ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

ইন্টারনেটের কানা-গলি

মুহম্মদ জাফর ইকবাল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৩৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১৫
ইন্টারনেটের কানা-গলি মুহম্মদ জাফর ইকবাল

প্রায় বিশ বছর আগে আমি যখন প্রথমবার দেশে ফিরে এসেছিলাম, তখন যে বিষয়গুলো নিয়ে ধাক্কা খেয়েছিলাম তার একটি ছিল টেলিফোন। আমেরিকায় সবার বাসায় টেলিফোন এবং সেই টেলিফোন নিখুঁতভাবে কাজ করে, আমাদের দেশে টেলিফোন বলতে গেলে কোথাও নেই, আর যদিও বা থাকে সেগুলো কখনই ঠিকভাবে কাজ করে না।

তারপরও যার বাসায় টেলিফোন আছে, তাদের অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না! তবে তার একটা যন্ত্রণাও আছে, আশপাশের সব বাসা থেকে লোকজন টেলিফোন করতে চলে আসে। যারা একটু ছোটলোক ধরনের মানুষ তারা টেলিফোনের ডায়ালের অংশটুকুতে তালা মেরে রাখত, টেলিফোন রিসিভ করা যেত। কিন্তু টেলিফোন করা যেত না! শুধু যে টেলিফোন ছিল না তা নয়, মনে হয় টেলিফোনের তারও ছিল না। কারণ একই টেলিফোনের তার দিয়ে একাধিক মানুষ কথা বলত এবং তার নাম ছিল ‘ক্রস কানেকশন’। প্রায়ই টেলিফোন করতে গিয়ে আবিষ্কার করতাম ইতোমধ্যে সেই টেলিফোনে অন্য কেউ কথা বলছে। তখন অনুরোধ করা হতো, ‘ভাই আপনারা টেলিফোনটা একটু রাখেন, আমরা একটু কথা বলি। ’ অবধারিতভাবে অন্য দু'জন বলত, ‘আপনারা রাখেন আমরা কথা বলি!’ ঝগড়াঝাটি মান অভিমান সবই হতো। ’ শুধু যে বাসায় টেলিফোন ছিল না তা নয়, পাবলিক টেলিফোনও বলতে গেলে ছিল না। আমার মনে আছে আমাদের ক্যাম্পাসে শুধু একটা একাডেমিক বিল্ডিংয়ের সামনে একটা কার্ড ফোনের বুথ ছিল। টাকা দিয়ে কার্ড কিনে সেই কার্ড ঢুকিয়ে ফোন করতে হতো। প্রায় সময়েই ফোনের কানেকশন হতো না। কিন্তু টেলিফোন বুথ নির্দয়ভাবে কার্ড থেকে টাকা কেটে নিত দুই পক্ষই দুই পাশ থেকে গেল গেল বলে চিৎকার করছি, কেউ কারো কথা শুনছি না। কিন্তু এই ফাঁকে ঠিকই কার্ড থেকে পুরো টাকা উধাও হয়ে গেছে!

এখন সেই সময়কার কথা মনে হলে নিজেরাই আপন মনে হাসি। আমার মনে হয় এখন প্রায় সবার বসাতেই যতজন মানুষ তার থেকে বেশি টেলিফোন। একসময় টেলিফোনে কথা বলা কমে অন্য কাজকর্ম বেড়ে যাচ্ছে। আমরা টেলিফোনে এসএমএস পাঠাই-ইংরেজিতে বাংলা লিখে। সবার এমন অভ্যাস হয়ে গেছে যে আমি রীতিমতো আতঙ্কে থাকি, যে কোনো এক বইমেলায় আমি দেখব কেউ একজন ইংরেজিতে বাংলা লিখে একটা বই বের করে ফেলেছে! আম জনতাকে অবশ্য সে জন্য দোষ দেওয়া যায় না, আজকাল দেখছি সরকারও ইংরেজিতে বাংলা লিখে নানা ধরনের বিজ্ঞপ্তি পাঠাচ্ছে। আমার মনে হয় টেলিফোনে এসএমএস পাঠানোর পর পরই যে কাজটা করা হয়, সেটি হচ্ছে ছবি তোলা। কয়েকজন মানুষ একত্র হয়ে গল্পগুজব করছে চা-নাস্তা খাচ্ছে এই পরিচিত সামাজিক দৃশ্যের মাঝে অবধারিতভাবে এখন নতুন একটি দৃশ্য যোগ হয়েছে, সেটি হচ্ছে একজন তার মোবাইল বের করে ছবি তুলছে। এক সময় মানুষ যত্ন করে ছবি তুলত, এখন সেলফি নামক ছবি তোলার এই বিচিত্র পদ্ধতি আবিষ্কৃত হওয়ার পর, যত্ন করে ছবি তোলার বিষয়টিই উঠে গেছে। (সেলফি ছবি তোলার যে একটা সামাজিক মানমর্যাদার বিষয় আছে আমি সেটা জানতাম না। একজন কমবয়সী ছেলে আমার সঙ্গে সেলফি তুলতে চাইতেই কাছে দাঁড়ানো একজন বড় মানুষ এই বেয়াদবি করার জন্য তাকে রীতিমতো ধমক দিয়ে বসেছিলেন। )

কথা বলা এবং ছবি তোলা ছাড়াও এই টেলিফোনে আরো অসংখ্য কাজ করা যায়, আমার মনে হয় না আমি তার তালিকা লিখে শেষ করতে পারব। শুধু তাই নয়, আমি যে কয়টি লিখতে পারব আমার ধারণা পাঠকরা তার থেকে অনেক বেশি লিখতে পারবেন। টেলিফোনে যে কয়টি কাজ করা যায় তাতেই সন্তুষ্ট থাকারও প্রয়োজন নেই। আমি আমার ছাত্রদের দিয়ে আমার জন্য পরীক্ষা নেওয়ার একটা ‘অ্যাপ’ তৈরি করিয়ে নিয়েছে। এমসিকিউ ধরনের পরীক্ষা নেওয়ার পর ছাত্রছাত্রীরা উত্তরটা আমাকে এসএমএস করে পাঠায়, আমার টেলিফোন উত্তরটা যাচাই-বাছাই করে ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষায় কত পেয়েছে সঙ্গে সঙ্গে সেটাও তাদের জানিয়ে দেয়। এখন আমার পরীক্ষা নিতে ক্লান্তি নেই, আমার ধারণা যে কোনোদিন আমার ছাত্রছাত্রীরা আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসবে! তবে টেলিফোনে আজকাল যে কাজটা সবচেয়ে বেশি হচ্ছে সেটি সম্ভবত ইন্টারনেটে বিরচণ। আজকের লেখটি এই বিষয় নিয়ে এবং এতক্ষণ আসলে এই কথাটি বলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি।

মূল বক্তব্যে যাওয়ার আগে সবাইকে একটি বিষয় মনে করিয়ে দেয়া যাক, সেটি হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির মাঝে পার্থক্য। পরমাণুর কেন্দ্রে যে নিউক্লিয়াস থাকে তার মাঝে বিশাল একটা শক্তি জমা থাকতে পারে এই তথ্যটা হচ্ছে জ্ঞান কিংবা বিজ্ঞান। এই শক্তিটা ব্যবহার করে চোখের নিমিষে লাখ লাখ মানুষ মেরে ফেলার জন্য যে নিউক্লিয়ার বোমা তৈরি হয়, সেটা হচ্ছে প্রযুক্তি। কাজেই জ্ঞান-বিজ্ঞান খুবই চমৎকার বিষয় এর মাঝে কোনো সমস্যা নেই। আমরা কিন্তু কখনই প্রযুক্তির ব্যাপারে এরকম ঢালাওভাবে সার্টিফিকেট দিতে পারব না। প্রযুক্তির মাঝে যেরকম ভালো প্রযুক্তি আছে ঠিক সেরকম অপ্রয়োজনীয় এমন কী খারাপ প্রযুক্তি আছে! কাজেই নতুন একটা প্রযুক্তি দেখলেই সেটা নিয়ে গদগদ হয়ে যাওয়ার অভ্যাস আমাদের ছাড়তে হবে। যে কোনো নতুন একটা প্রযুক্তি দেখলেই রীতিমতো ভুরু কুঁচকে সেটাকে যাচাই-বাছাই করে নেওয়া মোটেও প্রাচীন পন্থীর কাজ নয়, রীতিমতো বুদ্ধিমানের কাজ। এর সবচেয়ে সহজ উদাহরণ হচ্ছে কম্পিউটার। আমাদের সবচেয়ে সস্তা মোবাইল টেলিফোনেও একটা কম্পিউটার আছে আবার যে মহাকাশযানটি সেই প্লুটোর কাছে হাজির হয়ে তার ছবি তুলে পাঠাচ্ছে তার ভেতরেও একটা কম্পিউটার আছে।

এই অসাধারণ একটি প্রযুক্তি আসলে আমাদের পুরো সভ্যতাটাকেই নতুন করে সাজিয়ে দিয়েছে। কোনো মানুষ যদি ঠিক করে সে কম্পিউটার ব্যবহার না করেই তার জীবনটা কাটিয়ে দেবে আমার ধারণা তার জীবনটা আক্ষরিক অর্থে আটকে যাবে। অথচ আমি একজন মা’কে জানি, যিনি একটি কম্পিউটার দেখলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। কারণ তার সন্তান কোনো বিশ্রাম না নিয়ে টানা কয়েকদিন একসঙ্গে কম্পিউটার ব্যবহার করে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে মারা গেছে। এটি অত্যন্ত ব্যতিক্রমী এবং নিষ্ঠুর একটি উদাহরণ। আমরা জানি সারা পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ নিরাপদে কম্পিউটার ব্যবহার করে সবরকম কাজকর্ম করে যাচ্ছে এবং সে জন্যই এই উদাহরণটি আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। কারণ এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে খুবই নিরীহ এবং নিরাপদ একটা প্রযুক্তি নিয়ে বাড়াবাড়ি করেও ভয়ংকর একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলা যায়। এরকম উদাহরণ অনেক আছে।

আমাদের দেশ যেহেতু প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা একটি দেশ। তাই আমরা যে কোনো নতুন প্রযুক্তি দেখলেই একেবারে গদগদ হয়ে যাই। সে কারণে দেশে যখন নতুন কম্পিউটার এসেছে, আমরা সেটা আমাদের নতুন প্রজন্মের হাতে তুলে দেওয়ার জন্যে খুবই ব্যস্ত ছিলাম। কম্পিউটারের নামটা দেখেই বোঝা যায় এর জন্ম হয়েছিল ‘কম্পিউট’ বা হিসাব করার জন্য। কিন্তু এই যন্ত্রটি এতই বিচিত্র যে এটি দিয়ে কী কাজ করা যাবে সেটি সীমিত হতে পারে শুধুমাত্র মানুষের সৃজনশীলতা দিয়ে। সৃজনশীলতা যে সবসময় সঠিক রাস্তায় যায় তার কোনো গ্যারান্টি নেই। কাজেই আমরা আবিষ্কার করেছি এই দেশে নতুন প্রজন্মের কাছে কম্পিউটারের জনপ্রিয়তা অন্যতম কারণ হয়ে গেছে গেম। প্রযুক্তির প্রতি আমাদের এতই অন্ধ বিশ্বাস যে বাবা-মা যখন দেখেছেন তাদের ছেলে মেয়েরা সব কাজকর্ম ফেলে দিনরাত কম্পিউটারের মনিটরে মুখ গুঁজে পড়ে আছে তখন তারা দুশ্চিন্ত না হয়ে আহ্লদিত হয়ে উঠতে শুরু করেছে। আমি অন্তত একটি শিশুর বাবা-মায়ের কথা জানি, যারা তার শিশুটিকে কম্পিউটারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পুরোপুরি একটি অসামাজিক জীব হয়ে বড় হওয়ার বিষয়টি নিয়ে অহংকার করেন। কম্পিউটার এসে আমাদের অনেক শিশুর জীবনকে মোটামুটি জটিল করে তুলেছিল, ইন্টারনেট আসার পর তার সঙ্গে একটা নতুন মাত্রা যোগ হলো।

ইন্টারনেট সম্ভবত আমাদের এই শতাব্দীর সবচেয় বড় প্রযুক্তি। আমার মাঝে মাঝেই মনে হয় যে আমি কত বড় সৌভাগ্যবান যে নিজের চোখে এই প্রযুক্তিটিকে জন্ম নিতে এবং বিকশিত হতে দেখেছি। আমারা সবাই জানি একসময় এই দেশের কিছু কর্তাব্যক্তি আমাদের দেশে যেন ইন্টারনেট আসতে না পারে তার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। দেশের তথ্য পাচার হয়ে যাওয়ার ভয়ে তারা সাবমেরিন ফাইবারের যোগাযোগ নিতে রাজি হননি। এই চরিত্রগুলোর নাম এবং পরিচয় জানার আমার খুব কৌতূহল হয়। আমাদের দেশের সংবাদ মাধ্যমে তো কত কিছু নিয়েই কত রকম ফিচার করে থাকেন, দেশকে পিছিয়ে নেওয়ার কাজে সবচেয়ে অগ্রগামী এই মানুষদের নাম পরিচয় জানিয়ে একবার একটা ফিচার কেন করেন না। একটা দেশ প্রযুক্তিতে কতটুকু এগিয়ে আছে, তার পরিমাপ করার জন্য নানারকম জরিপ নেয় হয়। এর একটা পরিমাপ হচ্ছে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা এবং খুবই স্বাভাবিক কারণে আমাদের এই সংখ্যাটি অন্যান্য দেশের তুলনায় ছিল খুবই কম। ইন্টারনেট ব্যবহার করার জন্য একটা কম্পিউটার বা ল্যাপটপের দরকার হতো এই দেশের আর কতজন মানুষের কম্পিউটার কিংবা ল্যাপটপ কেনার ক্ষমতা আছে? শুধু তাই নয়, কম্পিউটার ল্যাপটপের সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারনেটের সংযোগের ব্যাপার আছে এবং সবকিছু শেষ হওয়ার পর আমাদের সেই মিলিয়ন ডলার প্রশ্নটি করতে হয়, ইন্টারনেট ব্যবহার করে কী করা হবে?

মোটামুটি একই সময়ে হঠাৎ করে সবগুলো সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। ইন্টারনেট ব্যবহার করার জন্যে কম্পিউটার কিংবা ল্যাপটপের দরকার নেই খুবই স্বল্পমূল্যের স্মার্ট ফোন দিয়েই সেটা করা সম্ভব। ইন্টারনেট সংযোগের দরকার নেই অনেক জায়গাতেই ওয়াইফাই আছে, যদি না থাকে মোবাইল অপারেটরদের কাছ থেকে মেগাবাইট কেনা যায়। আর ইন্টারনেট দিয়ে কী করা হবে সেই প্রশ্নটি করা হলে সবাই আমাকে বেকুব বলে ধরে নেবে। এটি কী এখন কোনো প্রশ্ন হতে পারে? অবশ্যই ইন্টারনেট দিয়ে ফেসবুকিং করা হবে। জরিপ নিয়ে দেখা যায়, বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর শতকরা আশি ভাগ মানুষ ফেসবুকিং করে থাকে। ইন্টারনেট এবং ফেসবুক এখন এই দেশে প্রায় সমার্থক শব্দ। তাই হঠাৎ করে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে সাড়ে চার কোটি হয়ে গেছে জানার পরও আমি কেন জানি উল্লসিত হতে পারছি না, বরং কেন জানি নার্ভাস অনুভব করতে শুরু করেছি। তার কারণ এর বড় একটা সংখ্যা আসলে কমবয়সী কিশোর-কিশোরী এমন কী শিশু!

আমি আগেই পাঠকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি যে, আমি ফেসবুক বা অন্য কোনো সামাজিক নেটওয়ার্কের বিশেষজ্ঞ নই। আমি কখনও কোনো ফেসবুক একাউন্ট খুলিনি। কিন্তু নানা ধরনের মানুষ আমার নামে ভুয়া ফেসবুক একাউন্ট তৈরি করে এতই ঝামেলা করতে শুরু করেছিল যে আমার ছাত্র এবং তরুণ সহকর্মীরা আমার জন্য একটা অফিসিয়াল ফেসবুক একাউন্ট তৈরি করে রেখেছে, এর ভেতরে কী ঘটে না ঘটে আমি দেখি না, তাই ফেসবুক বা অন্য কোনো সামাজিক নেটওয়ার্কের ভেতর কী ঘটে আমি সেটা জানি না। কিন্তু অবশ্যই আমি সেটা অনুমান করতে পারি। আমি একবার একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ সভায় মঞ্চে বসে আছি, আমার পাশে ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ বসেছেন। হঠাৎ করে তিনি আমাকে বললেন, একটা সেলফি তুলি? আমি মাথা নাড়লাম এবং সেই চলমান সভার মাঝখানে তিনি আমার সঙ্গে একটা সেলফি তুলে ফেললেন। আজকাল সেলফি তোলার পর সেটা শেষ হয়ে যায় না, সেটাকে ফেসবুকে দিতে হয় এবং সেই সভার মাঝখানেই তিনি সেটা ফেসবুকে দিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি আবার আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করে বললেন, এর মাঝে ঊনত্রিশটা লাইক পড়ে গেছে।

বলাবাহুল্য আমি চমৎকৃত হলাম লাইকের সংখ্যা দিয়ে নয়, এমন বয়স্ক এবং গুরুত্বপূর্ণ মানুষের এই ছেলেমানুষী আনন্দটি দেখে! যদি একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বয়স্ক মানুষ লাইকের সংখ্যা দেখে এরকম বিমলানন্দ পেতে পারেন, তাহলে আমাদের ছোট ছোট কিশোর-কিশোরী বা শিশুরা কী দোষ করেছে? তারা কেন ফেসবুকে লাইকের জন্য লালায়িত হবে না? কাজেই খুবই সঙ্গত কারণে আমাদের দেশের কিশোর-কিশোরী এবং শিশুরা এই লাইক কালচারে ঢুকে গেছে। অন্যসব কারণ ছেড়ে দিয়ে শুধুমাত্র অবিশ্বাস্য পরিমাণ সময় নষ্টের কারণে অসংখ্য অভিভাবক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করতে শুরু করেছেন।

আমাদের দেশে সাড়ে চার কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে তার মাঝে কতজন অপরিণত বয়সের ছেলেমেয়ে আমরা কী সেটা জানি? এই কমবয়সী ছেলেমেয়েদের জন্য ইন্টারনেটের জগৎটি কি একটা আলো ঝলমলে আনন্দের জগৎ নাকি প্রতি পদক্ষেপে লুকিয়ে থাকা অন্ধকার নিষিদ্ধ জগৎ? একজন শিক্ষিকা তার ক্লাসের ছেলেমেয়েদের ইন্টারনেটের উপকারিতা বোঝানোর জন্য গুগলে একটা বাংলা শব্দ লিখে সার্চ দিয়েছিলেন। এই শব্দটির মতো পূতঃ পবিত্র নির্দোষ এবং নিরীহ শব্দ বাংলা ভাষায় দ্বিতীয়টি নেই।   কিন্তু সেই শব্দের সূত্র ধরে ক্লাসের বাচ্চা ছেলেদের সামনে মাল্টিমিডিয়াতে বাংলা পর্নোগ্রাফির কুৎসিৎ জগৎ বন্যার পানির মতো নেমে এসেছিল। আমি নিজে ইন্টারনেটে পত্রিকা পড়তে পড়তে আশপাশে ক্লিক করে কিছু বোঝার আগেই হিংস্র মানুষের ঘৃণা ছড়ানো ভয়ংকর সাইটে ঢুকে পড়েছি। বাকস্বাধীনতার নামে এ ধরনের অমানবিক হিংস্র ওয়েবসাইট যে থাকতে পারে আমি সেটা জানতাম না। যদি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা নিজের অজান্তেই এরকম ভয়ংকর ওয়েবসাইটে ঢুকে যেতে পারেন তাহলে কেউ যখন সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করে তখন সে কোথায় গিয়ে হাজির হবে সেটি কী চিন্তা করা সম্ভব? বিষয়টি যথেষ্ট গুরুতর, খুব কম বয়সে একটা বাচ্চা যদি শিখে যায় যে নিজের ছবি কিংবা নিজের কর্মকাণ্ডের বর্ণনাতে অসংখ্য পরিচিত-অপরিচিত মানুষের লাইক পাওয়া হচ্ছে জীবনের একমাত্র আনন্দের বিষয়, সে তাহলে পুরোপুরি একটা ভুল মানুষ হয়ে বড় হবে। আমরা শিশুদের শৈশব অনেক আগেই কেড়ে নিয়েছি, এখন তাদের হাতে তুলে দিচ্ছি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের একটা জগৎ এর চাইতে বড় দায়িত্বহীন কাজ কী হতে পারে ?

আমি কোনো সমাধান দেওয়ার জন্য এই লেখাটি লিখতে বসিনি, খবরের কাগজে একটা কলম লিখে আমি এর সমাধান দিতে পারব, আমি সেটা মনেও করি না। তবে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের সংখ্যা বাড়ানোর আগ্রহে আমরা যে আমাদের দেশে অসংখ্য বাচ্চাদের সময়ের আগেই একটা বিপজ্জনক জায়গায় ঠেলে দিয়েছি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আমি মাথায় থাবা দিয়ে হায় হায় করে মাতম করতেও রাজি নই। ইন্টারনেট একটা অবিশ্বাস্য শক্তিশালী প্রযুক্তি, এটাকে দায়িত্ব নিয়ে ব্যবহার করে ম্যাজিক করে ফেলা সম্ভব। আমি তাই সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাই পুরো বিষয়টাকে নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় হয়েছে। অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার সময় হয়েছে। দেশের বড় বড় হর্তাকর্তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় হয়েছে। জ্ঞানী-গুণী মানুষদের চিন্তা করার সময় হয়েছে। পৃথিবীর অন্য দেশগুলো কীভাবে এই সমস্যার সমাধান বের করেছে সেগুলো খুঁজে দেখার সময় হয়েছে। আমরা শিশুদের শৈশব ফিরিয়ে দিতে চাই, তাদের প্রাপ্ত বয়স্কদের একটা জগৎ উপহার দিতে চাই না/ ইন্টারনেটের কানা-গলিতে তাদের হারিয়ে ফেলতে চাই না।

লেখক: অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশ সময়: ০৫৩০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১৫
টিআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।