বাংলাদেশে তামাকের ব্যবহার
বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারের হার বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ।
- প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ৪৩.৩% মানুষ তামাক ব্যবহার করেন।
- ধূমপানের চেয়ে ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারের হার বেশি। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের মধ্যে ২৭.২% ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবন করেন।
- ৪ কোটি ২০ লাখ মানুষ পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার।
বাংলাদেশে ধোঁয়াযুক্ত তামাকের মধ্যে সিগারেট ও বিড়ি প্রধান, আর ধোঁয়াবিহীন তামাকের মধ্যে আছে জর্দা, সাদাপাতা, গুল ইত্যাদি।
তামাকপণ্যের দাম
- বাংলাদেশে তামাকপণ্য সবচেয়ে শস্তা পণ্যর মধ্যে অন্যতম। সবচেয়ে শস্তা ধোঁয়াযুক্ত তামাকপণ্য এক টাকায় চারটিরও বেশি পাওয়া যায়। সবচেয়ে দামি সিগারেটের দামও ৫-৬ টাকার বেশি নয়।
- গত এক দশকে তামাকপণ্যের দাম সামান্যই বৃদ্ধি পেয়েছে, অথচ মূল্যস্ফীতির হার ছিল অনেক বেশি। ফলে তামাকপণ্যের প্রকৃত মূল্য উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। এভাবে তামাকপণ্য বিশেষ করে দরিদ্র মানুষের কাছে বেশি বেশি সহজলভ্য হয়ে গেছে।
তামাকপণ্যের কর
বাংলাদেশে তামাকপণ্যের ওপর দুই ধরনের কর প্রচলিত আছে :
- মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট-পূর্ব মূল্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক, যা বিভিন্ন তামাকপণ্য ও ব্যান্ডের জন্য ভিন্ন ভিন্ন হারে (শতাংশে) প্রযোজ্য। শস্তা পণ্য বা ব্র্যান্ডের ওপর করের হার দামি ব্র্যান্ডগুলোর তুলনায় অনেক কম।
- এছাড়া সব ধরনের তামাকপণ্যের ওপর ১৫% ভ্যাট প্রযোজ্য।
তামাকপণ্যের ওপর প্রযোজ্য করের হার গত দশ বছরে প্রায় স্থবির রয়েছে; অর্থাৎ সামান্যই বেড়েছে।
বাংলাদেশে তামাকপণ্যের ওপর করের বিদ্যমান হার : ২০১০-১১
মূল্যস্তর |
মূল্যসীমা (টাকা) |
করের হার |
মূল্যের ওপর মোট কর |
|
সমপূরক শুল্ক |
ভ্যাট |
|||
সিগারেট: লো (নিম্নমূল্য)* |
৮.৪০-৯.১৫ |
৩৩% |
১৫% |
৫৩% |
সিগারেট: মিডিয়াম (মধ্যম মূল্য)* |
১৮.৪০-১৯.০০ |
৫৩% |
১৫% |
৭৬% |
সিগারেট: হাই (উচ্চ মূল্য)* |
২৭.০০-৩২.০০ |
৫৬% |
১৫% |
৭৯% |
সিগারেট: প্রিমিয়াম (সর্বোচ্চ মূল্য)* |
৫২.০০ + |
৫৮% |
১৫% |
৮২% |
বিড়ি** |
৬.০০ (সর্বোচ্চ) |
২০% |
১৫% |
৩৮% |
জর্দা, গুল*** |
যে কোনো পরিমাণ |
২০% |
১৫% |
৩৮% |
* সিগারেটের একক ১০ শলাকা; **বিড়ির একক ২৫ শলাকা; *** ধোঁয়াবিহীন তামাক
তামাকের কর বৃদ্ধি কেন প্রয়োজন?
- তামাকপণ্যের ওপর কর বাড়ালে এর ব্যবহার কমে। বাংলাদেশে কর বাড়ানোর মাধ্যমে তামাকপণ্যের মূল্য ১০% বাড়ালে এর ব্যবহার কমবে ৩% থেকে ৬%।
- তামাকপণ্যের ওপর উচ্চহারে করারোপ জীবন বাঁচায়।
- তামাকপণ্যের ওপর উচ্চতর কর সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করবে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে আরও জানা যায়:
- দরিদ্র মানুষ আর তরুণ ছেলেমেয়েরা তামাকের মূল্যবৃদ্ধির ফলে বেশি প্রভাবিত হয়; অর্থাৎ তাদের মধ্যে এর ব্যবহার বেশি হারে কমে।
- অধিকতর করারোপের মাধ্যমে তামাকপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি করলে দরিদ্র মানুষ বেশি করে তামাক ছাড়বে এবং তার ফলে বেঁচে যাওয়া অর্থ খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মতো প্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় করতে পারবে।
- অধিকতর করারোপের মাধ্যমে তামাকপণ্যে মূল্য বৃদ্ধি করলে তরুণ ছেলেমেয়েরা তামাকসেবন শুরু করতে নিরুৎসাহিত হবে।
- তামাকের কর বৃদ্ধির ফলে এ খাতে বিদ্যমান কর্মসংস্থানের ওপর এখনই উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না, যেহেতু তামাকের কর বৃদ্ধি হবে ধীরে ধীরে অনেক বছর ধরে।
বাংলাদেশে তামাকের কর বাড়ানোর কার্যকর উপায়
বাংলাদেশে তামাকের ওপর করারোপের কার্যকারিতা নির্ভর করবে সঠিক কর নীতির ওপর। তামাকে করারোপের নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে নিচের বিষয়গুলো বিবেচনা করা প্রয়োজন :
- বাংলাদেশে তামাকপণ্যের ওপর এমনভাবে করারোপ প্রয়োজন, যাতে এসব পণ্যের প্রকৃত মূল্য (মূল্যস্ফীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে) প্রতি বছর অন্তত ৫% করে বৃদ্ধি পায়। মূল্যস্ফীতির বর্তমান হার ৭% হওয়ায় (যা বছরের বাকি সময়ে আরো বাড়তে পারে), সব ধরনের তামাক পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক বর্তমান হার থেকে ১৫% বাড়িয়ে দিলে তা তামাকের প্রকৃত মূল্যে অন্তত ৫% বৃদ্ধি নিশ্চিত করবে।
- তামাকপণ্যের ব্যবহার কমানোর সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হচ্ছে খুচরা মূল্যের উপর সম্পূরক শুল্কের হার বাড়ানো। বিভিন্ন মূল্যস্তরের জন্য ভিন্ন ভিন্ন কর হার না রেখে সব মূল্যস্তরের জন্য একই হারে কর আরোপ করা উচিত। শস্তা পণ্য/ব্র্যান্ডগুলোকে ছাড় দেয়ার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না।
- বিশেষ করে বিড়ির জন্য সম্পূরক শুল্কের সাথে নির্দিষ্ট কর (একক কর) আরোপ করতে হবে। এর ফলে এই অতি শস্তা পণ্যটির দাম এক লাফে অনেকটা বেড়ে যাবে এবং এভাবে সিগারেট ও বিড়ির মধ্যকার দামের বড় ব্যবধান অনেকটা কমে আসবে। একই ধরনের পদক্ষেপ শস্তা দামের ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে।
তামাকে করারোপ: একসাথে দুই লক্ষ্য অর্জন
তামাকপণ্যের ওপর অধিকহারে করারোপের মাধ্যমে একসাথে দুটি লক্ষ্য অর্জন সম্ভব : তামাকের ব্যবহার কমানো এবং তামাক খাত থেকে অধিক মাত্রায় রাজস্ব প্রাপ্তি। আসন্ন বাজেটে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করলে কী লাভ হতে পারে, তার কিছু হিসাব নিচে তুলে ধরা হলো।
২০১১-১২ বাজেটের জন্য প্রস্তাব ও তার সম্ভাব্য ফলাফল
কর পদক্ষেপ |
তামাকের ব্যবহারের হ্রাসের সম্ভাব্য পরিমাণ* |
তামাক থেকে বাড়তি রাজস্ব আয়ের সম্ভাব্য পরিমাণ |
সব তামাকপণ্যের ওপর অতিরিক্ত ১৫% সম্পূরক শুল্ক আরোপ |
সিগারেটের ব্যবহার কমবে: ২.৭২% (১৮০ কোটি শলাকা) বিড়ির ব্যবহার কমবে: ৪.২% (১৪১ কোটি শলাকা) |
৭৮৪ কোটি টাকা (১১.৮% প্রবৃদ্ধি)
|
(ওপরের পদক্ষেপসহ) বিড়ির ওপর প্রতি প্যাকেটে ২ টাকা হারে নির্দিষ্ট শুল্ক |
সর্বমোট ব্যবহার কমবে: ২১% (২,০৬৭ কোটি শলাকা) |
১,০২৬ কোটি টাকা (১৫.৫% প্রবৃদ্ধি) |
(চাহিদার স্থিতিস্থাপকতার হার সিগারেটের ক্ষেত্রে ‘-০.৩৯’ এবং বিড়ির ক্ষেত্রে ‘-০.৬’ ধরে হিসাব করা হয়েছে। )
* প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্তের অভাবে ধোঁয়াবিহীন তামাকের ক্ষেত্রে উপরোক্ত হিসাবগুলো করা সম্ভব হয়নি।
সারকথা :
- তামাকের ওপর কর বাড়ালে এর ব্যবহার কমবে এবং মানুষের জীবন বাঁচবে।
- তামাকের ওপর উচ্চহারে করারোপের ফলে তামাক ব্যবহারের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী বেশি উপকৃত হবে। এর ফলে তরুণ ছেলে-মেয়েরা নতুন করে তামাক ব্যবহার শুরু করবে না এবং দরিদ্র তামাকসেবীরা ছাড়তে বাধ্য হবে।
- তামাকের ওপর উচ্চহারে করারোপের ফলে এর ব্যবহার কমলেও সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে।
- তামাক থেকে অর্জিত বাড়তি রাজস্ব আয় দিয়ে সরকার তামাক ব্যবহার হ্রাস এবং জীবন বাঁচানোর জন্য তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মকাণ্ডে বেশি করে অর্থ যোগান দিতে পারবে।
গবেষণা ও সুপারিশমালা তৈরি করেছে : ‘ব্লুমবার্গ গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ টু রিডিউজ টোব্যাকো ইউজ’ এবং ‘ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো-ফ্রি কিডস’
বাংলাদেশ সময় ২০৫০ ঘণ্টা, জুন ০৬, ২০১১