ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

আন্তর্জাতিক পাবলিক সার্ভিস ডে

সুশাসন ও সেবা: নথি হারানোর যন্ত্রণা

মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০৬ ঘণ্টা, জুন ২৩, ২০১৫
সুশাসন ও সেবা: নথি হারানোর যন্ত্রণা ছবি: প্রতীকী

হাসিনা খাতুন তার মৃত স্বামীর অবসরোত্তর পাওনার জন্য গত ৩ বছর ডিপিডিসি অফিসে হন্যে হয়ে ঘুরছেন। তার স্বামী সাবেক ডেসার’ কর্মচারী, মারা যান ২০১৩ সালে।

৩ বছর ধরে নথির গতি রুদ্ধ, কারণ প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট নেই। অনেক কান্না ঝরিয়েও ফাইলে গতি আসছে না।

ডেসা’র মহাখালীর গোডাউনে হাজারো নথির স্তুপে বন্দি হয়ে আছে তার নথি। কিন্তু প্রত্যাশিত ডকুমেন্ট খুঁজে পাওয়া গেল না। অবশেষে পঞ্চগড়ে লোক পাঠিয়ে ইউএনও’র মাধ্যমে ডকুমেন্ট সংগ্রহ করলাম। তাতেও সুফল মিলছে না। ৩০ বছর পর কর্তৃপক্ষ বলছে, তিনি ৩৩ বছর বয়সে চাকরিতে যোগদান করেন। চাকরি বিধিমতে, চাকরিতে যোগদানের সর্বশেষ বয়সসীমা ৩০ বছর।

অবশেষে রেকর্ড সংশোধন করে নথির প্রাণ ফিরিয়ে আনা হলো। তিন মাসের প্রাণান্তকর প্রয়াসে (অনেকটা যুদ্ধ করে) নথিটি নিষ্পত্তি করে হাসিনা খাতুনের হাতে অবসরোত্তর পাওনা আট লাখ টাকা তুলে দিলাম গত ফেব্রুয়ারি (২০১৫) মাসে।

ডেসার অবসরপ্রাপ্ত এক কর্মচারী হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায়। ২১ বছর চাকরি করে ২০০৮ সালে অবসর নিয়েছেন। তার সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র, সহধর্মিনী হাসপাতালের নার্স। তার চিকিৎসা ব্যয় মেটানো হচ্ছে জমি বিক্রি করে, ঋণ নিয়ে এবং স্ত্রীর বেতন থেকে। ২০০৭ সাল থেকে অবসরপ্রাপ্ত এ কর্মচারীর পাওনার জন্য ৮ বছর ঘুরছে তার পরিবার। কি অবিশ্বাস্য অমানবিকতা! কর্তৃপক্ষ বলছে, তার সার্ভিস রেকর্ড মিসিং হয়েছে। এখন তারা কোথায় যাবে? কে নেবে এর দায়িত্ব?

এভাবে অগণিত নথিপত্রের স্তুপে হারিয়ে গেছে চাকরিজীবী মানুষের অধিকার। নথির গতিহীনতা সিন্দাবাদের দৈত্যের মত চেপে বসে আছে আমাদের ওপর। নথি নিষ্পত্তিতে যা’ যা’ প্রয়োজন, তা’ সব থেকেও যেন কিছু নেই, আছে শুধু আন্তরিকতার অভাব। অফিসে অফিসে পুরানো নথিপত্রের স্তুপ যেন বিশাল আস্তাকুঁড়। নথিগুলো ধুলার পুরু আস্তরণে ঢাকা। বিজ্ঞানসম্মত সংরক্ষণ ব্যবস্থা নেই।

হাজারো নথি থেকে একটি নথি খুঁজে বের করে আনা কি কঠিন! ১০ মিনিটের কাজে সময় লাগছে ৩ ঘণ্টা। এ জটিলতা সুশাসনকে দুর্বল করছে। প্রাণ ওষ্ঠাগত হচ্ছে সেবাপ্রার্থী  মানুষের। নথি নিয়ে মানুষের অগণিত স্বার্থ, তাই একেকটি নথি সাধারণ মানুষের কাছে অমূল্য মনিরত্ন। অথচ এসব নথি চাপা পড়ে থাকে মৃত শামুকের মত। নথির পেছনে প্রাণান্ত দৌড়ে মানুষের মূল্যবান সময় ক্ষয়ে যাচ্ছে। নথির গতিহীনতা সৃষ্টি করছে প্রতিষ্ঠানের প্রতি বৈরিতা, কর্তৃপক্ষের প্রতি নেতিবাচকতা। নথির চাকায় গতি আনতে কী প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা, যা এক অন্তহীন বেদনা ও যন্ত্রণা।

প্রযুক্তিকে আন্তরিকভাবে গ্রহণে অবহেলায় অতিমাত্রায় এ নথি নির্ভরতা এবং নথিতে কাগজের অতি ব্যবহারে নথির আকার ধারণ করছে পর্বতপ্রমাণ উচ্চতা, যা’ জন্ম দিচ্ছে নথি ব্যবস্থাপনার জটিলতা, দীর্ঘসূত্রতা। এভাবে সেবক ও সেবাপ্রার্থীর বন্ধন ভেঙ্গে যাচ্ছে। দীর্ঘ ২৫-৩০ বছর চাকরির পর একজন চাকরিজীবীকে যখন বলা হয়, তার সার্ভিস বই হারিয়ে গেছে কিংবা তার সার্ভিস বইতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেই, তখন তিনি দৈহিক ও মনস্তাত্বিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। এ ঘটনা অনেকটা ঠাণ্ডা মাথায় খুনের মত, যা অসহনীয় দণ্ড! কেন আমরা পুরোপুরি ডাটাবেজ নির্ভর হতে পারছি না? ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা ছাড়া বস্তা বস্তা নথি ব্যবহারের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। নচেৎ অগণিত নথির নিশ্চলতায় রুদ্ধ হয়ে থাকবে  মানুষের চাওয়া-পাওয়া।

অফিসে যত প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়বে ততই নথির উপর নির্ভরতা কমবে। কারো দয়া-দাক্ষিণ্যের দিকে চেয়ে থাকতে হবে না সেবা প্রার্থীদের। নথির চারপাশে হয়রানি ও জটিলতার আবর্তন ভেঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে প্রযুক্তির ব্যবহার। এখন যারা চাকরিরত, তাদের পরিচিতি, ছবি ও স্বাক্ষরযুক্ত ডিজিটাল ডাটাবেজ তৈরি করে রাখলে ভবিষ্যতে অবসরোত্তর পাওনা পরিশোধের ক্ষেত্রে সময়, অর্থ ও শ্রমের অপচয় রোধ হবে, স্বচ্ছতা আসবে এবং হয়রানি কমবে। এছাড়া সার্বক্ষণিক মোবাইল কানেকটিভিটি নিশ্চিত করলে সেবা দেয়া আরও সহজ হবে।

ডেসা’র অবসরপ্রাপ্তদের পাওনা পরিশোধের জন্য তাদের গ্রামে গ্রামে চিঠি পাঠানোর রেওয়াজ পাল্টে, নির্দিষ্ট তারিখে মোবাইলে ডেকে তাদের পাওনা পরিশোধের দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছি। এতে নথির স্তূপ কমেছে, হয়রানিও বন্ধ হয়েছে। অথচ ১০ মাস আগেও মাসের পর মাস অফিসের দরজায় তাঁরা দাড়িয়ে থাকতো। অগণিত নথি সৃজন না করে শুধু এক পৃষ্ঠা কাগজেই প্রয়োজনীয় আদেশটুকু দিয়ে তার দ্রুত বাস্তবায়ন সম্ভব। এভাবে ডিপিডিসিতে খুব কম সময়েই বিপুল সংখ্যক গ্রাহকের সমস্যা সমাধানে সক্ষম হয়েছি। একটু উদ্যোগী হলেই অপ্রয়োজনীয় শ্রম, সম্পদ ও সময়ের অপচয় কমিয়ে গাদা গাদা নথির চর্চা থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব।

নথিপত্র আটকে রাখা, নথি থেকে কাগজ সরিয়ে ফেলা, ডকুমেন্ট হারিয়ে ফেলা মানবাধিকার ক্ষুন্ন করার মত বড় অবিচার। যে অবিচারে অসহায় মানুষের কান্নায় ভারী হয় পরিবেশ, ভেঙ্গে যায় মন, সৃষ্টি হয় মানসিক পীড়ন, নির্যাতন। এসব কর্মকাণ্ড মানুষকে সর্বস্বান্ত করার মত অপরাধ, যা’ আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে গুলি ছুঁড়ে খুনের মতই পাপ।

আজ ২৩ জুন, আন্তর্জাতিক পাবলিক সার্ভিস ডে উপলক্ষে আমার এ নিবন্ধ বেসামরিক প্রশাসনের সব তরুণ কর্মকর্তাদের জন্য, যাদের থাকতে হবে মানুষকে সেবা দেয়ার দৃঢ় মানসিকতা। আপামর জনগোষ্ঠীকে দ্রুত সেবার সুফল পৌঁছে কমাতে হবে হয়রানি, নথির অবিশ্বাস্য মন্থর গতি। সদিচ্ছা ও সততার শক্তি মানুষকে দ্রুত সেবা দেওয়ার চালিকাশক্তি। দ্রুতগতিতে নথি নিষ্পত্তি সুশাসনের চাবিকাঠি, যা’ মুছে দেবে মানুষের আর্তনাদ, অভিশাপ, অস্বস্তি।


মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী: সচিব, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড, mmunirc@gmail.com




বাংলাদেশ সময়: ১১০৭ ঘণ্টা, জুন ২৩, ২০১৫
জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।