ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

আওয়ামী লীগের ঘুণপোকা

মনোয়ার রুবেল, কনট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১৪
আওয়ামী লীগের ঘুণপোকা

একটি গ্রামীণ ধাঁধা বলি- কিচ্ছা মিচ্ছা নারকেলের ছুচা। পুলার বাপের চেয়ে পুলা আড়াই হাত উঁচা।

জিনিসটা কী?

এই ধাঁধার থিম হলো পিতার চেয়ে পুত্র বড়। প্রথম লাইনের সাথে ধাঁধার কোন সম্পর্ক নাই। এবার ভেবে বের করুন।

মাঝে মাঝে পিতার চেয়ে পুত্র বড় হয়। যেমন আওয়ামী লীগের চেয়ে ছাত্রলীগ বড়। রুপকার্থে অনেকে মেনে নেবেন ব্যাপারটা। বলবেন- যা বাড় বেড়েছে, বড়ই বলতে হবে। ব্যাপারটা তা না। ছাত্রলীগের জন্ম (প্রতিষ্ঠা) ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি। আওয়ামী লীগের জন্ম ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন। ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা হয় টিকাটুলির কেএমদাস লেনের রোজ গার্ডেনে। বয়সের দিক থেকে ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগের চেয়ে ৫৮৭ দিনের সিনিয়র।

(ধাঁধার উত্তর কি ছাত্রলীগ?)

ছাত্রলীগ যেহেতু সিনিয়র সংগঠন, আওয়ামী লীগ যেহেতু জুনিয়র, সেহেতু কেন ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের কথা শুনবে বাপু? তাদের অভিভাবক সংগঠন আওয়ামী লীগের কোন কথাতেই বেয়াড়া ছাত্রলীগের কিছু হচ্ছে না। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে আজকের দশম সংসদ পর্যন্ত সময়গুলোতে আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছে ছাত্রলীগের জন্য। সতি বলতে কি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তেমন একটা জোরালো নয়, দ্রব্যমূল্য অনেকটা স্থিতিশীল, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অন্য সময়ের চেয়ে ভালো, সমস্যা শুধু ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের ভেতর একটি ঘুণপোকার নাম হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগকে দুর্বল করছে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের বেপোরোয়া আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে ২০০৯ সালের ৪ এপ্রিল শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক প্রধানের পদ পরিত্যাগ করেন। দিন দিন সভ্যতা বিচ্যুৎ এই সংগঠন থেকে শেখ হাসিনা সরে গেলেও ছাত্রলীগের বোধোদয় হয়নি। বোধোদয় হয়নি এর নেতাদের। এরপরও পরোয়াহীন তারা। টেন্ডারবাজি, মারামারি, খুনোখুনি, ধর্ষণ, ছিনতাই, হেন কোন কর্ম নাই তারা করছে না বা অভিযোগ নেই।

আমার ধারণা, সমস্যা ছাত্রলীগের নেতৃত্বে। দুর্বল ও অযোগ্য নেতৃত্বই ছাত্রলীগের এই অস্তিত্ব সংকটের জন্য দায়ী। সংগঠনের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকরা সংগঠনের ব্যাপারে মনোযোগী নয় বলে আমার মনে হয়। বলনে এবং চলনে মনে হয় তারাই প্রকারান্তরে দুষ্টের লালন করছেন বা পরোক্ষভাবে উস্কে দিচ্ছেন। বিশেষ করে বেশ কিছু কেলেংকারীর পরে ছাত্রলীগ নেতৃত্বের দুর্বলতাই বেশী দেখা গেছে। সিলেটে এমসি কলেজ পোড়ানো, প্রশ্নপত্র ফাঁস, ঢাকায় বিশ্বজিত হত্যাকাণ্ডের পর উচ্চ নেতৃত্বের তেমন কোন পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। এই তিনটি ঘটনায় চরম নাজেহাল হয় সরকার।   সম্প্রতি যোগ হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) এর ঘটনা। শাবিপ্রবির ঘটনায় ছাত্রলীগের নাম আসায় ছাত্রলীগ সভাপতি বদিউল সোহাগ মিডিয়াকে দোষারোপ করেছেন। তার অভিযোগ, ছাত্রলীগকে জড়ানো হচ্ছে।

সমস্যার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা না করে এমন বক্তব্য কাণ্ডজ্ঞানহীন, সন্দেহ নেই। বদিউল আলম সোহাগ মিডিয়াকে দায়ী করে মৃদু বিষেদাগারও করেছেন। সোহাগের বক্তব্য কাণ্ডজ্ঞানপূর্ণ না হওয়াটা তার ক্যারিয়ারের জন্য হয়তো ভালো হতে পারে, কেননা আমাদের দেশে রাজনীতিতে উন্নতির জন্য কাণ্ডজ্ঞান মূল্যহীন। কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন লোকেরা খুব কমই রাজনীতিতে উপরে উঠেছেন। ধীর স্থির বলে পরিচিত সোহাগ হয়তো সে পথেই চলছেন। তবে ছাত্রলীগের জন্য ব্যাপারটা ভালো হয়নি।  

দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগের চলমান এ সমস্যা নিয়ে অনেকে লিখছেন, অনেকে বলছেন। আমরা বরং এই সমস্যা হতে উত্তরণের কী উপায় হতে পারতো সেদিকে যাই। ছাত্রলীগ নেতৃত্ব এইসব সমস্যা হতে উত্তরণের জন্য কী করেছেন? কেন্দ্রীয় নেতারা ক্ষমতা ভোগে ব্যস্ত আছেন, নাকি ছাত্রলীগের জন্য কোন পরিকল্পনা তাদের সত্যিই আছে- সেটা আমরা জানি না। সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদককে এখন টিভি পর্দায় টকশোতেই বেশী দেখা যায়। ভবিষ্যতে যদি আওয়ামী লীগে ডুবে যায় তবে এসব টকশো নেতাদের কদর বাড়বে, এটা নিশ্চিত। যেমন, এখন বিএনপিতে টকশো নেতা আর ব্রিফিং নেতারাই কাণ্ডারি, মাঠের নেতারা আউট অব ফিল্ড।

ছাত্রলীগ তাদের কর্মীদের সভ্য সমাজ মুখী করার কোন উদ্যোগ চোখে পড়ে না। তাদের বিজ্ঞান বা সাহিত্য বিষয়ক কোন নিয়মিত সার্বজনীন প্রকাশনাও নেই। থাকলেও কেউ পেয়েছেন বলে জানি না। তাদের প্রচার সেল সালাম নিন, শুভেচ্ছা নিন টাইপ পোস্টার ছাপাতে ব্যস্ত বেশী। এগুলোতেই নাকি বেশী লাভ। থানায়, জেলাতো দূরের কথা ঢাকা শহরে, কিংবা ঢাবিতেও ছাত্রলীগের পাঠচক্র জাতীয় কার্যক্রম নেই। কিন্তু এরা ছাত্র সংগঠন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ছাত্রলীগে ছাত্র বিষয়ক কোন কর্মকাণ্ড নেই। জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসির মতো ছাত্রদের উৎসব মুখর দিনগুলোতে তাদের বিশেষ কার্যক্রম থাকে না। অলিম্পিয়াড বা প্রতিযোগের মতো কোন কার্যক্রম নেই। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ছাত্রদের সহায়তায় বা পরামর্শের জন্য কোন সেলও নেই। ছাত্রলীগের ওয়েবসাইটের ছাত্র সহায়ক কোন তথ্য নেই। ছাত্র সংগঠনের ছাত্রদের সম্পৃক্ত করার জন্য ছাত্রবান্ধব কার্যক্রম থাকতে হয়। ছাত্ররা একটা সংগঠনের যুক্ত হবে যেটা তাদের আদর্শই শেখাবে না, তাদের জন্য সহায়কও হবে। যেটা এখন ছাত্রলীগের নেই। ছাত্রবান্ধব কার্যক্রম থাকলে নতুনরা উ‍ৎসাহিত হয়, সম্পৃক্ত হয়। অন্যথায় অ-ছাত্ররা সংগঠনে ভর করে। এরাই এখন ছাত্রলীগে আছে।

আরো একটা ব্যাপার করা যেতে পারে, সেটা হলো কর্মশালা বা প্রশিক্ষণ। সারা দেশে জেলা-উপজেলা হতে কর্মীদের ধরে এনে বিভাগীয় পর্যায়ে বা কেন্দ্রে নিয়মিত কর্মশালার ব্যবস্থা থাকা উচিত। এসব কর্মশালায় প্রবীণ ও তারকা নেতারা ক্লাস নিতে পারেন। মন্ত্রীরা আসবেন। ক্লাশ নেবেন। এমপিরা আসবেন। এতে কর্মীরা নীতি-নৈতিকতা শিখবে। উদ্দীপনা বাড়বে।

একটা কথা প্রায়ই শুনি, ছাত্রলীগ কর্মীরা কোন নীতি মানেনা। আমি বলি, ছাত্রলীগ কোন নীতি কথা জানেই না। তাদের নীতি কথা জানানো হয় নাই। কর্মীদের দোষ কী? সংগঠন থেকে তাদের নীতি শেখানোর কোন ব্যবস্থা করা হয়নি কখনো। তারা নীতিতে চলবে কিভাবে?

(ধাঁধার উত্তর দিয়ে যাই। উত্তর- পেয়াজ পাতা। )

লেখক: মনোয়ার রুবেল, অনলাইন এক্টিভিস্ট ও কলামিস্ট, monowarrubel@yahoo.com

বাংলাদেশ সময়: ২১০০ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।