ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা

এ দেশ গভীর ভালোবাসা ও বন্ধনের || মুফতি এনায়েতুল্লাহ

... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৪৩ ঘণ্টা, মার্চ ৩, ২০১৬
এ দেশ গভীর ভালোবাসা ও বন্ধনের || মুফতি এনায়েতুল্লাহ

সময়ের হিসেবে আমার জন্ম স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রায় এক দশক পর। আমি জন্মেছি স্বাধীন ভূমিতে।

নিঃশ্বাস ফেলেছি মুক্ত দেশে। পতপত করে উড়তে দেখেছি লাল সবুজের গর্বিত পতাকা। আধো আধো বুলিতে মা-বাবা বলার পর অন্য আট-দশটা বাক্যের সঙ্গে কণ্ঠে তুলেছি অমর সঙ্গীত- ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। ’

গ্রামের শৈশবে দেখেছি গাছের ডালে ডালে পাখিদের মেলা, কিচির-মিচির সন্ধ্যা। বিকেলে ঘর ফেরত রাখালের সামনে বাধ্য-অবাধ্য গরু-ছাগলের পাল। হাঁটু অবধি কাপড় তোলা রাখালের হাতে লাঠি, মাথায় বাঁধা গামছা। কণ্ঠে তার সেই অজেয় সঙ্গীত- ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। ’

ঢেউ তোলা নদীতে চলা মাঝি থেকে শুরু করে ফসলের মাঠের কৃষক-কৃষাণীর মুখেও শুনেছি হৃদয়ের স্পন্দন জাগানিয়া ওই গান। যে গানের অপূর্ব সুরে দুরন্ত কিশোরের মতো উচ্ছ্বলতায় মোহময় হয়ে ওঠে সকল নাগরিকের প্রশান্ত হৃদয়। বুকের মাঝে সৃষ্টি করে ভিন্ন এক প্রবাহ। সবই দেশকে ভালোবাসার ও বন্ধনের চিত্র। হৃদয়ে বাংলাদেশকে লালন করার কাব্যবিশেষ।

শিক্ষক বাবার কনিষ্ঠ সন্তান হিসেবে পরিবারের বড় ৪ ভাই, ২ বোন ও মায়ের শাসন-সোহাগে আমার আনুষ্ঠানিক শিক্ষার হাতেখড়ির হিসেব কোথাও সংরক্ষিত হয়নি। তবে জীবনের প্রথমবার একজন মুক্তিযোদ্ধাকে দেখার, তার গলায় ফুলের মালা পরানোর অনুভূতি হৃদয়ে এখনও সজীব হয়ে আছে।

আমার বয়স তখন আট। বাড়ির পাশের আমার পাঠশালা- নরকোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। অন্যদের স্কুলে যাওয়া-আসার রুটিন থাকলেও আমার কোনো রুটিন ছিলো না। কোনো ড্রেসকোডও ফলো করতে হতো না। ইচ্ছা হলো, চলো। গা উদোম বা গেঞ্জি জড়ানো, ওসব দেখার সময় কই? মানচিত্রের হিসেবে আমাদের গ্রামের অবস্থান ময়মনসিংহ জেলার একেবারে পশ্চিম প্রান্তে। উন্নয়নের ছোয়াঁ তখনও খুব একটা লাগেনি। মাইকের ব্যবহার আরও অনেক পরে আসে এদিকটায়। মুখে ফুঁকানো টিনের লম্বা চোঙ্গা দিয়ে আওয়াজ দূরে পৌঁছানোর প্রয়োজনীয় কাজটি সারতে হয়। স্কুল লাগোয়া বিশাল মাঠের একপাশে বাঁশঝাড়, বিশাল বট গাছ, তার সামনে আরও কয়েকটি আম-কাঠালের গাছ। আশেপাশে বাড়ি-ঘর নেই। পায়ে হাঁটা সরু রাস্তার ধারে টিনের মসজিদ। রাস্তার দু’পাশে নাম না জানা লতা-পাতা ও কাঁটা গাছের ঝোপ-ঝাড়। এখন কল্পনা করলে ভয়ে শরীর হিম হয়ে যায়। কিন্তু সাত-আট বছরের কিশোর মনে তখন এসবের জায়গা কই?

হঠাৎ শুনি আমাদের স্কুলে অনুষ্ঠান হবে। চারদিকে একটা সাজসাজ রব। আনুষ্ঠানিকভাবে তখন আমি ছাত্র, দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি। ক্লাসের সর্বকনিষ্ঠ বিদ্যার্থী হওয়ার পরও পারিবারিক প্রভাব ও কয়েকজন শিক্ষক আত্মীয় হওয়ার সুবাধে অনেক বাড়তি সুবিধা ভোগ করি। এমন বাড়তি সুবিধার গল্পই আজকের লেখার আলোচ্য বিষয়।

স্কুলের অনুষ্ঠান উপলক্ষে নানা রঙের কাগজ কেটে তা সুতলিতে লাগিয়ে পুরো মাঠ সাজানো হলো। মাঠের মাঝে পতপত করে উড়ছে নতুন বাঁশে লাগানো- নতুন জাতীয় পতাকা। এলো কথা বলার জন্য লম্বা চোঙ্গা। সেই চোঙ্গা দিয়ে থেমে থেমে ঘোষণা করা হচ্ছে অনুষ্ঠানের অতিথিদের নাম। একে একে অতিথিরা স্কুলের বারান্দার চেয়ারে বসছেন। সবার নাম বলা হচ্ছে, হঠাৎ একটু ভিন্নভাবে বলা হলো- একটি নাম। নামের শুরুতে বলা হলো- বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং আমিই তাকে মালা পরাব।

মালা হাতে আমার মাথায় হাজারো চিন্তা-প্রশ্ন ও ভাবনা ঘুরপাক খেতে লাগল। তিনি মুক্তিযোদ্ধা, দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন, তিনি শত্রুদের মেরেছেন, তিনি বন্দুক চালাতে পারেন, তার অনেক শক্তি, তাকে কেউ হারাতে পারবে না। এমন অজস্র প্রশ্ন মাথায় নিয়ে তাকে মালা দিলাম। অনুষ্ঠান শেষে আবার তার কাছে গেলাম। তিনি আমার পরিচয় আগেই জেনেছেন। আমাকে কাছে পেয়ে অনেক আদর করলেন। আমি সেসবের তোয়াক্কা না করে বললাম, আপনার বন্দুক কই? দেখি?

তিনি হাসলেন, বললেন, ওটা জমা দিয়ে দিয়েছি। আমি বন্দুক জমা দেওয়ার আগামাথা কিছুই জানি না। শুধু মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো, বন্দুক দেখতে না পেরে। আমি ভাইদের কাছে, মায়ের কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনেছি, যে পাঞ্জাবি সেনাদের ভয় দেখিয়ে আমাদের ঘুম পাড়ানো হতো, যে পাকিস্তানি মিলিটারিরা আমাদের পাশের গ্রাম মির্জাকান্দা ও মানকোনে অনেক মানুষ হত্যা করেছে, লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করেছে, বড়গ্রামের হিন্দু বাড়ি লুট করেছে, আগুন দিয়েছে, চরাঘাটের ব্রিজ ভেঙেছে। তাদেরকে তাড়িয়েছে এই মুক্তিযোদ্ধারা। তারা আমাদের দেশের জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। সেই মুক্তিযোদ্ধার কাছে বন্দুক থাকবে না; তা কি হয়?

ওই অনুষ্ঠানের পর থেকে আমার ইজ্জত সমবয়সীদের কাছে কিছুটা বেড়ে যায়। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মান জানানোর প্রেক্ষিতে আমার অর্জিত এ সম্মান জীবনের প্রথম অর্জন। এটা আমার মনে এখনও বিশাল জায়গা দখল করে আছে।
 
যে দেশের নাগরিকেরা মনের গহীনে তাদের কৃতি সন্তানদের প্রতি এমন সম্মান লালন করেন, যে দেশের শিল্পীর কণ্ঠে ঢেউ তোলে হৃদয়তন্ত্রী জাগানো জাতীয় সঙ্গীত- সে দেশকে নিয়ে কোনো পরাশক্তির কোনো ষড়যন্ত্রই সফল হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। এ সম্মান ভালাবাসার, এ সম্মান আত্মার বন্ধনের।
 
একটি রাষ্ট্রে নাগরিকদের ধর্ম বা ভাষার পার্থক্য থাকতে পারে। তাদের নিজস্ব নিয়ম-কানুনও থাকা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্ত ভালোবাসার বন্ধন আর সম্মান অভিন্ন। সার্বভৌমের প্রতি দায়বোধ থেকে এটা জন্ম নেয়। এই অভিন্ন বন্ধন তখনই দৃঢ় হবে, যখন ওই দেশপ্রেমিক নাগরিকদের সম্মান জানানোর রীতি প্রতিষ্ঠিত হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, সম্মান যেমন আক্ষরিক অর্থে হয়, তেমনি হয় তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে। তাদের কৃত কাজের সুন্দর পরিসমাপ্তি করে, তাদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন করে। এ ধারণাটির পেছনে ঐতিহাসিক সত্য বিদ্যমান।

পশ্চিম পাকিস্তানিদের জুলুমের বিরূদ্ধে বংলাদেশের জনগণ একত্রে রুখে দাঁড়িয়েছিল, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রাম করে জীবন দিয়েছিল। তাদের লক্ষ্য ছিলো- জাতির কল্যাণ। তাই আমাদেরও ঐক্যবদ্ধভাবে জাতিকে কল্যাণের পথে নিয়ে যেতে হবে, মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কোনো বিকল্প পথ নেই।

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এ দেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ যুগ যুগ ধরে বসবাস করছে মমতা আর ভালোবাসার বন্ধনে, আমরা সবাই বাংলাদেশি এই পরিচয়কে ধারণ করে। এ দেশ মমতার দেশ, এ দেশ ভালোবাসার দেশ। ওপরের উদার নীল আসমান আর নিচের সবুজ জমিনের মতোই দলমত নির্বিশেষে ঐক্যের বন্ধনে বাঁধা এদেশের মানুষের হৃদয়। বাংলাদেশের মানুষের এ চরিত্রকে সূর্যের মাঝে লুকানো সাতটি রঙের সঙ্গে তুলনা করা যায়। আকাশে রঙধনু উঠলেই শুধু পৃথিবীবাসী দেখতে পায় সূর্যের সাতটি রঙ। অন্য সময় ঐক্যের প্রতীক সূর্যের সাদা রঙই তারা প্রত্যক্ষ করে।

পলি কাদামাটির মতোই এ দেশের মানুষের অন্তর। তারা নীরবে-নিভৃতে অনেক অত্যাচার অনাচার সহ্য করে, কিন্তু যখন জেগে ওঠে পোড়া মাটির ইটের মতোই শক্ত হয়ে যায়। বুলেট বোমাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে অন্যায়ের প্রতিবাদ জানায়, ধ্বংসস্তুপের ওপর বিজয় নিশান উড়ায়। এর প্রমাণ তারা দিয়েছে ১৯৫২, ৫৪, ৬৯, ৭১-এ।

৭১’এর মার্চে শুরু হওয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষ হয়েছে সত্য। স্বাধীনতা সংগ্রাম আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে। আমরা পেয়েছিও অনেক কিছু। তবে হারানোর তালিকাও একেবারে ছোট্ট নয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে হারানো ৩০ লাখ শহীদ, ২ লাখ ইজ্জত হারানো আমার মা-বোন, অঙ্গ হারানো অসংখ্য যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, সহায়-সম্পদ হারিয়ে আমার প্রতিবেশী সংখ্যালঘুদের বেদনা চাইলেই দূর করা সম্ভব নয়। এসব হারানোর বেদনাকে শক্তিতে পরিণত করে, স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করাই এখন আমাদের কাজ।

আমরা জানি, স্বাধীনতা অর্জন করার চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। তাই সকল বিভেদ ভুলে ঐক্য ও সংহতির শক্তিতে বলীয়ান হয়ে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার পথে এগিয়ে যেতে হবে আমাদের। এগিয়ে যাওয়ার কাঙ্ক্ষিত এ পথে দেশের প্রতি ভালোবাসা, সম্মানবোধ ও পরস্পরের বন্ধন হোক পরম পাথেয়। শুধু চলতি মার্চ মাসে নয়, এ চাওয়া হোক সবসময়ের।

লেখক: বিভাগীয় সম্পাদক, ইসলাম, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ৩, ২০১৫
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।