ঢাকা, শুক্রবার, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

শহীদ জননীর হাত ধরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ।। ফকির ইলিয়াস

যুদ্ধাপরাধ ইস্যু / মুক্তমত | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১৫
শহীদ জননীর হাত ধরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ।। ফকির ইলিয়াস

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী আজ ১৯ জানুয়ারি। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১৯৯২ সালের এই দিনে সংগঠনটি জন্ম নিয়েছিল।

তেইশতম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর এই দিনে মনে পড়ছে আজ অনেক স্মৃতি। অনেক কথা। শহীদ জননীর নেতৃত্বে এই কমিটি গঠিত হয়েছিল দুটি পৃথক কমিটির সমন্বয়ে। একটি ছিল ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন পরিষদ’ ও অন্যটি ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। ’

এই দুটি কমিটি একত্র করে গঠিত হয়—‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি। ’ কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয় শহীদ রুমীর আম্মা বেগম জাহানারা ইমামকে।

কমিটির যাত্রা শুরুর পরই, তৎকালীন ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’য় একটি আহ্বান ছাপা হয়। তাতে শহীদ জননী বহির্বিশ্বে এই কমিটির শাখা গঠনের আহ্বান জানান। যোগাযোগের জন্য দেওয়া ছিল ফোন নম্বর। আহ্বানটি দেখে আমি সে সপ্তাহেই নিউইয়র্ক থেকে ঢাকায় ফোন করি। কথা হয় শহীদ জননীর সাথে। তাঁর ‘একাত্তরের দিনগুলি’ পাঠ করে আগে থেকেই আমিও হয়ে পড়েছিলাম তাঁর সন্তান। তারও আগে সরদার ফজলুল করিম লিখিত ‘শহীদ রুমীর আম্মা ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ গ্রন্থটি পাঠ করে জেনে নিয়েছিলাম মহীয়সী এই নারীকে।

শহীদ জননী আমাকে দিক নির্দেশনা দিলেন। বলে দিলেন কিভাবে কী করতে হবে। আমি তখন টগবগে তরুণ। নিউইয়র্কে সংগঠন গড়ার কাজ আমার রপ্ত ছিল ভালোই। কাজে লেগে গেলাম। ফোনে কথা হলো অনেকের সাথে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদেরকে আহ্বান জানালাম। আমরা কজন তরুণ মিলে আহ্বান করলাম সভা। আব্দুর রউফ খান মিষ্টু, দেওয়ান শাহেদ চৌধুরী , নাজমুল হক হেলাল, চন্দন দত্ত, আবু তালেব, সালেহ আহমদ মনিয়া সহ একঝাঁক তরুণ আমার পাশে।

পর পর কয়েকটা সভা করলাম আমরা। প্রায় প্রতিদিনই কথা বলে নির্দেশনা নিলাম শহীদ জননীর কাছ থেকে। এলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতিকরা। যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি তখন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজন নুরুল ইসলাম অনু। সাধারণ সম্পাদক এম এ সালাম। জাসদ যুক্তরাষ্ট্র শাখার সভাপতি আব্দুল মোসাব্বির। এগিয়ে এলেন সবাই। অনু ভাই বললেন, আমরা আপনার পাশে আছি। ড. নুরুন নবী ও কাজী জাকারিয়াকে যৌথ আহ্বায়ক করে গঠিত হলো কমিটির যুক্তরাষ্ট্র শাখা। সদস্য সচিব করার জন্য আমার নাম প্রস্তাব করা হলো। আমি সবিনয়ে বললাম, আমি তরুণ। সিনিয়র কাউকে এ দায়িত্ব দেওয়া হোক।

সদস্য সচিবের দায়িত্ব দেওয়া হলো বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ফরাসত আলীকে। যিনি এখন এনআরবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান। আমাকে দেওয়া হলো সহকারী সদস্য সচিবের দায়িত্ব। আমরা কাজে নেমে পড়লাম। শুরু হলো না না লবিয়িং। ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় গণ আদালত বসল। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমরা একজন বিশিষ্ট আইনজীবী টমাস কে কিটিংকে পাঠালাম। তিনি গণআদালত প্রত্যক্ষ করার জন্য ঢাকায় গেলেন। এসে আমাদের সভায় বর্ণনা করলেন তার অভিজ্ঞতা। বললেন, সময় লাগবে। কিন্তু আমি প্রজন্মের মাঝে জাগরণের যে উন্মেষ দেখেছি, তা কেউ থামাতে পারবে না। আমেরিকায় ফিরে তিনি কাজ করতে শুরু করলেন আমাদের পক্ষে, বিভিন্নভাবে।

এক অসম সাহসের অধিকারিনী ছিলেন মা, জাহানারা ইমাম। তাঁকে আমি ‘মা’ ডাকতাম। তাঁর সাথে কাজ করার স্মৃতি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রেরণা। এই সেই জাহানারা ইমাম, যাকে ১৯৮১ সালে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান তার কেবিনেটে মহিলা বিষয়ক উপদেষ্টা বানাবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সে সময় অনেক বাম—ডানপন্থীরা জিয়াউর রহমানের সাথে যোগ দিলেও শহীদ জননী তা প্রত্যাখান করেছিলেন দৃঢ়তার সাথে। এই সেই জাহানারা ইমাম, যাকে দেশের মফস্বল এলাকার তরুণেরা চিঠি লিখে বলেছে, মা আপনি হুকুম দিন। নরঘাতক গোলাম আজমকে হত্যা করে আমি ক্ষুদিরামের মত হাসিমুখে ফাঁসিতে ঝুলব। এমন চিঠিপত্র সে সময় জাতীয় দৈনিকেও ছাপা হয়েছে।

গণআদালত বসার এক সপ্তাহ আগে নির্মূল কমিটির ঢাকা মহানগর শাখা ঘোষণা দিয়েছিল, গণ আদালতের কর্মসূচি সফল করার জন্য মৃত্যুঞ্জয় স্কোয়াড গঠন করা হবে। যারা নিজের জীবন দিয়ে হলেও এই কর্মসূচি সফল করবে। এই ঘোষণা পত্রিকায় ছাপা হবার পর প্রতিদিন শত শত তরুণ নির্মূল কমিটির অফিসে এসে নাম লিখিয়েছে। অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করেছে।

মনে পড়েছে, সেই বছরই অর্থাৎ ১৯৯২ সালে জাতিসংঘে ভাষণ দেবার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদ জিয়া নিউইয়র্কে এলে, আমরা হাজারো প্রবাসীরা প্লাজা হোটেলের সামনে থমকে দিয়েছিলাম তার গাড়ীর বহর। তুষারপাত উপেক্ষা করে, তীব্র প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে ছুটে এসেছিলেন বাঙালিরা—আমেরিকার বিভিন্ন
অঙ্গরাজ্য থেকে।

পিছন ফিরে তাকালে আমরা দেখব—সর্বপ্রথম ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শহীদ পরিবারের সদস্যরা মিলিত হয়ে মিছিল সহকারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে স্মারকলিপি প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি দালাল আইন (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশ জারি করেন। এরপর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করে দেন। একই ধারা অব্যাহত রাখেন বেগম খালেদা জিয়া। মনে পড়ছে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ দিতে এলে একজন সাংবাদিক হিসেবে উপস্থিত থাকার সুযোগ আমার হয়েছিল। আমি বেগম জিয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘শহীদ জননী বেগম জাহানারা ইমাম জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠন করেছেন। তিনি ঘাতক-দালাল রাজাকারদের বিচার দাবি করছেন। আপনার সরকার খুনিচক্রের হোতা গোলাম আযমের বিচার করছে না কেন?’ প্রশ্নটি শোনার পর তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন খালেদা জিয়া। তিনি বলতে থাকেন, ‘জাহানারা ইমাম কে? গণআন্দোলন করার তিনি কে? তিনি কী করেছেন দেশের জন্য?’ আমি আমার প্রশ্নের উত্তর চাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। তিনি তা এড়িয়ে যান। অথচ আমরা জানি এবং চিনি জাহানারা ইমামকে! শহীদ রুমীর আম্মা জাহানারা ইমাম একাত্তরে কী করেছেন, তার সাক্ষী ‘একাত্তরের দিনগুলি। ’

আমার খুব মনে পড়ে, শহীদ জননীই সর্বপ্রথম বলেছিলেন তরুণ প্রজন্ম চাইলেই এই বাংলার মাটিতে ঘাতক দালালদের বিচার হবে। হ্যাঁ, এই তরুণ প্রজন্মই তা চেয়েছে এবং সে কারণেই মহাজোট সরকারকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েছিল। মহাজোট সরকার যে কাজটি শুরু করেছিল, যা ছিল একটি জাতির নবযাত্রা। দায় মোচনের কাজটি শুরু হয়েছে। তা অব্যাহত রাখতে হবে। আমরা জেনেছি, প্রথম বিচারের রায়ের দিন মাননীয় ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, বাংলাদেশের বিচারিক ইতিহাস ও ট্রাইব্যুনাল-২-এর জন্য এ এক ঐতিহাসিক দিন, যেদিন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা প্রভৃতি আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার করে প্রথম রায় দেওয়া হচ্ছে। নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের ফসল এই বাংলাদেশ। ওই নয় মাসে এ দেশে ভয়াবহ ও লোমহর্ষক অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল।

বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এই প্রজন্মকে শাণিত করেছে। যেসব যুদ্ধাপরাধী এখনও বিচারের অপেক্ষায় আছে, তাদের বিচার দ্রুত সম্পন্ন করা দরকার—সে দাবি এই প্রজন্ম করেই যাচ্ছে। কারণ জাতি জেনে গিয়েছে, জাতি বুঝে গিয়েছে, কারা এসব যুদ্ধপরাধীদের বিচার করবে। আর কারা এদেরকে মন্ত্রী বানিয়েছিল। শহীদ জননী তাঁর লেখা শেষ চিঠিতে জাতির কাছে আবেদন রেখে গেছেন তা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতার এক অমর দলিল। পড়া যাক আবারও সেই চিঠিটি।
 
‘সহযোদ্ধা দেশবাসীগণ,
আপনারা গত তিন বছর একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমসহ স্বাধীনতাবিরোধী সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছেন। এই লড়াইয়ে আপনারা দেশবাসী অভূতপূর্ব ঐক্যবদ্ধতা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। আন্দোলনের শুরুতে আমি আপনাদের সঙ্গে ছিলাম। আমাদের অঙ্গীকার ছিল লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত কেউ রাজপথ ছেড়ে যাব না। মারণব্যাধি ক্যান্সার আমাকে শেষ মরণ কামড় দিয়েছে। আমি আমার অঙ্গীকার রেখেছি। রাজপথ ছেড়ে যাইনি। মৃত্যুর পথে বাধা দেবার ক্ষমতা কারও নেই। তাই আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি এবং অঙ্গীকার পালনের কথা আরেকবার আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই। আপনারা আপনাদের অঙ্গীকার ও ওয়াদা পূরণ করবেন। আন্দোলনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে থাকবেন। আমি না থাকলেও আপনারা আমার সন্তান-সন্ততিরা-আপনাদের উত্তরসূরীরা সোনার বাংলায় থাকবেন। এই আন্দোলনকে এখনও অনেক দুস্তর পথ পাড়ি দিতে হবে। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, মুক্তিযোদ্ধা, নারী, ছাত্র ও যুবশক্তি, নারী সমাজসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষ এই লড়াইয়ে আছে। তবু আমি জানি জনগণের মত বিশ্বস্ত আর কেউ নয়। জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। তাই গোলাম আযম ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের দায়িত্বভার আমি আপনাদের, বাংলাদেশের জনগণের হাতে অর্পণ করলাম। অবশ্যই, জয় আমাদের হবেই। — জাহানারা ইমাম।
 
আজ জাহানারা ইমাম নেই। কিন্তু তার স্বপ্ন চোখে আজও জেগে আছে বাংলার কোটি কোটি মানুষ। তিনি যে চেতনার জাগরণ ঘটিয়ে গেছেন—তা কোনওদিন ম্লান হবার নয়। আবারও বলি, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের রেখে যাওয়া পতাকা এই প্রজন্ম বয়ে যাবেই। কারণ তিনি একটি মৌলবাদহীন, জঙ্গিমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ এই প্রজন্মের জন্য রেখে যেতে চেয়েছিলেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৬১০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৯, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।