আকাশে আষাঢ় এলো; বাংলাদেশ বর্ষায় বিহবল।
মেঘবর্ণ মেঘনার তীরে তীরে নারকেলসারি
বৃষ্টিতে ধূমল; পদ্মাপ্রান্তে শতাব্দীর রাজবাড়ি
বিলুপ্তির প্রত্যাশায় দৃশ্যপট-সম অচঞ্চল।
না, কবিতার স্তবকটি কবিদের গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নয়; তিরিশের পঞ্চপাণ্ডবদের একজন বুদ্ধদেব বসুর। এখানে বৃষ্টিবিহ্বল, বৃষ্টিতে ধূমল সজল বাংলাদেশের ছবি পাই। আর সে ছবি বর্ষাকালের। নিটোল-নিবিড়-অবিকৃত প্রকৃতির লাবণ্যস্নিগ্ধ এক বর্ষাকালের।
এসেছে আষাঢ় মাস---আষাঢ়স্য প্রথম দিবসটিতে বাংলাদেশ পা রাখলো বর্ষার বৃষ্টিধূমল চৌকাঠে । তবে রবি ঠাকুর বা বুদ্ধদেব বসুদের সময়কার অনাবিল বর্ষাকাল এখন আর তেমনভাবে পাবো না। পাবো না সে অদূষিত বৃষ্টিধারা ---অনাবিল খরবেগ নদী। অগত্যা তাই নানা বর্জ্যে-কেমিক্যালে-দুর্গন্ধে আবিল খালবিল নদীনালা আর বিচিত্র ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন আকাশ স্বাগত জানালো বর্ষাকে।
বুড়িগঙ্গা তুরাগ বালুনদী এখন বর্জ্যের ভাগাড়, পদ্মার উপর বইছে লু-হাওয়া। চোখে রূপের অঞ্জন বোলানোর কথা জলভারানত শ্যামল তরুছায়াঘন মেদুর বাংলাদেশের ছবি; সেখানে মাইলের পর মাইল জলহীন ধূ-ধূ প্রান্তরের করাল রূপ গ্রাস করবে দৃষ্টিকে। এর নগ্ন-নিরেট বাস্তব ছবিটা পাওয়া যাবে বিশীর্ণ পদ্মার বিস্তীর্ণ করুণতার দিকে তাকালে। সেখানে চাকা ঘুরছে মাটি আর বালুবাহী ৫টনি ট্রাকের। ওপারে ফারাক্কা নামের দৈত্য টুঁটি টিপে মারতে উদ্যত বাংলার আরো কতো শত নদী-শাখা নদী খালবিলের। বর্ষা এসেছে, সে খানিকটা জল বিলাবে ওদের বুকে----এটুকু আশায় বুক বেঁধে আছে বাংলাদেশ।
‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ’--বর্ষার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে এমন আনন্দে ময়ূরের মতো নেচে ওঠার দিন শেষ । কৃশতনু নদীর ধারে দাঁড়িয়ে, মরানদীর ধুলায় ধূসর বুকের ওপর দিয়ে চলমান গো-শকটের ওপর বসে কপাল চাপড়ালেও বরষানিমগন সেই অতীত ফিরে আসবে না তার সনাতনী রূপে।
তবু কদম কেতকী ফুটবে, আকাশজুড়ে চলবে মেঘের আনাগোনা দ্রিমিকি দ্রিমিকি রবে। এমন দিনে ‘মুহূর্তে আকাশ ঘিরি রচিল সজল মেঘস্তর` আর তাতে ‘রিক্ত যত নদীপথ’ ভরে যাবে ‘অমৃতপ্রবাহে’। ...মরুবক্ষে তৃণরাজি/পেতে দিল আজি/শ্যাম আস্তরণ। ...গুরুগুরু মেঘগর্জে ভরিয়া উঠিল বিশ্বময়। ’
--এমন গভীর আর সর্বব্যাপী বাণী কেবল শোনাতে পারেন একজন । তিনি আমাদের পিতার পিতা, পিতামহেরও পিতামহ, চিরকালের পথপ্রদর্শক----একমেবাদ্বিতীয়ম মহামহিম রবীন্দ্রনাথ!
বাঙালির কোনো গতি নেই রবীন্দ্রনাথ ছাড়া। সম্পদে বিপদে তিনি আছেন ছায়ার মতো।
আজ যন্ত্রের শাসনে চলে গেছে পৃথিবী, এঞ্জিনের উল্লাসের নীচে চাপা পড়ে যাচ্ছে মানুষের মৌলিক আবেগ, সমস্ত পৃথিবীজুড়ে জ্বলছে কেবল সৈন্যদের মশালের রঙ; এখন ইরাকে, আফগানিস্তানে, ইয়েমেনে, সোমালিয়ায় বেজে চলেছে যুদ্ধের দামামা, দলে দলে মরছে মানুষ। এদিকে বিমানবাহী রণতরীর ওপর বসে ক্ষেপণাস্ত্রের বোতামে আঙুল রেখে কফি খাচ্ছে কেউ কেউ। নিউইয়র্ক ওয়াশিংটন প্যারিস রোমের কাচঘেরা প্রাসাদে আকর্ণবিস্তৃত বিকৃত হাসিতে ফেটে পড়ছে একালের সমরবাজেরা।
বাংলাদেশে আষাঢ়ের প্রথম দিবসটি যখন প্রাণজুড়ানো বৃষ্টির ফোটা ঝরাবে , শিথিল করবে প্রাণমন, তখন ‘তৃতীয় বিশ্ব’ নামের তকমায় আঁটা দরিদ্র পৃথিবীর কোনো পার্বত্য গ্রামের ঘুমন্ত অসহায় নারীশিশুবৃদ্ধদের ওপর ক্ষেপণাস্ত্রের বৃষ্টি ঝরাবে ‘ড্রোন’ নামের মানববিহীন যুদ্ধবিমান। কদম ফুলের পাপড়ি ঝরা দেখতে দেখতে বৃষ্টির টুপটাপ সঙ্গীতে অলস কান পেতে দিতে দিতে যখন আপনি শুনবেন টেলিভিশনে এসব মৃত্যুর খবর তখন আষাঢ়ের বন্দনা করতে আপনার মন সায় দেবে তো?
এখানেও পথের সখা রবীন্দ্রনাথ! এতো মৃত্যু এতো শোকতাপ এতো বেদনা দহনেও তিনি আমাদের দেখান জীবনের পথ খুঁজে নেবার পথ। আর নজরুল বলেছেন ‘জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি। ’
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর এতো এতো দিন পরও, বুঝতে পারছি, বাংলাকে আর বাংলার ছয়টি ঋতুর ঐশ্বর্যকে, তাদের বিচিত্র রূপ-সুষমাকে তার মতো আর কেউই ফুটিয়ে তোলেননি। রবি ঠাকুরের কবিতায় বরষা এসেছে সামগ্রিক রূপবিভঙ্গে। আষাঢ়ের প্রথম দিবসটিকে তিনি তুলে এনেছেন এভাবে:
নব বরষার দিন
বিশ্বলক্ষ্মী তুমি আজ নবীন গৌরবে সমাসীন
রিক্ত তপ্ত দিবসের নীরব প্রহরে
ধরণীর দৈন্য `পরে
ছিলে তপস্যায় রত
রুদ্রের চরণতলে নত।
উপবাসশীর্ণ তনু, পিঙ্গল জটিল কেশপাশ,
উত্তপ্ত নিঃশ্বাস।
দুঃখেরে করিলে দগ্ধ দুঃখেরি দহনে
অহনে অহনে;
শুষ্কেরে জ্বালায়ে তীব্র অগ্নিশিখারূপে
ভস্ম করি দিলে তারে তোমার পূজার পুণ্যধূপে।
কালোরে করিলে আলো,
নিস্তেজেরে করিলে তেজালো;
নির্মম ত্যাগের হোমানলে
সম্ভোগের আবর্জনা লুপ্ত হয়ে গেল পলে পলে।
অবশেষে দেখা দিল রুদ্রের উদার প্রসন্নতা
বিপুল দাক্ষিণ্যে অবনতা
উৎকণ্ঠিতা ধরণীর পানে।
নির্মল নবীন প্রাণে
অরণ্যানী
লভিল আপন বাণী।
দেবতার বর
মুহূর্তে আকাশ ঘিরি রচিল সজল মেঘস্তর।
মরুবক্ষে তৃণরাজি
পেতে দিল আজি
শ্যাম আস্তরণ,
নেমে এল তার`পরে সুন্দরের করুণ চরণ
সফল তপস্যা তব
জীর্ণতারে সমর্পিল রূপ অভিনব;মলিন দৈন্যের লজ্জা ঘুচাইয়া
নব ধারাজলে তারে স্নাত করি দিলে মুছাইয়া
কলঙ্কের গ্লানি;
দীপ্ততেজে নৈরাশ্যের হানি
উদ্বেল উৎসাহে
রিক্ত যত নদীপথ ভরি দিল অমৃতপ্রবাহে।
জয় তব জয়
গুরুগুরু মেঘগর্জে ভরিয়া উঠিল বিশ্বময়। ...
শোকতাপ দূরে সরিয়ে রেখে বরষার দিকে না তাকিয়ে উপায় নেই বাঙালির। কারণ বাঙালির মনের সব মেদুরতা এই বরষা থেকেই পাওয়া। বাঙালির ঘরে নুন আনতে পান্তা যতোই ফুরাক, বর্ষার ঘনঘোর বাদল-পিছল দিনে সে বলবেই : এমন দিনে তারে বলা যায়/এমন ঘন ঘোর বরষায়...
আর শুধু কী বাঙালি ? স্বয়ং মহাকবি কালিদাস তো বরষার বন্দনায় রচনা করে গেছেন আস্ত এক ‘মেঘদূত’। মেঘকে তিনি দেখিয়েছেন প্রেমের বার্তাবাহক হিসেবে। আষাঢ়ের প্রথম দিনটিতেই বিরহী যক্ষ মেঘকে দূত করে পাঠিয়েছিল তার প্রিয়ার কাছে। আর তার সে কী আকুতি!
ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মন্দাক্রান্তা ছন্দে লেখা ‘যক্ষের নিবেদন’ নামের একটি কবিতায় পাই তারই অসাধারণ অভূতপূর্ব ব্যঞ্জনা:
‘পিঙ্গল বিহ্বল ব্যথিত নভতল কই গো কই মেঘ উদয় হও/ সন্ধ্যার তন্দ্রার মুরতি ধরি আজ মন্দ্র মন্থর বচন কও’
আর জয়দেবের গীতগোবিন্দে পাই মেঘমেদুর বরষায় শ্যামল বনভূমি আর তমাল তরুছায়াঘন পৃথিবীর নয়ন মনোহর রূপ: মেঘৈর্মেদুরম্বমবনভুবশ্যামন্তরালমালদ্রুমৈ..
আমরা চাই আমাদের পৃথিবী ভরে উঠুক তরুলতায়, ফলে ফুলে, নদী ফিরে পাক তার জীবন, পদ্মা মেঘনা সুরমা কপোতাক্ষ মগরা ধনু জলাঙ্গী মধুমতি মুক্তি পাক দখলদারদের কালো থাবা থেকে, কারখানার বর্জ্য আর কেমিক্যালের অত্যাচার বন্ধ হোক চিরতরে, স্বচ্ছতোয়া নদীজলে মাছেরা উলাস দিক অতীতের মতো ।
কিন্তু এখন নদী মরে যাচ্ছে বর্জ্যের বিষে, সংকুচিত হচ্ছে তার আয়তন, হারিয়ে যাচ্ছে অসংখ্য মিঠাপানির মাছ। গোটা দেশের প্রকৃতি হয়ে উঠছে বিরূপ, দ্রুত মরুময় হয়ে উঠছে চারপাশ, রুক্ষ ঊষর এক বৈরিতার ঘেরাটোপ আমাদের জীবনকে ঘিরে ফেলছে ক্রমশ। এর ফলে ঋতুর স্বাভাবিক গতিও ব্যাহত হচ্ছে। যখন যে ঋতু আসার কথা সেটা আর আগের নিয়মে হচ্ছে না। অথচ আমরা সবাই বলছি: ‘চাই স্বাস্থ্য চাই বল্/ আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু...।
আমাদের এক হাতে প্রকৃতিকে ধ্বংসের করাল খঞ্জর আর অন্য হাতে প্রকৃতিপ্রেমের রুমাল।
আমরা একই সঙ্গে ধরে আছি মধু ও বিষের পেয়ালা। আমরা চাইছি ফুল-ফল-তরুছায়া আর করে চলেছি তরুর বিনাশ। আমাদের এই স্ববিরোধিতা কবে শেষ হবে? আষাঢ়ের প্রথম দিবসটিতে শুরু হোক আমাদের স্ববিরোধিতা অবসানের প্রথম পদক্ষেপ। ধুয়ে মুছে যাক যতো গ্লানি।
আষাঢ়স্য প্রথম দিবসকে বরণ করে নেবার সামর্থ্য হোক আমাদের সবার। দারিদ্র্য বঞ্চনা আর বৈষম্যের অবসান ঘটুক আমাদের জাতির জীবনে। কদম কেতকী আর মেঘমেদুর বরষার অমল রূপের মাধুরীতে ভরে উঠুক আমাদের চারপাশ। সবাই পাক ভাত কাপড় আর ঘর, সবাই পাক শিক্ষা আর কাজের সুযোগ, নিজের পায়ে দাঁড়াবার সুযোগ। অজ্ঞানতা আর কুসংস্কারমুক্ত, মানবতাবোধ আর বিজ্ঞানের আলো-উদ্ভাসিত এক জীবনের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হোক। তবেই বর্ষার রূপশোভা ডানা মেলবে, নীপবন- ছায়াবীথি আমাদের সবার হবে। তা না হলে বর্ষার রূপসুষমা পাবো না তো শত বরষায়...
আষাঢ়-দিনের বর্ষাবন্দনা অদ্ভুত, মিথ্যা, অলীক আর আষাঢ়ে গল্প হয়েই থাকবে।
সবশেষে একবার পড়ে নেওয়া যাক রবীন্দ্রনাথের `আষাঢ়` কবিতাটি :
নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।
বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর,
আউশের ক্ষেত জলে ভরভর,
কালি-মাখা মেঘে ও পারে আঁধার ঘনায়েছে দেখ্ চাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে। ।
ওই ডাকে শোনো ধেনু ঘনঘন, ধবলীরে আনো গোহালে।
এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু পোহালে।
দুয়ারে দাঁড়ায়ে ওগো দেখ্ দেখি
মাঠে গেছে যারা তারা ফিরিছে কি,
রাখালবালক কী জানি কোথায় সারা দিন আজি খোয়ালে।
এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু পোহালে। ।
শোনো শোনো ওই পারে যাবে বলে কে ডাকিছে বুঝি মাঝিরে।
খেয়া-পারাপার বন্ধ হয়েছে আজি রে।
পুবে হাওয়া বয়, কূলে নেই কেউ,
দু কূল বাহিয়া উঠে পড়ে ঢেউ,
দরদর বেগে জলে পড়ি জল ছলছল উঠে বাজি রে।
খেয়া-পারাপার বন্ধ হয়েছে আজি রে। ।
ওগো, আজ তোরা যাস নে গো, তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।
আকাশ আঁধার, বেলা বেশি আর নাহি রে।
ঝরঝর ধারে ভিজিবে নিচোল,
ঘাটে যেতে পথ হয়েছে পিছল,
ওই বেণুবন দুলে ঘনঘন পথপাশে দেখ্ চাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে। ।
- শিলাইদহ
২০ জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৭