ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

শুভকামনা বাংলা শকুন

সীমান্ত দীপু, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৫, ২০১৫
শুভকামনা বাংলা শকুন

বাংলার আকাশে আর শকুন দেখা যায় না। লাখো শকুনের দল আর নেই; আছে হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি শকুন।

বাংলাদেশের এই বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতিটির অবস্থা এখন বাঘের চেয়েও ভয়াবহ। বাঘের টিকে থাকার জন্য আছে সুন্দরবনের মতো বিশাল বাদাবন। মানুষের শত অত্যাচারের পরও সুন্দরবনকে ধ্বংস করা কঠিন। বাঘের আবাসস্থল ও খাবার কিছুটা হলেও টিকে আছে এবং থাকবে। তাই বাঘ কিন্তু কোনো না কোনোভাবে টিকেই যাবে। সেটা বন্য অবস্থায় হোক আর কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রে হোক। কিন্তু শকুনের জন্য এরকম সমাধান খুব কঠিন। মাত্র দুই যুগেই একটি প্রাণী আবাসস্থল ও খাবার থাকা সত্ত্বেও প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এদের মৃত্যুর পেছনে নিশ্চয়ই বড় কারণ আছে। আশির দশক থেকে যখন শকুন গণহারে মারা পড়তে শরু করে তখন থেকেই বিজ্ঞানীদের জোরালো গবেষণা চলতে থাকে। সবশেষ ভারতীয় এক বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেন এদের মৃত্যুর পেছনে দায়ী একটি ওষুধ। পশু চিকিৎসায় ব্যবহৃত ডাইক্লোফেনাক ও কিটোপ্রোফনই শকুন মৃত্যুর প্রধাণ কারণ। তাই বিশ্বব্যাপী সবার একটাই দাবি, যে ক’টি শকুন এখনও পৃথিবীতে টিকে আছে তা রক্ষায় সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হোক।

বাংলাদেশ ও বাংলা শকুন:
বাংলাদেশে তিন প্রজাতির শকুন স্থায়ীভাবে বসবাস করত। এর মধ্যে রাজ শকুন বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সরুঠুঁটি শকুনকে চল্লিশ বছর পর এবছর রেমা-কালেঙ্গার বনে বাসাসহ দেখা গেছে। বর্তমানে বাংলা শকুনই একমাত্র আবাসিক শকুন হিসেবে টিকে আছে। এটি দক্ষিণ এশিয়ায় এনডেমিক পাখি। বাংলা শকুন বর্জ্যভূক হিসেবে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক পরিষ্কারকই নয়, এটি বাংলা সংস্কৃতিরও অংশ। এর বৈজ্ঞানিক নাম bengalensis এসেছে এই ‘বাঙলা’ অঞ্চল হতে। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রায় চার কোটি বাংলা শকুন ছিল। বর্তমানে এই সংখ্যা প্রায় দশ হাজারে নেমে এসেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ নেপাল, পাকিস্তানে আছে মাত্র এক হাজার, আর বাকি শকুনগুলো আছে ভারতে। ১৯৯০ সাল থেকে সমগ্র উপমহাদেশে বাংলা শকুনসহ অন্যান্য শকুন অতি দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে। উপমহাদেশের প্রায় ৯৯.৯ শতাংশ বাংলা শকুন এখন বিলুপ্ত এবং আইইউসিএন এই প্রজাতিটিকে বিশ্বে মহাবিপন্ন ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশে শকুনের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে বাংলা শকুনের সংখ্যা পাঁচশ’র নিচে নেমে এসেছে।

শকুনের গুরুত্ব
পার্সিয়ান সম্প্রদায়রা তাদের মৃতদেহ সৎকার করে শকুন দিয়ে। শকুন না থাকায় সংকটের মুখে তাদের এই পবিত্র কার্যক্রম। শকুন প্রাণীর মৃতদেহ খেয়ে প্রকৃতিকে পরিষ্কার রাখে। শকুনই একমাত্র প্রাণী যে বিভিন্ন রোগের জীবাণু আক্রান্ত মৃতদেহ খেয়ে হজম করতে পারে এবং বিভিন্ন রোগের জীবাণু যেমন অ্যানথ্রাক্স, যক্ষ্মা, খুরা রোগের সংক্রমণ হতে মানুষসহ বিভিন্ন পশু-পাখিকে রক্ষা করে। শকুন না থাকায় এসব রোগের সংক্রমণ বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বেশ কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। গত দুই দশকে দক্ষিণ এশিয়ায় শকুন বিলুপ্তির কারণে পরিবেশগত সমস্যা দেখা দিয়েছে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। শকুনের অবর্তমানে বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধি দ্বারা মানুষ ও গবাদি পশু আক্রান্ত হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় কুকুরের সংখ্যা বেড়ে গিয়ে জলাতঙ্ক সংক্রমণের হার বেড়ে গিয়েছে যা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। বর্তমানে পশু মারা গেলে তার মৃতদেহ মাটিতে পুঁতে ফেলার কথা বলা হয়। কিন্তু অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত একটি মৃতদেহ মাটিতে পুঁতে রাখলেও তার জীবাণুর একশ’ বছর পর্যন্ত  সংক্রমণ করার ক্ষমতা থাকে। কাজেই প্রাকৃতিকভাবে জীবাণু সংক্রমণের নিয়ন্ত্রন শকুন যতটুকু করতে পারে অন্য কোনোভাবে তা সম্ভব নয়।

শকুন বিলুপ্তির কারণ
পশু চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক সোডিয়াম ওষুধ ব্যবহার করা হয়েছে এমন গবাদি পশুর মৃতদেহ খাওয়ার ফলে শকুন আজ বিলুপ্তির পথে। ভারত, পাকিস্তান, নেপালের বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ডাইক্লোফেনাককে শকুন বিলুপ্তির প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বর্তমানে ডাইক্লোফেনাকের মতো প্রায় সমান ক্ষতিকর ওষুধ হিসেবে কিটোপ্রোফেনও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। ডাইক্লোফেনাক ও কিটোপ্রোফেন হজমের জন্য শকুনের শরীরে কোনো এনজাইম নেই, তাই কিউনি নষ্ট হয়ে শকুনের মৃত্যু হয়। এছাড়া, খাদ্য সংকট এবং বসতি ধ্বংসকেও শকুন বিলুপ্তির অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও বাংলাদেশে এই ওষুধটি পশু চিকিৎসায়  সরকারিভাবে শকুন রক্ষায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আর ডাইক্লোফেনাকের পরিবর্তে পশু চিকিৎসায় মেলেক্সিক্যামের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে বলা হয়েছে।

শকুনের নিরাপদ এলাকা ও আশার আলো:
বাংলা শকুনের দ্রুত ও ব্যাপকহারে সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় বিশ্বজুড়ে অদূর ভবিষ্যতে এর বিলুপ্তির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাই এই শেষ সময়ে এসে ভারতীয় উপমহাদেশে এক বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্যাটেলাইট টেলিমেট্রি ব্যবহার করে বৈজ্ঞানিকভাবে শকুনের বিচরণক্ষেত্র নির্দিষ্ট করা হয়েছে। শকুনের নিরাপদ এলাকা হচ্ছে ১০০ কি.মি. ব্যাসার্ধের একটি বৃত্তীয় এলাকা যেখানে প্রায় ত্রিশ হাজার বর্গ কি. মি. এলাকা অন্তর্ভুক্ত। এই এলাকায় পশু চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক ও কিটোপ্রোফেনের ব্যবহার থাকে শূন্যের কোটায়। পুরো ভারতজুড়ে বাংলা শকুন রক্ষায় পাঁচটি নিরাপদ এলাকা ঘোষণা করেছে সেদেশের সরকার। নেপালেও দুটি নিরাপদ এলাকা ঘোষণা হয়েছে। এখানে শকুনের জন্য একটি অভিনব পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে। সাধারণ মানুষের মাধ্যমে ডাইক্লোফেনাকমুক্ত গরু উৎপাদন করে শকুনের জন্য খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। এ দুটি দেশে এখন সাতটি নিরাপদ এলাকায় শকুনের সংখ্যা স্থির অবস্থায় আছে। পাশাপাশি ভারতে শকুনের চারটি কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রের ব্যবস্থা করেছে সেদেশের সরকার। বাংলাদেশেও বন বিভাগের উদ্যোগে দুটি শকুনের নিরাপদ এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। এর একটি হলো বৃহত্তর সিলেট বিভাগ এবং অন্যটি সুন্দরবন এলাকা। এদেশেও এই উদ্যোগ সফল হলে বাংলার আকাশে কিছু শকুনের দেখা আবারও মিলবে। পাশাপাশি বাংলা শকুন রক্ষায় ভারত, নেপাল, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে একটি আঞ্চলিক কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং বাংলাদেশে সরকারের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ‘বাংলাদেশ জাতীয় শকুন সংরক্ষণ কমিটি’ গঠন করেছে।



শকুনের নিরাপদ খাবার স্টেশন
শকুন রক্ষায় বাংলাদেশে সবচেয়ে ভালো ও বড় উদ্যোগ হলো ‘শকুনের নিরাপদ খাবার স্টেশন’ তৈরি। এর ফলে প্রজনন মৌসুমে বন্য শকুনেরা নিরাপদ খাবার পাবে। বর্তমানে রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে একটি স্টেশন তৈরি করা হয়েছে। এই এলাকায় ১২ সদস্য বিশিষ্ট একটি স্থানীয় শকুন সংরক্ষণ দল গঠন করা হয়েছে। এই দলের সদস্যরা শকুনের নিরাপদ এলাকায় গরু মারা পড়লে তা সংগ্রহ করে। তারপর ঐ গরুটি ডাইক্লোফেনাক বা বিষাক্ত ওষুধমুক্ত নিশ্চিত হলে নিরাপদ খাবার স্টেশনে ফেলে। নেপাল ও কম্বোডিয়াতেও এই ধরনের ব্যবস্থা আছে। তারা মূলত গরু কিনে স্থানীয় মানুষের কাছে লালন পালনের জন্য দিয়ে দেয়। পরিণত বয়স হলে গরুটি আবার তার কাছে থেকে কিনে নেওয়া হয় এবং ঐ গরুটিকে শকুনের জন্য সরবরাহ করা হয়। এই পদ্ধতিকে ওরা ভালচার রেস্টুরেন্ট নাম দিয়েছে। কিন্তু এই উদ্যোগের দীর্ঘমেয়াদী অসুবিধাও আছে। এতে করে শকুনরা আস্তে আস্তে প্রাকৃতিক খাবার খুঁজতে ভুলে যায়। তাই বাংলাদেশে এই পদ্ধতি থেকে সরে এসে মরা গরু সংগ্রহ করে তা শুধুমাত্র প্রজনন মৌসুমের খাবার হিসেবে দেওয়া হচ্ছে যাতে কোনো বাচ্চা মারা না পড়ে। বাংলাদেশে এই উদ্যোগটি আরো জোরালোভাবে নেওয়া হলে শকুনের সংখ্যা নিশ্চয়ই বাড়বে।

শেষকথা:
পৃথিবীতে মাত্র দুটি প্রাণীর জীবনে এরকম ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটেছে। একটি হলো প্যাসেনঞ্জার পিজিওয় অন্যটি বাংলা শকুন। প্যাসেনঞ্জার পিজিওয়-এর শেষ পাখিটির মৃত্যু হয় ১ সেপ্টেম্বর ১৯১৪ সালে। একসময় এ প্রজাতির কোটি কেটি পাখি থাকলেও মানুষই শিকার করে প্রজাতিটিকে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত করেছে। আর শকুনকে মানুষ শিকার করে না; মানুষের তৈরি ওষুধ ব্যবহারে শকুন হারিয়ে গেছে। বাংলার নামে এ পৃথিবীতে মাত্র ১১টি পাখি আছে। তাদেরই একটি বাংলা শকুন। শকুন রক্ষা এখন শুধু সরকার বা গবেষকদের একার দায়িত্ব নয়। আমাদের সবার সম্মিলিত উদ্যোগেই মহাবিপন্ন প্রাণীটি পৃথিবীতে টিকে যেতে পারে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৫, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।