ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

নিউইয়র্কে তপন রায় চৌধুরীর সাথে কিছুক্ষণ ।। আদনান সৈয়দ

স্মরণ/মুক্তমত | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৪
নিউইয়র্কে তপন রায় চৌধুরীর সাথে কিছুক্ষণ ।। আদনান সৈয়দ

[তপন রায় চৌধুরীর সাথে দেখা হয়েছিল ২০১১ সালে নিউইয়র্কে মুক্তধারা আয়োজিত বইমেলায়।   ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে এই গুনি লোকটাকে আর কখনো দেখবো না।

তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি। ]

‘ক্ষেতে বর্ষা নেমেছে, হাঁটু অবধি জল, বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে দুই চাষী ধানের চারার রক্ষণাবেক্ষণ করছে। প্রথমের প্রশ্ন, ক দেহি, মহারাণী ভিক্টোরিয়া এহনকি করতে আছে? উত্তর, ‘হে কি আর আমাগো মতো? পানি নাবতেই পান্থাভাত খাইয়া কাঁথামুড়ি দিয়া উব্বুত। ’ অংশটুকু লেখক তপন বাবুর ‘রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তর পরচরিতচর্চা’ থেকে নেওয়া।

তপন রায় চৌধুরীকে পড়ে শুনাতেই তাঁর ঘন কাচাঁ-পাকা ভ্রু যেন আনন্দে নেচে উঠল। আর সেই সাথে চোখের তারায় আলোর নাচন। মনে হল চোখের পলকেই বুঝি তিনি বরিশালের কোনো গ্রামে চলে গেলেন। ভদ্রলোক যে খুব রসিক মানুষ সে কি আর নতুন কোনো কথা? বরিশালের ভাষায় একটা কথা বলেন আর সারা শরীর কাঁপিয়ে সে কি হাসি! নিউইয়র্কের বিকেলে সূর্য অনেক আগেই বিদায় নিলেও কেমন জানি একটা গরমের খাই খাই ভাবটা রয়ে গেছে। নিউইয়র্কে মুক্তধারা আয়োজিত বইমেলায় তপন রায় চৌধুরীর সাথে দেখা।

ভদ্রলোক হুমায়ূন, সমরেশ বা সুনীলের মতো জনপ্রিয় কোনো লেখক নন কিন্তু শিল্প-সাহিত্যের রসে তিনি যেন একেবারে টইটুম্বুর। ‘বাঙালনামা’ অথবা ‘রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তর পরচরিতচর্চা’ গ্রন্থগুলো তো এখনো বাঙালির মস্তিষ্কের কোষে কোষে বিচরণ করে। তবে এ কথা চোখ বুঝেই বলা যায় তাঁর সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ ‘বাঙালনামা’র জন্য পূর্ববাংলার মানুষের অন্তরে যেন তিনি একটু বেশি পরিমাণেই আদৃত হয়ে আছেন।

বইমেলায় আমার পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা এক ভদ্রলোক গলা খাকিয়ে বলেই উঠলেন, ‘দেখতে অইবো না, আমাগো বরিশালের পুলা... হেইয়া আমাগো তপন রায় না?’ বুঝলাম শুধু আমাদের বাঙালদের মধ্যে বিশেষ করে বরিশালের মানুষের চোখে তপন রায় চৌধুরীর জায়গা অনেক ঊর্ধ্বে। তপন রায় এই বিষয়টাকে কিভাবে ভাবছেন? ‘আপনি বরিশালের মানুষের জীবন-যাপন, ভাষার বিশেষ টোন, রাগ-ভালোবাসা, সুখ-দুঃখ সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমাদের পাতে তুলে দিয়েছেন। আপনি নিজেও একজন বরিশালের মানুষ। পড়াশুনা করেছেন বরিশাল জেলা স্কুলে তারপর কলকাতা দিল্লি ঘুরে বর্তমানে বিলেতে। আপনার স্কুল জীবনের এই ছোট্ট পরিসরে বরিশাল আপনার হৃদয়ে কতোটুকু জায়গা দখল করে বসে আছে?’

প্রশ্ন শুনে তিনি কিন্তু হঠাৎ করে চুপ হয়ে গেলেন। বেশ বুঝতে পারলাম কোথায় কোনো তারের সুরে তিনি যেন কিছুক্ষণের জন্যে আটকে পড়ে গেছেন। তারপর মাথাটা ধীরে ধীরে সোজা করলেন আর চশমাটা বার কয়েক মুছে এবার মুখোমুখি হলেন, ‘দ্যাখো, আমি বরিশালের একজন মানুষ হিশেবে গর্বিত। বরিশালের সেই সব স্মৃতিগুলো আমার জন্য শুধুই কোনো নাস্টালজিক বিষয় না। এই স্মৃতিগুলো আমার প্রতিদিনের জীবনের নিত্য খোরাক। আমি এই স্মৃতির মাঝেই প্রতিদিন বেঁচে আছি, বেঁচে থাকি।

একটা কথা বুঝতে হবে বরিশালের আলো-হাওয়ায় আমার শিরের শিরা-উপশিরায়। তাদের প্রতিদিনের জীবনের খুনসুটি, ইগো, যাই বল না কেন সব কিছুই কিন্তু আমি ধারণ করেই আমার এই যাপিত জীবন। আমার ছেলেবেলা কাটিয়েছি বরিশালে। আমার শৈশব স্মৃতি আমার জীবনের এক অমূল্য সম্পদ। তবে এ কথা ঠিক যে বরিশালের মানুষ নিয়ে কথা বললে এর শেষ করা যাবে না। শেরে বাংলা এক বিশাল মাপের মানুষ ছিলেন। তবে আমার মনে হয় অনেক বরিশালিরাই হয়তো এই বিশাল মাপের মানুষকে সঠিকভাবে চিনতে পেরেছিলেন। আগে বুঝতাম না এখন বুঝি যে শেরেবাংলা কতো দূরদর্শী ছিলেন। তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা বর্তমানে যেকোনো রাজনৈতিক নেতাদের মাঝে বিরল। তবে এ কথা ঠিক যে বরিশালের মানুষ সম্পর্কে জানতে হলে বুঝতে হবে তাদের মন আর মানসিকতা সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। তা না হলে অনেক ক্ষেত্রেই ভুল ধারণার জন্ম হতে পারে। যেমন একটা উদারহরণ দেই। আমার কাকা গেলেন কলকাতায়।

সেখানে তিনি কাপড় কিনবেন। কলাকাতার নিউমার্কেটে একটা দোকানে দোকানির সাথে তিনি কথা বলছেন। দেখা গেলো কাপড়ের দোকানদার তিনি নিজেও একজন বারিশালের মানুষ। আর যায় কোথায়? ঐ কাপড়ের দোকানদারও বুঝে ফেললেন যে, আমার কাকা বরিশালের মানুষ। তাদের মাঝে দর কষাকাষি শুরু হয়ে গেলো। কাকা জিজ্ঞেষ করলেন, ‘দাম কতো?’ দোকানির উত্তর ‘এতো’।

কাকা বললেন, ‘দাম এতো ক্যান?’ এই দামে তো নেওয়া যাবে না। ’দোকানীর উত্তর’ না নিলে না নিবেন, ‘ঠেকলাম কিসে?’ এই হলো বরিশালের মানুষের মন। একটা ইগো কাজ করে। আমরা যারা বরিশালের বিষয়টা আমাদের জন্য সহজ কিন্তু বাইরের অনেকেই হয়তো বিষয়টা ভুল বুঝতে পারে। যেমন ধরা যাক বরিশালের মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম সবসময় খুব উঁচু। মনে হবে বুঝি রোম সভ্যতার পরই বরিশালের স্থান। জোয়ান বুড়া সবাই বরিশালের নামি ব্যাক্তিত্বদের নাম মুখস্থ করে বসে আছে। তুমি একটু জিজ্ঞেশ করলেই সব মুখস্থের মতো বলে দেবে।

আরেকটা কথা বলবো, আমাদের সময়ে ছাত্র মহলে প্রেমে ব্যর্থ যুবকদের বেশ কদর ছিল। তাদেরকে কেমন জানি একটু হিরো হিরো মনে হতো। আর সে কারণেই বরিশালের সব যুবকরাই নিজেদেরকে রোমিও ভাবতো। বুকের মধ্যে ভালোবাসা বেঁধে চিঠির সাথে ইটের টুকরা বেঁধে প্রেমিকার উদ্দেশ্যে ঢিল দিতো। আর সে কখনো কখনো প্রেমিকার সামনে না পরে প্রেমিকার বাবার সামনে পরলে তো বুঝতেই পারো কি দুরাবস্থা! তবে আমরা সেই সব বীর যুবকদের নিয়ে গর্ব করতাম। বলতে গেলে প্রেম বিষয়টা বরিশালের একটা ঐতিহ্যের মধ্যেই পড়ে। একজন সফল প্রেমিকের ভাষায়, ‘হ্যারে দেইখ্যা তো’ পেরথমেই লাভে পড়িয়া গেলাম। হ্যার পর নদীর ধারে দুই দিন ‘ফলো’ করলাম। তিনদিনের দিন একটু আন্ধার হইতেই ফোকাস মারলাম। ’

বলার অপেক্ষা রাখে না উনার রসসমৃদ্ধ বাক্যবানে আমরা হেসে মাটিতে লুটোপুটি খাই আর কি। তপন রায় কিন্তু নির্বিকারভাবে তাঁর কথা বলেই যাচ্ছেন। শুধু থেমে থেমে তাঁর ঘন মোটা ভ্রু কেঁপে উঠছে। বেশ বোঝাই যাই তিনিও বেশ মজা পাচ্ছেন। ’
আচ্ছা তপন দা, ‘বাঙালনামায় আপনি দেশ ভাগ নিয়ে অনেক কথাই বলেছেন। তাছাড়া হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক নিয়ে অনেক কথা উঠে এসেছে। বিষয়টা নিয়ে আপনার মতটা আবারো আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই। ’ বরিশালের রস সমৃদ্ধ জীবন নিয়ে এতোক্ষণ আমাদের আলোচনা যে তা তা থৈ থৈ নৃত্যে চলছিলো এ ধরনের কঠিন প্রশ্নে আমাদের স্বাভাবিক কথাবার্তায় কোথায় যেন একটু ছেদ পড়লো। কিন্তু তপন বাবুকে মনে হলো এ ধরনের প্রশ্নের অপেক্ষায় তিনি যেন বসে ছিলেন।

‘দেখো, আমরা বলি বৃটিশরা হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে একটা বিবাদের দেয়াল তুলে দিয়ে গেছে। আমি কিন্তু এটা বিশ্বাস করি না। বৃটিশ আসার আগেও হিন্দু-মুসলমানদের সাথে সম্পর্ক খারাপ ছিল। আসল বিষয়টা হল ধর্ম মানেই এমন। আমরাটাই শ্রেষ্ঠ। তবে হ্যাঁ, এই ধর্মকে কেন্দ্র করে আমাদের সাম্য কতটুকু ব্যাহত হয়েছে সেটা হল কথা। আমি বলবো অনেকটুকুই। এই দেশ ভাগের কোনো ফসল আমরা পাইনি। দেশ ভাগের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে উত্তর ভারতের মুসলমানদের। এখনো পর্যন্ত মারামারি কাটাকাটি লেগেই আছে। আমি কিছুদিন আগে পাকিস্তান গিয়েছিলাম। ভাবতেই পারবেন না আমি সেখান থেকে কি যে ভালোবাসাটা পেয়েছি। একটা পাঞ্জাবীর দোকানে চা খাচ্ছিলাম। চা খাওয়ার পর এর বিল দিতে যাবো। এই দেখে পাঞ্জাবী চায়ের স্টলের মালিক আমাকে কিছুক্ষণ তিরষ্কার করলেন। তারপর চায়ের বিল দিতে আমাকে নিভৃত করলেন। আমরা তখন কেউ ভাবিনি যে আমি হিন্দু আর উনি মুসলমান। কথা হল সাধারণ মানুষের ভালোবাসায় কে হিন্দু আর কে মুসলমান এই সব নেই। ধর্মকে মানুষ ব্যবহার করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। আমরা এই সাধরণ মানুষরা কিন্তু এর করুণ শিকার ছাড়া আর কিছুই না। মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসাকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য এই ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে। এই সত্যটাতো একদম জলের মতোই পরিষ্কার। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৫১৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।