেন এটা অশ্রুসিক্ত করার মতো ঘটনা। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব সম্পর্কে আমরা আশাবাদী।

বিএনপি দশম জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে 'নতুন ধারার রাজনীতি' স্লোগান নিয়ে এগুচ্ছিল, তখন আমরা আশাবাদী হয়েছিলাম। সত্যি বলতে কি আমরা একটি নতুন ধারার রাজনৈতিক সংস্কৃতি পেতে যাচ্ছিলাম বলে মনে হচ্ছিল। আমরা ধরে নিয়েছিলাম নতুন ধারা হবে হানাহানি-রেষারেষিমুক্ত। যেখানে বিএনপি শান্তির বার্তা নিয়ে আসবে। রাজনৈতিক বক্তব্যের দোহাই দিয়ে আওয়ামীলীগকে বিএনপি নেতারা গালি দেবে না। শেখ মুজিবকে ছোট করে কিছু বলবে না। সাতই নভেম্বর জিয়ার মাজারে ফুল দেয়া হবে। ১৫ ই আগস্ট শেখ মুজিবের কবরেও রাষ্ট্রীয় সম্মান দেয়া হবে। যেহেতু আওয়ামীলীগ নেতারা নতুন ধারার কথা বলেননি। তারা পুরনো ধারাতেই থেকে যাবেন। বিএনপিকে গালি দেবেন মানুষ বিরক্ত হবে। তারা জিয়াউর রহমানকে গালি দেবে, মানুষ বিরক্ত হবে। তাদের ভোট কমবে। একসময় তারাও নতুন ধারার রাজনীতি করবে। তারা বিদ্বেষ ত্যাগ করে নমনীয় হবে। ভুল বুঝতে পারবে। অনুতপ্ত হবে।   শহীদ জিয়ার মৃত্যুর দিনটিকে দুঃখজনক স্মরণ করে আওয়ামীলীগ বিবৃতি দেবে। আওয়ামীলীগ বিএনপির মাঝে কোন্দল থাকবে না। দুদল দুদলকে ভালো কাজে ছাড়িয়ে যাবার প্রতিযোগিতায় নামবে। যে কারণেই হোক আমরা এই চমৎকার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলাম।

এরপর একটি অপ্রত্যাশিত নির্বাচন হলো। যা হয়েছে আমরা দেখেছি। বিএনপি যেহেতু নির্বাচন করেনি তারা তাদের নতুন ধারার রাজনীতির স্লোগান থেকে সম্ভবত সরে এলো। আমরা হতাশ হলাম।

তারেক রহমান,
আমরা আরো হতাশ হলাম গত কয়েক মাসে আপনার কিছু বক্তব্য শুনে এবং পড়ে। আপনি এসব বক্তব্যে শেখ মুজিবকে ইচ্ছে মতো গালাগাল করছেন। মনের মাধুরী মিশিয়ে উদ্ভট তথ্য সরবরাহ করছেন। কে বা কারা আপনাকে এসব বক্তব্য সরবরাহ করছে জানি না। তবে এসব বক্তব্য বা তথ্য যে আপনার নতুন ধারার রাজনীতির স্লোগানের সাথে যায় না সেটা বোধ করি আপনি জানেন না। এসব তথ্য বা বক্তব্য যারাই সরবরাহ করে থাকুক এগুলো বিএনপিকে হাস্যস্পদই করছে। আপনাকেও।

আপনি বলেছেন শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি থেকে অবৈধভাবে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। আপনি শেখ মুজিবকে অবৈধ বলেছেন।   আপনার প্রশ্ন ছিল ‘সংবিধান ছাড়া কিভাবে শেখ মুজিব রাষ্ট্রপতি থেকে প্রধানমন্ত্রী হয়’। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর এই মহান নেতা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন ভবিষ্যত রাজনীতির জন্য ভয়ের।   এতটা ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে আমাদের নেতারা রাজনীতি করছেন, এটা ভেবে আমরা তরুণরা ভয় পাচ্ছি। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা যখন মতামত দিলেন তখনই আপনার বক্তব্য অসাড় হয়ে গেল। ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম সেদিন রাতে টিভিতে বলেছেন- শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে ১১ ই জানুয়ারি ১৯৭২ এ "সাময়িক সংবিধান" তৈরি করা হয়। এই সাময়িক সংবিধানবলেই শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী হন।

বাংলাদেশ নতুন রাষ্ট্র হলেও কোথাও তাড়াহুড়া বা সাংবিধানিক অস্তিত্বের অনুপিস্থিতি ছিল না বা ব্যত্যয়ও ঘটেনি। এটাও রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্যও দারুণ আত্মতুষ্টির্। আপনার এই বক্তব্যের সূতা ধরেই জাতি সাময়িক সংবিধান কী জানল। আমরাও জানলাম। আমরা নগণ্য মানুষ। আমরা না জানলেও সমস্যা নাই। কিন্তু জানার অভাব যখন উপরের স্তরে দৃশ্যমান হয়, তখন সমস্যা।

সরকারী দলের একজন নেতা বলেছেন- তারেক রহমান এই বিষয়টি  যথেষ্ট না জেনে কথা বলেছেন। মূল্ ব্যাখ্যা শোনার পর অন্যদেরও এমন ধারণা হতে পারে- তারেক রহমান জানেন না। আপনি না জানলে মওদুদ সাহেব বা রফিক সাহেবকে জিজ্ঞেস করলে ভালো হতো। তারা আপনাকে আইনগত  ব্যাখ্যা দিতেন। তারা জানেন।

আপনি একই সভায় জিয়াউর রহমানকে প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দাবি করেছেন। এর আগেও আমি বা আমরা অনেকবার বলেছি রাষ্ট্র একটি কাঠামোর ভিত্তিতে চলে। এর দলিল থাকে, দস্তাবেজ থাকে। লিখিত রূপ থাকে। এখানে মুখের কথা মুখ্য নয়। রাষ্ট্রপতি বা মন্ত্রী কিভাবে হয় তার নির্দিষ্ট ব্যবস্থা রয়েছে। যুদ্ধকালীন সরকার কী, কিভাবে চলেছিল, তাদের কার্যক্রম কি ছিল, তারও একটা সাংবিধানিক স্বীকৃতি রয়েছে। স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসীন হন। তিনিও পূর্বোক্ত ইতিহাসে কাটছাঁট করেন নি। তার আমলেই রাষ্ট্রীয়ভাবে সরকারীভাবে সর্বপ্রথম স্বাধীনতার দলিলপত্র প্রকাশ হয়। সেখানেও এমন দাবি নেই। তবুও স্বাধীনতার এত বছর পর আপনার এমন দাবি কেন, সে-প্রশ্ন উঠেছে। কেউ আপনার এই বক্তব্যে বিভ্রান্ত নয়, তবে হতাশ। এই হতাশা আপনার তরুণ নেতৃত্বের প্রতি, তরুণ প্রজন্মের।   হতাশা 'নতুন ধারার রাজনীতিতে'।

গত কিছুদিন আগে আওয়ামীলীগের অপু উকিল নামে একজন নারীনেত্রী সংসদে বেগম খালেদা জিয়ার জাতপাত সম্পর্কে নোংরা ও অশালীন বক্তব্য দিয়েছেন।   সিদ্দিক সালিক নামে এক পাকিস্তানী মেজরের বইয়ে তিনি এসব তথ্য পেয়েছেন বলেছিলেন। সত্যি কথা হলো মেজর সিদ্দিক সালিক একটি বই লিখেছেন বটে। কিন্তু তার বইয়ের কোথাও খালেদা জিয়া শব্দটি পর্যন্ত নেই। নোংরা কাহিনী অনেক পরের ব্যাপার।   এই নোংরামিতে আওয়ামীলীগের দীনতা নিয়ে আমরা হাসলাম।

সর্বসম্প্রতি আপনার একটি বক্তব্যেও আমরা হাসলাম। আপনি লন্ডনে এক সেমিনারে বলেছেন শেখ মুজিবুর রহমান স্পিকার শাহেদ আলীকে পিটিয়ে হত্যা করেছেন। আবুল মনসুর আহমদের "আমার দেখা রাজনীতির ৫০ বছর" বইয়ে এসব তথ্য লেখা আছে, বলেছিলেন। পড়ে দেখলাম, আমার দেখা রাজনীতির ৫০ বছর বইয়ে ঘুনাক্ষরে আওয়ামীলীগ বা শেখ মুজিবকে দোষ দেন নাই। বরং তিনি সত্য লিখেছেন "আওয়ামীলীগের মন্ত্রীসভাকে সমর্থন করিতে গিয়া শাহেদ আলী নিহত হইলেন অপজিশনের ঢিল-পাটকেলে, অথচপূর্ববাংলার দুশমনেরা তখনও বলিলেন ও আজও  বলেন আওয়ামী লীগ শাহেদ আলীকে হত্যা করিয়াছে!!’ -আমার দেখা রাজনীতির ৫০ বছর, (পৃষ্ঠা ৪৩৭)
 
জনাব তারেক রহমান, আপনার কথা যদি অপু উকিলের মতো হয় আমরা আপনাকে আর অপু উকিলকে আলাদা করব কিভাবে?

আপনি আজও আবারো শেখ মুজিবকে গালাগাল করেছেন। বলেছেন- শেখ মুজিবের রাষ্ট্রদ্রোহের নাকি বিচার হওয়া উচিত!!!

আপনি কি নিজে বলছেন? না শুনে বলছেন? কোথায় কে কী বলল, কী শুনলেন, সেটাকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যাবহার করা আপনার উচিত কী?  কিছু বলার আগে আপনার উচিত সত্যতা যাচাই করা। বুঝতে পারছি বই পড়া কষ্টসাধ্য। তবু পড়া উচিত ।

এই যে সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বক্তৃতা দিলেন সেখানে ভুল রয়েছে। অসত্য রয়েছে।   এই অসত্যগুলো আপনাকে খাটো করছে। এসব তথ্য আপনাকে সরবরাহ করছে কে? আর একটা জিনিস মাথায় আসে না, আপনাকে কেন শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে বলতে হবে? স্বাধীনতাযুদ্ধের অন্যতম বীর যোদ্ধার সন্তান আপনি। আপনিই কেন দায়িত্ব নিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস বিতর্কিত করার? একটি দলের ভবিষ্যত-প্রধান হিসেবে ভ্রান্তির পরিবর্তে জাতিকে আপনার ঐক্যবদ্ধ করার কথা ছিল। সেই আপনি কেন বিতর্কিত করার দায়িত্ব নিলেন? কেন শেখ মুজিবকে গালি দিয়েই আপনাকে আলোচনায় থাকতে হবে? কেন আপনার মনে হলো শেখ মুজিবকে ছোট করতে পারলেই জিয়াকে বড় করা হবে? এটা কি দেউলিয়াত্ব না?  

মি. তারেক রহমান,
বর্তমান প্রজন্ম খুবই মেধাবী একটি প্রজন্ম। এই প্রজন্ম কারো কথা শুনতে চায় না। শুনলেও বিশ্বাস করতে চায় না। তারা পড়ে, যাচাই করে। তারপর নেতার অপরিপক্কতা দেখে উচ্চস্বরে হেসে ওঠে।

মেধাবী এই প্রজন্মের কারণেই রাজনীতিকদের রাজনীতি করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এখানে গালভরা গল্প-বক্তৃতানির্ভর রাজনীতির কোনো মূল্য নেই। অসত্য ও ভ্রান্ত তথ্যনির্ভর রাজনীতি এখানে অচল। সে কারণে মেধাবী এ প্রজন্ম অসত্য ও ভ্রান্ত তথ্যনির্ভর রাজনীতি অচল করে দিয়েছে।

বলা যায়- ‘তারা রাজনীতিবিদদের রাজনীতি করা জটিল করে দিয়েছে’ (They make politics difficult for the politicians)। জিয়াউর রহমান এটাই বোধহয় করতে চেয়েছিলেন।

ভালো থাকুন।

মনোয়ার রুবেল, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও কলামিস্ট, monowarrubel@yahoo.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।