ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

প্রথম পর্ব

বিএনপি ডুবছে কেন?

মনোয়ার রুবেল, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২৫ ঘণ্টা, জুন ১২, ২০১৫
বিএনপি ডুবছে কেন?

গণতন্ত্রের স্বার্থে বিএনপির টিকে থাকা দরকার। কেননা শক্তিশালী বিরোধীদল না থাকলে সরকার নীতিভ্রষ্ট ও বেপরোয়া হয়।

 

নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে উত্থিত দল বিএনপি এতদিন দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে থাকলেও সম্প্রতি তারা অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। কেউ তাদের ডুবন্ত শক্তি হিসেবে বিবেচনার স্পর্ধাও দেখাচ্ছেন। বিএনপি টিকে থাকবে কী-না এনিয়ে ব্যাপক তর্ক করা যায়। তবে সেটা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে না পারা, ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও কার্যকরী আন্দোলনে না যেতে পারাসহ বহুবিধ কারণে বিএনপি বাহ্যত নিঃস্ব একটি দলে পরিণত হচ্ছে। ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকার পরও এ অধঃপতনের কারণ অনুসন্ধানে বিএনপি মনোযোগী হয়নি কখনও। বিএনপির নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে এ নিয়ে এক ধরনের জড়তা কাজ করে। আমার মনে হয়, তাদের এখন আত্ম বিশ্লেষণের প্রয়োজন।   আমার এ লেখায় চেষ্টা করেছি বিএনপির এ বিপর্যয়ের কারণ বিশ্লেষণের।

মূল কারণ কয়েকটি হলেও প্রধান ও প্রথম কারণ নিজেদের ‘আত্মপরিচয় বিস্মৃতি’।

সম্প্রতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে সাবেক বিএনপি নেতা বদরুদ্দৌজা চৌধুরী খোদ খালেদা জিয়ার সামনে বিএনপির আদর্শচ্যুতি নিয়ে কথা বলেছেন। ফাঁস হওয়া এক টেলিফোন আলাপে মওদুদ আহমেদকেও বলতে শোনা যায়, বিএনপি জিয়াউর রহমানের আদর্শ থেকে দূরে সরে গেছে। বিএনপি শুধু জিয়ার বিএনপি থেকেই দূরে সরে যায় নি, বিএনপির কাছ থেকেও বিএনপি দূরে সরে গেছে।

এর কারণ আসলে কী? এর কারণ হচ্ছে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে অতি সম্পৃক্ততা। আমরা যখন বিএনপির কোনো নেতা বা কর্মীর সঙ্গে আলোচনা করি, তখন দেখি তারা এক ধরনের দ্বৈত অবস্থানের মধ্য দিয়ে যায়। আমরা দেখি তারা নিজেদের আংশিক জামায়াত, আংশিক বিএনপি হিসেবে নিজেদের অবস্থানকে দেখে থাকে। এটা যে তারা ইচ্ছা করেই করছে তা নয়। ব্যাপারটা তাদের মস্তিষ্কে ঢুকে গেছে। সাঈদী-নিজামীর  বিরুদ্ধে কিছু বলা হলে বিএনপির সমর্থকদের প্রতিবাদ করতে দেখা যায়, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কিছু বলা হলেও বিএনপির সমর্থকদের প্রতিবাদ করতে দেখি। তারা আলাদা করতে পারে না কোনটা তাদের বিষয়, কোনটা জামায়াতের। স্বতন্ত্র আত্মপরিচয়ের আদর্শিক যে শক্তি, বিএনপির সেটা ভেঙে গেছে। একটি দল যখন আদর্শ হারায় তখন সে স্রোতে টিকতে না পেরে তলিয়ে যায়।

জামায়াতের দীর্ঘকালীন সংস্পর্শে বিএনপির এ ক্ষতিটুকু হয়ে গেছে। সেটার জন্য এখন একটিই উপায়-- বিএনপিকে জামায়াতের বগল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিএনপিকে জামায়াত থেকে বেরিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধীদের তীব্র সমালোচনা করে নিজেদের অবস্থান খোলাসা করতে হবে। একক ও স্বতন্ত্র দল হিসেবে বিএনপির নিজেদের প্রতিষ্ঠা তবেই সম্ভব হবে। যখন জামায়াত থেকে বিএনপি নিজেকে আলাদা করে নেবে, বিএনপির নেতাকর্মীরা যখন জামায়াতসহ স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠীর সমালোচনায় মুখর হবে এবং এ চর্চা অব্যাহত রাখবে, তখন তারা  নিজেদের আসল পরিচয় বুঝতে পারবে। কর্মীরা তখন শিখতে পারবে এটা ‘আমাদের কথা আর ওটা জামায়াতের কথা। ’

২০০১ সালে বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে ভোটের জোট করে। জামায়াতে ইসলামী জোটে গিয়ে ক্ষমতায় যেতে সাহায্য করলেও দীর্ঘ সময়ে তারা বিএনপিকে গিলে নিয়েছে। জামায়াতি মিডিয়ার শিখিয়ে দেওয়া যুক্তি ও বুলি বিএনপির কর্মীরা অনুকরণ করেছে বিনা দ্বিধায়, অবলীলায়। যেটা আসলে হওয়ার কথা ছিল না। ইতিহাস বলে, নব্বইয়ের দশকে গণতান্ত্রিক যুগের সূচনালগ্নে বিএনপির জামায়াতবিরোধী একটা ইমেজ ছিল। ১৯৯২ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল নেতা রিমু হত্যাকাণ্ডের পর সংসদে দাঁড়িয়ে জামায়াত-শিবিরের মতো স্বাধীনতাবিরোধী সন্ত্রাসী শক্তিকে নিষিদ্ধ করার আহ্বান করেছিলেন বিএনপির অনেক শীর্ষ পর্যায়ের নেতা।   তখন স্বাধীনতার স্বপক্ষে দাঁড়িয়েই কিন্তু বিএনপি তাদের শিকড় দ্রুত প্রসারিত করতে পেরেছিল।

সেই কাজটি এখন আবার করতে হবে। বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকে তার নেতাকর্মীদের জানান দিতে হবে, বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। জামায়াতের রাজনীতিক আদর্শে বিএনপি বিশ্বাস করে না। বরং জামায়াতের আদর্শকে বিএনপি ঘৃণা করে (আদর্শ ঘৃণা করেও কিন্তু জোট হয়)। বিএনপিকে তার নেতাকর্মীদের বলতে হবে, বিএনপি উগ্রবাদী দল নয়। বিএনপি মৌলবাদ পছন্দ করে না, তথাকথিত ধর্মভিত্তিক রাজনীতিও করে না। জিয়াউর রহমানও সেটাই বলেছেন।

১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে এক কর্মীসভায় দেওয়া জিয়াউর রহমানের বক্তব্য:
“কোনো রাজনৈতিক আদর্শ ধর্মকে ভিত্তি করে হতে পারে না। একটা অবদান থাকতে পারে। কিন্তু ধর্মকে কেন্দ্র করে কখনোই রাজনীতি করা যেতে পারে না। অতীতে আমাদের অভিজ্ঞতা হয়েছে যে ধর্মকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান সময়ে যখনই রাজনীতি করা হয়েছিল সেটা বিফল হয়েছে। কারণ ধর্ম ধর্মই। আমাদের অনেকে আছে যারা আমাদের দেশে যে বিভিন্ন ধর্ম রয়েছে, সেগুলোকে কেন্দ্র করে রাজনীতির পরিবেশ সৃষ্টি করতে চেষ্টা করেন। রাজনীতির রূপরেখা বানাতে চেষ্টা করেন, আমরা বারবার দেখেছি তারা বিফল হয়েছেন। ধর্মের অবদান থাকতে পারে রাজনীতিতে, কিন্তু রাজনৈতিক দল ধর্মকে কেন্দ্র করে হতে পারে না। এটা মনে রাখবেন, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। " বই- তারেক রহমান : অপেক্ষায় বাংলাদেশ । অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমেদ)

বিএনপি এসব গুরুত্বপূর্ণ কথা এখন ভুলে গেছে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে কিছু বললে জামায়াত নাখোশ হয় কী-না সেই ভয়টাও বিএনপির মধ্যে কাজ করে। জামায়াতের খুশি অখুশিতে বিএনপি বিলীন হয়েছে।

-মনোয়ার রুবেল, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও কলামিস্ট
ইমেইল-monowarrubel@yahoo.com

বাংলাদেশ সময়: ১৪১০ ঘণ্টা, জুন ১২, ২০১৫
জেএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।