ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

না, বাংলাদেশ মারা যায়নি!

মুহম্মদ জাফর ইকবাল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৪
না, বাংলাদেশ মারা যায়নি! মুহম্মদ জাফর ইকবাল / ছবি: সংগৃহীত

পত্রিকায় একটা খবরের শিরোনাম দেখে আমি রীতিমতো চমকে উঠেছিলাম। শিরোনামটি হলো: বাংলাদেশ হচ্ছে মৃতদের দেশ।



আমার চোখ কচলে শিরোনামটি দ্বিতীয়বার পড়তে হলো। ইংরেজি শিরোনামটির বাংলায় সঠিক অনুবাদ করলে তার অর্থ হয়- তারা ভয়ানক, বাংলাদেশ হচ্ছে মৃত চিন্তা ভাবনার দেশ।

আমি খুবই অবাক হলাম! এই দেশে আমি থাকি, খাই, ঘুমাই, দেশের খবরাখবর রাখার চেষ্টা করি। হঠাৎ কেমন করে দেশের সব রকম চিন্তা-ভাবনা মরে গেছে জানতেই পারলাম না।

আমি যখন খবরের ভেতরের ‍অংশ পড়ার চেষ্টা করলাম, তখন বুকে পানি ফিরে এলো। উক্তিটি একজন ব্রিটিশ লেখকের। লেখক তরুণ এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে তার এ রকম একটা মন্তব্য করার ‍অধিকার রয়েছে বলে মনে করেন। কারণ, তিনি বাংলাদেশি বংশোভূত (এ রকম একটা কঠিন শব্দ লিখছি বলে ক্ষমা চাই। কিন্তু আমি সঠিক শব্দটা লিখতে চাই। জিয়া হায়দার রহমান নামের এই তরুণ লেখকের পরিচয় দিতে তার সর্ম্পকে এই শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে। )

আমি দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ছিলাম। তাই বাংলাদেশ সম্পর্কে বলতে হলে কী ধরনের শব্দ চয়ন করে, কী ধরনের অসম্মানজনক কথা বলা, সেই সাথে ফ্যাশন এবং বৃদ্ধিজীবীদের আচরণ হয়, সেটি আমার থেকে ভালো করে কেউ জানে না।
 
আমি যে ১৮ বছর দেশের বাইরে ছিলাম তখন বাংলাদেশে অনেক ঘটনা ঘটেছে। সেটি আমাকে আহত করেছে। বিচলিত করেছে এবং ক্ষুব্ধ করেছে। কিন্তু দেশের বাইরে থেকে আমি একটিবারও নিজ দেশের সমালোচনা করিনি।

আমার মনে হয়েছে, দেশের বাইরে নিশ্চিন্ত নিরাপদ আরামে থেকে দেশের সমালোচনা করার আমার কোনো অধিকার নেই। যখন দেশে ফিরে এসেছি, তখনই আমার নিজের দেশের সমালোচনা করার অধিকার হয়েছে বলে মনে হয়েছে। তখন লেখালেখি করেছি। চেচামেচি করেছি। পথেঘাটে বসে থেকেছি। আন্দোলনে অংশ নিয়েছি (এখন এই দেশ আমাকে দু’চোখে দেখতে পারে না, সে রকম মানুষের সংখ্যা যে কোনো হিসাবে ঈর্ষণীয়!)। কিন্তু একজন মানুষ যদি বাংলাদেশি বংশোভূত হয় এবং মানুষটি যদি লেখালেখির জগতে খুব অল্প বয়সে অনেক সুনাম অর্জন করে থাকেন, তাহলে বাংলাদেশ সর্ম্পকে তার মন্তব্য সবাইকে হজম করতে হবে।

খবরের কাগজে দেখেছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্রছাত্রী এবং বড় বড় অধ্যাপকরা সেটা বেশ ভালোভাবে হজম করেছেন।

বাংলাদেশ হচ্ছে, চিন্তা-ভাবনার দেশ। এই শিরোনামের খবরের ভেতরের অংশ আমি পড়িনি। কান এবং চোখের মাঝে একটা খুবই মৌলিক পার্থক্য আছে। কানের কোনো পাতা নেই। তাই, কানের কাছে কেউ কিছু বললে সেটা না চাইলেও শুনতে হয়। চোখের পাতা থাকে। তাই, আমি যদি কিছু দেখতে না চাই, চোখের পাতা ফেলে চোখ বন্ধ করে ফেলতে পারি। তাই, জিয়া হায়দার রহমান নামের অত্যন্ত প্রতিভাবান এবং বিখ্যাত সেই তরুণ লেখকের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেই বক্তব্যটি আমি পড়ে দেখা প্রয়োজন মনে করিনি। চোখ বন্ধ করে পৃষ্ঠা উল্টিয়ে ফেলেছি এবং কিছুক্ষণের মধ্যে পুরো বিষয়টি ভুলে গেছি।

কিন্তু ডিসেম্বরের ৯ তারিখ প্রথম আলোতে শ্রদ্ধেয় সৈয়দ আবুল মকসুদের লেখা একটা প্রবন্ধ ‘চিন্তা চেতনায় মৃত বা বন্ধ্যা ভূখণ্ড’ দেখে আমি আবার চমকে উঠলাম! একই ধরনের শিরোনাম এবং এভাবে লেখক কোনো বিদেশি নন। লেখক আমাদের বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবী।

আমি লেখাটি পড়ে দ্বিতীয়বার চমকে উঠলাম। কারণ, এই লেখাটিতে পরিস্কারভাবে বলা হয়েছে, বিখ্যাত এবং তরুণ লেখক জিয়া হায়দার রহমান যেটা বলেছেন, সেটা সত্যি। আসলেই আমাদের দেশের চিন্তা-ভাবনা মরে গেছে, বাংলাদেশ চিন্তা-ভাবনা জন্ম দিতে অক্ষম একটি মৃত ভূখণ্ড!

আমি যাদের সাথে সময় কাটাই, তারা প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন চিন্তা-ভাবনা করেন। এখন তাহলে কি আমার বলতে হবে, তোমাদের চিন্তা-ভাবনা মৃত? তোমরা বন্ধুরা দেশের নিষ্ফল কারিগর! তোমরা এই দেশ পরিত্যাগ করে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করো। সেসব দেশে গিয়ে হোটেলে বাসন ধোয়ার ফাঁকে ফাঁকে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করো। কারণ, এই দেশে বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার কোনো স্থান নেই! চিন্তা-ভাবনার কোনো অস্তিত্ব নেই!

আমার মনে হলো, আমার আশেপাশে যারা থাকেন, তাদের এত কঠিন একটা কথা বলার আগে আমার সম্ভবত বিষয়টা  আরেকটু তলিয়ে দেখা দরকার। তখন আমাকে পুরনো পত্রিকা খুঁজে (ডিসেম্বর ২০০৪ ডেইলি স্টার) বিখ্যাত তরুণ লেখক জিয়া হায়দার রহমানের আসল বক্তব্যগুলো পড়তে হলো।

প্রথমে আমি ছোট একটা ধাক্কা খেলাম। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আধিপত্য চালিয়ে যাচ্ছেন দুজন মহিলা। নিজেদের যোগ্যতায় নয়, মৃত ব্যক্তিদের ছায়ায় (যে দেশে রাজা-রানী-রাজপুত্র-রাজকন্যা থাকে, সেই দেশের মানুষ যখন এ রকম কথা বলেন তখন আমি কৌতুক ‍অনুভব করি। যাই হোক, সেটা ভিন্ন কথা)। তবে দুই মহিলা কিংবা দুই বেগমের তত্ত্ব অবশ্য মৌলিক কথা নয়। পশ্চিমা দেশের পত্রপত্রিকা শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়ার প্রসঙ্গে কথা বলতে হলে এভাবে ব্যাখ্যা করে এবং পশ্চিমা পড়তে অভ্যস্ত মানুষ কিংবা বৃদ্ধিজীবীরাও এই ভাষায় কথা বলতে আরাম বোধ করেন। তারা নিশ্চয়ই ভাবেন এত বড় নামি-দামি পত্রিকা যেহেতু এই ভাষায় লেখে, সেটা নিশ্চয়ই ভুল হতে পারে না!

যাই হোক, আমি বিষয়টা একটু অন্যভাবে দেখানোর চেষ্টা করি। ধরা যাক, শেখ হাসিনার নাম ‘শেখ হাসান’ অর্থাৎ তিনি মহিলা নন পুরুষ, বঙ্গবন্ধুর কন্যা নন, বঙ্গবন্ধুর পুত্র সন্তান এবং খালেদা জিয়ার নাম ‘খালেদ রহমান’ অর্থাৎ তিনি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী নন। জিয়াউর রহমানের ভাই কিংবা অন্য কোনোভাবে সর্ম্পকযুক্ত একজন পুরুষ। ধরা যাক, এই দুইজন পুরুষ মানুষই একাধিকবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ধরা যাক, শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া যেভাবে পরস্পরের বিরুদ্ধে কথা-বার্তা বলেন, ‘শেখ হাসান’ এবং ‘খালেদ রহমান’ নামের এই দুজন কাল্পনিক পুরুষ প্রধানমন্ত্রী হুবহু একইভাবে কথাবার্তা বলেন। তাহলে কি ইকোনমিস্ট নামের বিখ্যাত পত্রিকা তাদের আচার-আচরণকে ব্যাখ্যা করার জন্য ‘দুই পুরুষের কর্মকাণ্ড’ এ রকম শব্দ ব্যবহার করতো?

বিখ্যাত লেখক জিয়া হায়দার রহমান এ রকম দুজন মানুষকে বোঝানোর জন্য ‘দুই পুরুষ’ শব্দটা ব্যবহার করতেন? কিংবা সৈয়দ আবুল মকসুদই কি তাদের দুইজনকে ‘দুই পুরুষ’ বলতেন?

আমি লাখ টাকা বাজি ধরে বলতে পারি, তারা এই দুজনকে ‘দুই পুরুষ’ কিংবা ‘দুই সাহেব’ বলতেন না। দুই প্রধানমন্ত্রী বলতেন।

কিন্তু শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া বোঝানোর জন্য বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে সবাই ‘দুই মহিলা’ বা ‘দুই বেগম’  শব্দ ব্যবহার করতেন। তাদের রাজনৈতিক পরিচয়, তাদের প্রধানমন্ত্রীত্ব কিছুই কারো চোখে পড়ে না। তাদের চোখে পড়ে যে, তারা দুজন মহিলা! একাত্তরে আমার বাবা মারা যাওয়ার পর আমার সাধাসিধে মা যদি আমাদের দায়িত্ব না নিতেন, আমরা কোথায় ভেসে যেতাম, জানি না! বিয়ে করার পর ‍আমি প্রথমবার একজন মহিলাকে কাছ দেখার সুযোগ পেয়েছি এবং মহিলাদের কী ধরনের শক্তি কিংবা সাহস থাকে টের পেয়েছি। কর্মজীবনে মহিলাদের সাথে কাজ করেছি এবং এখন অসংখ্য ছাত্রী এবং সহকর্মীদের দেখে মুগ্ধ হয়েছি!

আমি খুব ভালো করে জানি, টিটকারী করার জন্য ‘মহিলা’ শব্দটা আবিষ্কার করা হয়নি। তাই, যখন কাউকে (কিংবা বিখ্যাত সংবাদপত্র) দেখি একজন মানুষের হাজারটা পরিচয়ের মাঝে তার ‘মহিলা’ পরিচয়টা খারাপ কিছু প্রকাশ করার জন্য ব্যবহার করা হয়, তখন আমার মেজাজ খারাপ হয়। মেজাজ খারাপটা আমি নিজের ভেতরেই রাখি।

কিন্তু যখন দেখি, শ্রদ্ধেয় আবুল মকসুদের মতো মানুষেরাও একই কথা বলেন, তখন আমি এক ধরনের বেদনা অনুভব করি। আমার মনে হয়, মেয়েদেরকে জানানো উচিত সবাই এভাবে ভাবে না। অনেকেই তাদের প্রাপ্য সম্মান দিতে প্রস্তুত।

আমি বিজ্ঞানের ছাত্র। তাই, সোজাসুজি কথা বললে সেটা বোঝা আমার জন্য সহজ হয়। সংখ্যা দিয়ে কিংবা উদাহরণ দিয়ে কিছু বলা হলে সেটা ধরতে পারি; ঢালাওভাবে কিছু বলা হলে আমি একটু বিভ্রান্ত হয়ে যাই। বিখ্যাত তরুণ লেখক জিয়া হায়দার রহমান এবং শ্রদ্ধেয় আবুল মকসুদের লেখা পড়েও আমি একটু বিভ্রান্ত হয়েছি। কারণ, দুজনই পরিস্কারভাবে বলেছেন যে, তারা বাংলাদেশের ভবিষ্যতে বিন্দুমাত্র আলো দেখতে পাচ্ছেন না! (লেখায় এই অংশটুকু আমাকে কয়েকবার পড়তে হয়েছে, কোনো মানুষের পক্ষে এত নিশ্চিতভাবে একটা দেশ সর্ম্পকে এ রকম একটা ভয়ঙ্কর কথা বলা সত্যিই সম্ভব, যেটি নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হয়নি)

আমাদের দেশ সর্ম্পকে এ রকম একটি ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন হেনরী কিসিঞ্জার। যুক্তরাষ্ট্রের সব প্রচেষ্টাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়ে গেল, তখন হেনরী কিসিঞ্জার আমাদের দেশকে ‘ভবিষ্যতের তলাবিহীন একটি ঝুড়ি’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে খুব সমীহ করে চলে এবং নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন অনেকবার বলেছেন, সামাজিক সূচকের অনেক দিক দিয়ে বাংলাদেশ এখন ভারত থেকে অনেক এগিয়ে আছে। হেনরী কিসিঞ্জার কি এখন এই কথাগুলো জানেন!

যাই হোক, একটি দেশের ভবিষ্যতে ‘বিন্দুমাত্র আলো নেই’ এটি একটি অত্যন্ত কঠিন কথা। আমরা যারা বাংলাদেশে থাকি, বাংলাদেশের হৃদকম্পন শুনি, তারা জানি, এটি কিছুতেই সত্যি হতে পারে না। এই দেশের সমস্যার কোনো শেষ নেই। কিন্তু এ কথাটি পুরোপুরি সত্যি যে, কেউ বিশ্বাস করুক আর নাই করুক আসলে মাথা তুলে দাঁড়াতে যাচ্ছে বাংলাদেশ!

বিখ্যাত লেখক জিয়া হায়দার রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীদের সামনে ঘোষণা দিয়েছেন যে, বাংলাদেশ হচ্ছে, চিন্তা-ভাবনায় মৃত একটি দেশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী বা কোনো শিক্ষক সেটার প্রতিবাদ করে কিছু বলেছেন, সেটা চোখে পড়েনি। বরং শ্রদ্ধেয় আবুল মকসুদ সেই ছোট ঘোষণার পক্ষে অনেক বড় একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন স্কুলে ‘ব্যাখ্যা করো’ বলে গভীর জ্ঞানের একটা লাইন লিখে দেয়া হতো। আমরা শুরু করতাম এভাবে ‘আলোচ্য অংশটুকু অমুক লেখকের অমুক লেখা থেকে নেয়া হয়েছে। ’ তারপর সেই একটি লাইনকে অনেক ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বড় করে লিখতাম। শ্রদ্ধেয় আবুল মকসুদের লেখাটি পড়ে আমার হুবহু সেই কথাটি মনে হয়েছে। লেখাটি দেখে মনে হয়, কোনো একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ শ্রদ্ধেয় আবুল মকসুদকে দায়িত্ব দিয়েছেন। বিখ্যাত তরুণ লেখক হায়দার রহমানের দুই/তিনটি লাইনকে অনেক বড় করে ব্যাখ্যা করার জন্য এবং তিনি সত্যিকারের ভালো ছাত্রের মতো সেটাকে ব্যাখ্যা করেছেন।

একজন শ্রদ্ধেয় বুদ্ধিজীবী এভাবে একটা ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করলে অনেক তরুণ কমবয়সী ছেলে-মেয়ে সত্যিই সেটা বিশ্বাস করে ফেলতে পারে। তারা মনে করতে পারে, সত্যিই বুঝি বাংলাদেশে চিন্তা-ভাবনার জন্ম হয় না। সত্যিই বুঝি বাংলাদেশ চিন্তা-ভাবনার দিক থেকে মৃত এবং একটি বন্ধ্যা ভূখণ্ড। কাজেই আমার মনে হয়েছে, আমি নিজে এ ব্যাপারে কী ভাবি, সেটা একটু বলা দরকার।

আমি ১৮ বছর পাশ্চাত্য দেশে কাটিয়ে এসেছি। আমার নিজের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ অন্যরকম। ওই দেশগুলোতে আমার চিন্তা-চেতনা বিকাশের যেটুকু সুযোগ ছিল, আমার নিজের দেশে সেই সুযোগ তার থেকে ‍অনেক বেশি।

এই দেশে অসংখ্য মানুষ নতুন নতুন চিন্তা-ভাবনা নিয়ে কাজ করছে। আমি শুধুমাত্র আমার একান্ত নিজস্ব চিন্তা-ভাবনার একটা তালিকা দেই। প্রায় একযুগ আগে আমরা কয়েকজন ভাবছিলাম, আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা যেন আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে যেতে পারে, সে রকম একটা ব্যবস্থা করলে কেমন হয়! আমাদের সাথে যে তরুণ ছেলে-মেয়েরা কাজ করছে, তারা গণিত ‍অলিম্পিয়াডকে গণিত উৎসবে পরিণত করে সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়েছে। পৃথিবীর কোনো দেশে ক্লাস থ্রির বাচ্চাদের নিয়ে গণিত ‍অলিম্পিয়াড হয় না, আমাদের দেশে হয় এবং আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের কর্তাব্যক্তিরা আমাদের এই চমকপ্রদ আইডিয়ার কথা শুনে হতবাক হয়ে যান।

আমি আমার বিশ্বাবিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে কাজ করি। কয়েক বছর আগে তাদের বলেছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি রেজিস্ট্রেশনের যন্ত্রণা কমানোর জন্য মোবাইল টেলিফোনে এসএমএস করে পুরো প্রক্রিয়াটি কি শেষ করা সম্ভব? আমার বাচ্চা সহকর্মীরা এই দেশের মানুষের জন্য মোবাইলে ভর্তি রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা তৈরি করে দিয়েছে। এটি মৃত আইডিয়া নয়। বাংলাদেশের প্রায় সব স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন এই প্রক্রিয়া ব্যবহার হয়।

আমার সাথে যে সব ছাত্রছাত্রী কাজ করে, আমি যখন তাদের বলি, আমরা একটা ড্রোন বানাবো, তারা আমাকে ড্রোন বানিয়ে দেয়। যখন বলি, একটা রোবট বানালে কেমন হয়! তারা রোবট বানিয়ে দেয়। যখন বলি, পরীক্ষার খাতা দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি, তারা পরীক্ষার খাতা দেখা থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য অ্যাপস বানিয়ে দেয়। যখন বলি, দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য কি ব্রেইল তৈরি করা সম্ভব? তারা দ্রুত একটি সমাধান বের করে আনে। যখন বলি, পরীক্ষার প্রশ্ন পাস ঠেকাতে হবে; দেশের নানা ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েরা একশটা আইডিয়া নিয়ে পথে নেমে আসে।

আমি যাদেরকে নিয়ে সময় কাটাই, তারা আমাকে নতুন ‍নতুন কী আইডিয়া দিয়েছে, আমি সারাদিন ধরে বলে সেটা শেষ করতে পারবো না! যদি এই দেশের অন্যান্য মানুষের অভিজ্ঞতার কথা বলি, তাহলে সেটা কী বলে শেষ করা সম্ভব! কয়েকটা উদাহরণ কি দেবো?

গণজাগরণ মঞ্চের কথা মনে আছে! একজন যুদ্ধাপরাধীর রায়টি যথাযথ হয়নি বলে এই দেশের তরুণ সমাজ সম্মিলিতভাবে পথে নেমে এসে সারাদেশ নয়, সারা পৃথিবীতে কী রকম আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, তার কথা মনে আছে! সেটি কি চিন্তা-ভাবনার জগতে একটি বিপ্লবী ছিল না?

পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশ যুদ্ধাপরাধীর বিচার করার জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নেয়। আমাদের দেশে নিজেদের ট্রাইব্যুনাল তৈরি করে যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু করেছি। সেটি সারা পৃথিবীর জন্য ভবিষ্যতের একটা উদাহরণ হয়ে থাকবে না!

প্রফেসর ইউনূস তার নতুন নতুন চিন্তা-ভাবনা নিয়ে পৃথিবীকে চমৎকৃত করছেন না! তার চিন্তার ক্ষেত্রটি তো বাইরের কোনো দেশ নয়, আমাদের বাংলাদেশ। ঠিক সে রকম স্যার ফজলে হাসান আবেদ তার বিশাল প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের নানা কর্মকাণ্ড দিয়ে সবাইকে অবাক করে দিচ্ছেন না! সেটি কি গতানুগতিক কাজ নাকি নতুন চিন্তা-ভাবনার বাস্তবায়ন!

দেশের অসংখ্য এনজিও নিজেদের মতো করে কাজ করে যাচ্ছে, কত বিচিত্র তাদের আইডিয়া, কত আন্তরিক তাদের কাজকর্ম; সেগুলোর একটাও কি চিন্তা-ভাবনার জগতের একটা অবদান হিসেবে বিখ্যাত তরুণ লেখক জিয়া হায়দার রহমান বা শ্রদ্ধেয় আবুল মকসুদের চোখে পড়তে পারে না!

দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আমাদের নানা অভিযোগ। কিন্তু দেশের তিন কোটি ছেলে-মেয়ের হাতে বছরের প্রথম দিনে নতুন পাঠ্যবই তুলে দেওয়ার পরিকল্পনাটা কি নতুন আইডিয়া নয়! নানা রকম চেষ্টা-চরিত্র করে দেশের মেয়েদের দেশের ছেলেদের সাথে সমান হারে লেখাপড়া করানো কি চিন্তা-ভাবনার জগতে একটা অবদান মনে করে যায় না!

বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনী পৃথিবীর নানা দেশে শান্তিরক্ষা বাহিনী হিসেবে কাজ করে। এ রকম ‍অনেক দেশে বঙ্গবন্ধুর নামে রাস্তা তৈরি হয়েছে, এমনকি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে গ্রহণ করা হয়েছে। সেগুলো কি একটা ‘বন্ধ্যা দেশ’-এর পরিচয়?

পৃথিবীর কয়টা দেশে আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের গড়ে তোলা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মতো একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা নিয়ে অহংকার করতে পারবে! আর কত উদাহরণ দেবো!

আমি একবারও বলিনি, এই দেশের কোনো সমস্যা নেই। এই দেশে অসংখ্য সমস্যা আছে। অসংখ্য অবিচার-অনাচার, দুঃখ-কষ্ট, যন্ত্রণা আছে। দেশের অনেক কিছু নিয়ে আমাদের তীব্র ক্ষোভ আছে। অনেক জগদ্দল পাথর আমাদের বুকে চেপে বসে আসে। আমরা ঠেলে সরাতে পারি না। কিন্তু তার অর্থ নয়, আমাদের দেশ চিন্তা-চেতনায় মৃত একটি দেশ! একটি ‘নিষ্ফলা বন্ধ্যা দেশ’!

একজন মানুষ তার স্বপ্নের মতো বড়। একাত্তরের বাস্তবতায় বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু এই দেশের মানুষ সেই স্বপ্ন বুকে ধারণ করে অচিন্তনীয় আত্মত্যাগ করতে রাজি ছিল বলে আমরা একটা দেশ পেয়েছি।

আমার মতো ক্ষুদ্র একজন মানুষ এই দীর্ঘ জীবনে যতবার যা কিছু নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি, সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমি কেন তাহলে সেই সত্যটি উচ্চকণ্ঠে সবাইকে শোনাবো না! যাদের সেই স্বপ্ন দেখার শক্তি, সাহস বা ক্ষমতা নেই, তারা যদি অন্যদেরকেও স্বপ্ন দেখতে দিতে না চান, কেন তাহলে আমি প্রতিবাদ করবো না!

বাংলাদেশ সময়: ০০০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।