ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

আলফ্রেড সরেন হত্যার বিচার হয়নি ১৫ বছরেও

হেমন্ত মাহাতো, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১১ ঘণ্টা, আগস্ট ১৮, ২০১৫
আলফ্রেড সরেন হত্যার বিচার হয়নি ১৫ বছরেও আলফ্রেড সরেন

দীর্ঘ ১৫ বছরেও বিচার হয়নি আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেন হত্যাকাণ্ডের। নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুর আদিবাসী পল্লীতে ১৫ বছর আগে আলফ্রেড সরেনকে হত্যা করা হলেও এখন পর্যন্ত সেই মামলার কোনও সুরাহা হয়নি।



দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ায় এ মামলার বিচার কার্য শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়ে আদিবাসীদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে সংশয়ের। এর উপর অব্যাহত হুমকি-ধমকি ও আর ষড়যন্ত্রের কারণে আদিবাসীদের অনেকেই ইতোমধ্যে ভীমপুর আদিবাসী পল্লী ত্যাগ করেছেন, অনেকে দেশান্তরিত হয়েছেন।

২০০০ সালের ১৮ আগস্ট হাতেম ও গদাই নস্কর সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর উপজেলার ভীমপুর গ্রামের ১৩ আদিবাসী পরিবারের উপর যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ও তাণ্ডবলীলা চালায় তা মধ্যযুগীয় বর্বতাকে হার মানায়। অতর্কিত ওই আক্রমণে আদিবাসীরা হতবিহ্বল হয়ে পড়ে।

খুনিরা চিৎকার করে খুঁজতে থাকে আলফ্রেড সরেনকে। একের পর এক বাড়ি আগুনে জ্বালিয়ে দিতে দিতে অগ্রসর হয় খুনিরা। সামনে যাকে পায় তার উপর চলে পৈশাচিক নির্যাতন। শিশুদের হাত পা ধরে পুকুরে ছুঁড়ে মারা হয়। আদিবাসী পরিষদের নেতা বৃদ্ধ জগন্নাথ সরেন ও যতীন সরেন নামে ৩০ বছরের এক যুবককে আগুনে নিক্ষেপ করা হয়। আলফ্রেড সরেনের বড় ভাইয়ের স্ত্রী পানসিরির পেটে লাথি দেবার ফলে তার গর্ভচ্যুতি ঘটে।

চারিদিকে যখন আদিবাসীদের চিৎকার আর আগুনের লেলিহান শিখায় আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে, তখন বোন রেবেকা সরেন ভাইকে নিয়ে বাঁচার জন্য পাশের বাড়িতে ঘরের মধ্যে ধানের বস্তার ফাঁকে আশ্রয় নেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয় খুনিরা। আগুনের উত্তাপে টিকতে না পেরে রেবেকা সরেন ঘরের জানালা ভেঙ্গে ভাইকে সঙ্গে নিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু ঘর থেকে বের হওয়া মাত্রই খুনিদের হাতে ধরা পড়েন আলফ্রেড সরেন। খুনিরা রামদা, চাইনিজ কুড়াল, বল্লম দিয়ে একের পর এক আঘাত করতে থাকে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন আলফ্রেড সরেন। আহত অবস্থায় খুনিদের কাছে আকুতি জানায় আমার হাত পা কেটে ফেলো, কিন্তু প্রাণে মেরো না। আমি কি দোষ করেছি তোমাদের কাছে?

বেঁচে থাকার আকুতি খুনিদের কানে পৌছায় না। আলফ্রেডের আকুতি খুনিদের আরও উন্মত্ত করে তোলে। বর্শার ফলার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত আলফ্রেড সরেন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

বোন রেবেকা সরেন মাত্র ৫০ গজ দূরে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে দেখেন ভাইয়ের মৃত্যু। আগুনের লেলিহান শিখায় জ্বলে ছাই হয়ে যায় ভীমপুরের আদিবাসী পল্লীর ১৩ পরিবার। ৩০/৩৫ জন আদিবাসী গুরুতর আহত হন। সকাল ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টাব্যাপি চলে এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। দীর্ঘ সময়ব্যাপী এই নারকীয় তাণ্ডব চললেও রহস্যজনকভাবে পুলিশ নীরব ও নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে।

২০০০ সালের ১৮ আগস্টের এই ঘটনা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আদিবাসী জনগোষ্ঠী, প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলসহ সচেতন মহলে ব্যাপক আলোড়ন ও ক্ষোভের সৃষ্টি করে। হাজার হাজার আদিবাসী সেই দিন রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানায়। আদিবাসীদের উপর এ ধরনের অত্যাচার ও হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দার ঝড় উঠে। অবিলম্বে এর সুষ্ঠু বিচার ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করা হয়। আলফ্রেড সরেনের হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি মিডিয়াসহ সর্বস্তরের মানুষ সোচ্চার হয়ে রাস্তায় নেমে আসে। আদিবাসীদের পক্ষে দেশব্যাপী ব্যাপক জনমত গঠিত হয়।

আদিব‍াসী নেতা আলফ্রেড সরেন হত্যার ঘটনায় তার ছোট বোন রেবেকা সরেন বাদী হয়ে হত্যা ও জননিরাপত্তা আইনে পৃথক দু’টি মামলা করেন। মামলায় মহাদেবপুর থানা পুলিশ তদন্ত শেষে ৯১ জন আসামির নামে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। পুলিশ কয়েকজন আসামিকে গ্রেফতারও করে। ওই সময় নওগাঁ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। ৪১ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ১৩ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছিল। মামলার প্রধান ২ আসামি সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান হাতেম আলী ও সীতেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য ওরফে গদাইসহ ৬০ জনের অধিক আসামি জননিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করলে হাইকোর্ট ৩ মাসের জন্য মামলাটির স্থগিতাদেশ দেন। ওই সুযোগে আদালত থেকে আসামিরা জামিনে বেরিয়ে আসেন। উচ্চ আদালতে রিটপিটিশন নম্বর ২৩২২/২০০১ এবং সিভিল পিটিশন নম্বর ৪২০/২০০৩ । আসামিরা বর্তমানে এলাকায় অবস্থান করছেন। উচ্চ আদালতে মামলাটি শুনানির অপেক্ষায় আছে।

ভীমপুর গ্রাম ও মৌজার ১৬৬ ও ১৬৮ দাগের এক একর জমির উপর তখন যে ১৩ আদিবাসী সাঁওতাল পরিবার বসবাস করত, তার অল্প দূরে ৯০/৯৫ বিঘা খাস জমি ছিল। সেই জমি দরিদ্র আদিবাসী ও এলাকার ভূমিহীনদের কাছে বন্দোবস্তো দেবার জন্য আলফ্রেড সরেন এলাকার ভূমিহীন ও আদিবাসীদের সংগঠিত করেছিলেন।

কম্যুনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য ও জাতীয় আদিবাসী পরিষদের নওগাঁ জেলার এই নেতাকে হাতেম গদাই গং ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী নির্মমভাবে খুন করে। যে দিন আলফ্রেডকে হত্যা করা হয় সেই দিন স্থানীয় নওহাটা মোড়ে ভূমিহীনদের সমাবেশ হবার কথা ছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে সমাবেশের মঞ্চ তৈরির কাজ তদারকি করে সাড়ে দশটায় বাড়িতে খেতে আসার পরপরই এই ঘটনা ঘটে।

আলফ্রেড সরেন হত্যাকাণ্ডের এক বছরের মাথায় তার মা ঠাকুরানী সরেন ছেলের শোকে  মারা যান। আলফ্রেড সরেনের পিতা বৃদ্ধ গায়না সরেন ছেলের হত্যার বিচার পাওয়ার আশায় দিনের পর দিন অপেক্ষা করে ২০০৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। বর্তমানে আলফ্রেড সরেন এর স্ত্রী জোছনা সরেন রাজশাহী জেলার তানোর আমশো মথুরাপুরে কৃষিক্ষেত্রে দিন মজুরি করে দিন যাপন করছেন। তার একমাত্র কন্যা ঝর্ণা সরেন রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার তানোর কলেজে অধ্যয়নরত।

আলফ্রেড সরেন হত্যার আজ ১৫ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের কোন বিচার হয়নি। যে জমিকে কেন্দ্র করে আলফ্রেড সরেনকে জীবন দিতে হয়েছে, সেই জমি এখন খুনিদের দখলে। খুনিরা জমির ফসল বিক্রি করে মামলার খরচ চালাচ্ছে।

সুদীর্ঘ ১৫ বছরেও এই রাষ্ট্র আলফ্রেড সরেনের মতো আলোচিত, আলোড়িত হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া শেষ না হলেও সিধু, কানহু, বিরসা মুন্ডার নামের সাথে ঠিকই উচ্চারিত হয় আলফ্রেড সরেনের নাম।

আজকের এই দিনে আলফ্রেড সরেনকে স্মরণ করছি বিনম্র ভালবাসা আর শ্রদ্ধায়। তিনি বেঁচে থাকবেন ইতিহাসে। আদিবাসীদের জাতীয় জীবনে আলফ্রেড সরেন থাকবেন দীপশিখা হয়ে। শোষণ আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে তাঁর যে কন্ঠস্বর ছিল তা শতাব্দীর পর শতাব্দী আমাদের নতুন প্রজম্ম মনে রাখবে।

হেমন্ত মাহাতো: সভাপতি, আদিবাসী ছাত্র পরিষদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা, hemonta1971@yahoo.com

বাংলাদেশ সময়: ১৩০০ ঘণ্টা, আগস্ট ১৮, ২০১৫
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।