ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

আমাদের মিডিয়াভুবন : একটি সমালোচনা

ড. ফজলুল হক সৈকত | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০১ ঘণ্টা, জুলাই ৬, ২০১১
আমাদের মিডিয়াভুবন : একটি সমালোচনা

সভ্যতা এবং সংস্কৃতির সাথে প্রচার, প্রচারব্যবস্থা, প্রচারমাধ্যম প্রভৃতি শব্দাবলি নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। বর্তমান বিশ্বে শিক্ষা এবং সংস্কৃতির ধারা ও রূপ পরিবর্তন-পরিবর্ধন ও পরিমার্জনে মিডিয়া বা প্রচারমাধ্যম বিশেষ ভূমিকা রাখছে।

একটা সময় ছিল যখন মিডিয়া কেবল খবর প্রদান করতো আর বিনোদন উপহার দিত; কিন্তু কালক্রমে এ মাধ্যমটি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে বদলে নিয়েছে তার অবস্থান, মর্যাদা এবং অবদানের জায়গাগুলো। ছাপাখানার উদ্ভব ও বিকাশের সাথে যেমন মিশে আছে পৃথিবীর সভ্যতানির্মিতির কতগুলো সুনির্দিষ্ট ধাপ, তেমনি রেডিও, টেলিভিশন, কম্পিউটার (ইন্টারনেট তো আরেকটি চমক) প্রভৃতি ইলেকট্রনিক মিডিয়া মানবজীবনে এনে দিয়েছে বিস্ময়কর পরিবর্তন। মনের ক্লান্তিমোচনের দায় থেকে এখন এসব মাধ্যম ও ব্যবস্থা মানুষের চিন্তার স্থানটিতে আসন গেড়েছে অনিবার্যভাবে। তাই, বর্তমানে মিডিয়াভাবনাকে বাদ রেখে কোনো দেশ বা জাতির শিক্ষা ও সংস্কৃতির আলোচনাও প্রায় থেকে যায় অপূর্ণ।

ব্যাপক অর্থে মিডিয়ার লক্ষ্য জনগণকে কোনো বিষয় অবহিত করা, বিনোদন দেওয়া, চিন্তাকে প্রভাবিত করা এবং অনুভূতি ও সক্রিয়তাকে প্রভাবিত করা। এই যোগাযোগ প্রক্রিয়ায়, তা হোক  লিখিত অথবা মৌখিক অথবা নিঃশব্দ, তাতে সম্পৃক্ত থাকে একজন প্রেরক এবং একজন গ্রাহক। কাজেই বার্তা কিংবা বিনোদন প্রেরণ ও গ্রহণের ক্ষেত্রে এই দুই শ্রেণীর মানুষের যোগাযোগের সামর্থ্য ও রুচিবোধকে অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে। আর দেখতে হবে গ্রাহকের চাহিদা এবং আনন্দের জায়গাগুলো।

জাতি বা রাষ্ট্রের কর্মবলয় বৃদ্ধি পাওয়ায় কিংবা শিক্ষা বিকশিত হওয়ায় অগণন মানুষ পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ভ্রমণ করার মাধ্যমে সংবাদসংগ্রহের উন্নত ধরনের উপায়ও সৃষ্টি করেছে। আধুনিক আবিষ্কার- যেমন মুদ্রণযন্ত্র, জাহাজ, রেলপথ, বিমান, টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, রেডিও, টেলিভিশন, ইন্টারনেট, উপগ্রহ ইত্যাদি- সংবাদসংগ্রহ, প্রচার ও সম্প্রচারে অভিনব সব মাত্রা যোগ করেছে। এই সব আবিষ্কার বিশ্বকে বদলে দিতে সহায়তা করেছে। গণমাধ্যমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে সংবাদ। মানুষ জানতে চায় তাদের চারপাশে কী ঘটছে। সংবাদ তাদের দুনিয়ার সঙ্গে যুক্ত করে। জানিয়ে দেয় কোথায় কী ঘটছে। সংবাদ মানুষকে এটা অনুভব করতে শেখায় যে, তারা জনমানুষের একটি বৃহত্তর আন্তর্জালের (নেটওয়ার্ক) অংশ বা বৃহত্তর সম্প্রদায়ের অঙ্গ। সংবাদের আয়ু খুবই স্বল্পস্থায়ী। গতকালের সংবাদের চেয়ে বাসি আর কোনও কিছুই নয়। তাই সংবাদের বেলায় মোক্ষম সময়টা হচ্ছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যদি ঠিক সময়ে পরিবেশন করা না যায়, তাহলে সংবাদ আর সংবাদ থাকে না।

অদক্ষ ও অনভিজ্ঞ সাংবাদিকতা বাংলাদেশে প্রচারমাধ্যমের একটি বড় সংকট। দু-একটি জাতীয় দৈনিক বা সাপ্তাহিক পত্রিকা বাদ দিলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কাজ করে নবাগত কর্মীরা। অনেকেরই আবার সাংবাদিকতা বা গণযোগাযোগ বিষয়ে অ্যাকাডেমিক লেখাপড়া নেই। কোনো কোনো টেলিভিশন চ্যানেলে দেখা যায় সিনিয়র রিপোর্টার বলে যাদের অভিহিত করা হয়, তাদের বয়সও বেশ কম, অভিজ্ঞতার কথা না হয় না-ই ধরলাম! আবার দেশ-জাতি-বিশ্ব সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মাঝে মাঝে অভিজ্ঞ-বয়স্ক ব্যক্তির সাথে কথোপকথনে মিলিত হন এমন সব উপস্থাপক যাদের বয়স-অভিজ্ঞা অতি নগণ্য; কেবল চাকরিসূত্রে তারা পালন করছেন চাপিয়ে দেওয়া অথবা গ্রহণ করা দায়িত্ব। এভাবে আর যা-ই হোক পেশাদারিত্বকে সম্মান করা হয় না। বর্তমানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মিডিয়া ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাওয়ায় কিংবা বলা চলে ব্যবসায়ীদের ওপর বেশিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় পরিবেশনার মানের চেয়ে আর্থিক লাভের বিষয়টি প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন বিভাগ ও দফতরে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়োগ না দিয়ে অপেক্ষাকৃত নবীন ও শিক্ষনবিশদের চাকরি দেওয়া হচ্ছে। এতে কোম্পানির প্রোডাকশন খরচ কমছে। কিছু অনভিজ্ঞ লোককে চাকরি দেওয়া যেতেই পাওে, এরও প্রয়োজন আছে। কিন্তু বিশিষ্ট কোনো সাহিত্যিককে সাহিত্যপাতার সম্পাদনার দায়িত্ব না দিয়ে কিংবা নারী অধিকারবিষয়ক কোনো অনুষ্ঠান পরিচালনা বা উপস্থাপনায় কোনো বিশেষজ্ঞকে না ডেকে একজন নবীন উন্নয়নকর্মীকে দিয়ে সে কাজ সম্পন্ন করলে শিল্প এবং প্রচার কোনোটাই কাক্সিক্ষত মানের হবে না। মনে রাখতে হবে, সফল মিডিয়াকর্মী হিসেবে কোনো একজন ব্যক্তি যতটা না চাকরি করেন, তার চেয়ে ঢের বেশি তিনি তার নেশার জগতে পরিভ্রমণ করে থাকেন। ওই ব্যাপারটি না বুঝলে মিডিয়া, মিডিয়াকর্মী ও ভোক্তা সবারই ক্ষতি।

বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বয়স এবং অভিজ্ঞতাও খুব কম। বেসরকারি পর্যায়ে টেলিভিশন ও রেডিও চালু হয় মাত্র দশ-বারো বছর আগে। শুধু প্রযুক্তিসুবিধার ওপর নির্ভর করে টেলিভিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রচারমাধ্যম চলতে গেলে বিপদে পড়ার (অথবা দর্শক-শ্রোতাদের বিপদে ফেলার, এমনকি বিপথে চালিত করার) ঝুঁকিও রয়ে যায় বৈকি! দক্ষ জনশক্তি এবং অনুষ্ঠানবিষয়ক গবেষণামুখী নির্ভরযোগ্য কর্মীর এখনও অভাব রয়েছে। টাকা থাকলে ব্যবসা করা চলে; তবে মনে রাখতে হবে কাঁচাবাজারের ব্যবসা আর শিক্ষা ও শিল্পের বাণিজ্য এক বস্তু নয়। বিশেষত, সবজি-মাছ প্রভৃতির বাজার এবং টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রপাড়া একই স্থানে অর্থাৎ কারওয়ানবাজারে অবস্থিত হওয়ায় আমরা যেন সব বাণিজ্যকে এক কাতারে ফেলে বিচার না করি।

ইতিবাচক মনোভঙ্গি নিয়ে ব্যাপকভাবে অগ্রসর হচ্ছে না আমাদের দেশের প্রচারমাধ্যমের কার্যাবলি; নেতিবাচক খবরকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় কোনো একটি উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জ্ঞানবিষয়ক আন্তর্জাতিক সেমিনার বা আলোচনাসভার নিউজ হয়তো ছাপা হয় ভেতরের কোনো পাতায় এক ইঞ্চি এক কলামে, আর ওই প্রতিষ্ঠানে দুটি রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মধ্যে অথবা বহিরাগত সন্ত্রাসীদের অপকর্মের খবর স্থান পায় বিশেষ মর্যাদায় প্রধান শিরোনাম হয়ে প্রথম পাতায়! আবার কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জনবল নিয়োগের অনিয়ম নিয়ে মিডিয়াকর্মীদের যত মাথাব্যাথা, সে তুলনায় ওই প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাডেমিক স্থবিরতা বিষয়ে তাদের কোনো উদ্বেগ দেখা যায় না। পেশাদারিত্ব, আদর্শ ও কমিটমেন্ট সাংবাদিকতার প্রধান অনুষঙ্গ হলেও বাংলাদেশে তা বিরলপ্রায়। সংবাদ ও অনুষ্ঠান পরিবেশন এবং উপস্থাপনায় অনভিজ্ঞ ও অযোগ্য ব্যক্তিরা অনেকটা জায়গা করে নিয়েছে। দলীয় পরিচয় কিংবা ব্যক্তিগত সম্পর্কের জোরে কেউ কেউ এসব প্রতিষ্ঠানে চাকরি জোগাড় করলেও দায়িত্বজ্ঞানের ও সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে।

ভাষাদক্ষতা একটি প্রচারমাধ্যমের জন্য অত্যন্ত জরুরি প্রসঙ্গ হলেও এ দিকটি আমাদের দেশের মিডিয়া-পরিচালক বা মালিকপক্ষ খুব বেশি আমলে নেন বলে মনে হয় না। প্রকাশমাধ্যমে বানান সতর্কতা এবং উচ্চারণশৈলী একটি জাতিকে দিতে পারে বিশেষ মর্যাদা। আমরা প্রায়শই লক্ষ করি ভুল বানানে খবর প্রকাশ হয়! কথা বলার মতো ভোকাল নেই এমন ব্যক্তিদেরও কেবল গলার জোরে খবর পরিবেশন করতে কিংবা অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে দেখা যায়। উচ্চারণে অসাবধানতা আমাদের ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় একটি পরিচিত ও গা জ্বালা-করা অনুষঙ্গ। আমাদের মনে রাখতে হবে, কোনো-না-কোনোভাবে আজকের সংবাদ আগামীকালের সাহিত্যকে তথ্যের জোগান দিচ্ছে। অন্যদিকে সংবাদকে প্রতিনিয়ত ভাষার জোগান দিয়ে চলেছে সাহিত্য। তাই সাহিত্যবোধহীন কারও পক্ষে উত্তম সংবাদকর্মী হওয়া অসম্ভব। কেননা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি সাহিত্যিকদের কলমেই বেশি ঘটে থাকে। ভালো খবর আমরা তাকেই বলি, তথ্যগত ছাড়াও যা ভাষাগতভাবে ঋদ্ধ। এ কারণেই মানসম্পন্ন সংবাদপত্রগুলোর নিজস্ব ভাষারীতি থাকা অত্যন্ত জরুরি; সংবাদকর্মীদেরও হতে হয় ভাষা বিষয়ে দক্ষ।

দুঃখজনক হলেও সত্যি বাংলাদেশে দু-একটি পত্রিকা ছাড়া কোনো প্রচারমাধ্যমের নেই কোনো ব্যবহারবিধি-বানানবিধি বা প্রচারবিধি। এছাড়া জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমীর বানানবিধিও অনুসরণ করে না অনেক পত্রিক-টিভি;  কোনো কোনোটি আবার এমন বানান ও বাক্যরীতি-শব্দরীতি ব্যবহার করে থাকে যে, তাতে পাঠকের চিন্তায় বিভ্রান্তি ছড়ায়। যেমন ফ্রি-র স্থলে ফৃ; ব্রিজ-এর পরিবর্তে বৃজ প্রভৃতি। অথচ ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের সোনার ছেলেদের প্রাণ দিতে হয়েছে, যার নজির পৃথিবীর আর কোথাও নেই। বাংলাভাষার মর্যাদার জন্য বাঙালি জাতি যে সংগ্রাম করেছিল, সে কথা বেমালুম ভুলে থাকে আমাদের প্রচারমাধ্যমগুলো। জাতির ওপর তারা ক্রমাগত চাপিয়ে চলেছে অসহ্য অবমাননা। মনে হয় বাংলা একাডেমী প্রণীত প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম যদি সব প্রচারমাধ্যমে প্রয়োগের ব্যাপারে সরকারি সিদ্ধান্ত থাকতো, তাহলে অন্তত কিছুটা হলেও ভাষা-সংকট দূর করা সম্ভব।

উচ্চারণে পারদর্শী ব্যক্তিদেরই কেবল উপস্থাপনা ও সংবাদ পরিবেশনার দায়িত্ব দেওয়া উচিত। আবার দেখা যাচ্ছে, সঙ্গীত প্রভৃতি ক্ষেত্রে একেবারেই নবাগতদের উপস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। মনে রাখা দরকার অনুষ্ঠান পরিচালনা কিংবা পরিবেশনার জন্য নির্দিষ্ট জ্ঞানক্ষেত্রে বিশেষ জানাশোনার প্রয়োজন রয়েছে। যে কোনো একজনকে চেয়ারে বসিয়ে দিলেই চলে না। মিডিয়া যেহেতু প্রতিদিনের দিনযাপনেও নাগরিকদের জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করে, তাই এক্ষেত্রে মানের সাথে আপস করা কোনোমতেই কাম্য নয়।

বিজ্ঞাপনচিত্রে নারীকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন নিশ্চয়ই পশ্চাদপদতার ইঙ্গিত বহন করে। সিগারেট কিংবা হাওয়াই চপ্পলের বিজ্ঞাপনে কেন নারী অপরিহার্য হয়ে পড়ে, তা ঠিক অনুধাবন করা যায় না। নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সারা দুনিয়ায় বহু আন্দোলন হয়েছে; সাহিত্যে-শিল্পে নারীকে মর্যাদার আসনে বসানোর জন্য কম প্রচেষ্টা বিনিয়োগ হয়নি। আর সেই নারীকে যখন পণ্য হিসেবে ব্যবহার হতে দেখা যায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই আমাদের লজ্জার অনুভূতিতে আঘাত লাগে।

মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির অদৃশ্য পাখায় ভর করে মানুষের ড্রইংরুমে, বেডরুমে ঢুকে পড়েছে যে বিজাতীয় স্থূল রুচির জীবনধারা, তা অনিবার্যভাবে স্পর্শ করেছে আমাদের মিডিয়াভাবনাকে। ভিনদেশি অনুষ্ঠানমালা থেকে পাওয়া আধুনিকতার ভাবনা এবং সংজ্ঞাকেই তারা মনে করছে প্রকৃত আধুনিকতা। অনুষ্ঠান নির্মাতাদের লক্ষ রাখতে হবে তার তৈরি করা অনুষ্ঠান যেন বাংলাদেশের সংবিধান, রাষ্ট্রীয় মূলনীতি, সামাজিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়। সাধারণ ভোক্তা-দর্শকরা যেন অনুষ্ঠান দেখে উপকৃত হন, জীবনে চলার পথে দিক-নির্দেশনা লাভ করতে পারেন, সেদিকে নজর দেওয়ার দায়িত্বও মিডিয়া-ব্যক্তিত্বদের। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের দায়ও তারা এড়াতে পারেন না; বিভ্রান্তিকর ও অসত্য তথ্য পরিবেশনের আগ্রহ পরিত্যাগ করতে পারলে ভালো। হলুদ সাংবাদিকতা জাতি এবং বিশ্বপ্রতিবেশের জন্য খুবই অবমাননাকর এবং বিপজ্জনক। তাই মিডিয়াকে অবশ্যই নৈতিকভাবে অত্যন্ত দৃঢ় হতে হবে। মনে রাখতে হবে, ব্যক্তি কিংবা সমাজকে হেয় করা কিংবা অপমান করা প্রচারব্যবস্থার লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। মানুষকে আলোকময় পথ দেখানো এবং সভ্যতার অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত ও সৌন্দর্যময় করাই তার চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত।

প্রচারমাধ্যমের জন্য প্রণীত নীতিমালা ঠিকমতো পালন করা হয় কি-না সে ব্যাপারে মনিটরংয়ের ব্যবস্থা থাকা দরকার। সরকারি বিটিভির জন্য ‘কোড অব এথিকস’ একটা রয়েছে জানি। সেটা পাকিস্তানি আমলের। কিছু সংশোধনী হয়ত করা হয়েছে। তবে সেটা যে সরকার বদলের সাথে সাথে বদলে যায় সেটাও ভালো করে জানি। কিন্তু বেসরকারি চ্যানেলের জন্য কোনো নীতিমালা আছে কি না জানি না; হয়তো আছে নিয়ন্ত্রক ব্যক্তিদের মুখে মুখে, মনে মনে।

মানুষের প্রয়োজন ও জীবনমান বৃদ্ধির সাথে সাথে মিডিয়ার প্রাসঙ্গিকতা বাড়ছে অনিবার্যভাবে। তাই এই বর্ধমান ক্ষেত্রটি যাতে অন্ধকার কোনা চোরাগলিতে আটকে না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখার দায়িত্বও আমাদের রয়েছে।

বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোকে অবিলম্বে সুরক্ষিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। এই খাতে প্রচুর অর্থ লগ্নী হয়েছে, অসংখ্য মানুষের বাঁচামরার প্রশ্নও জড়িয়ে গেছে। এ ব্যাপারে সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে। শুধু চ্যানেলের লাইসেন্স দিলেই চলবে না, তাকে বাঁচানোর জন্য সহযোগিতাও করতে হবে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন আমাদের দেশের ক্যাবল অপারেটররা; বাংলাদেশকে ভিনদেশি চ্যানেলসমূহের অশুভ প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে তারা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন। পৃথিবীর নানান দেশে এমন নজির রয়েছে।

কলাম বা নিবন্ধ প্রকাশের ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা থাকা চাই। দায়িত্বহীন ও ভুল তথ্যের প্রকাশ করলে আমরা নানানভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারি। লেখা প্রকাশের আগে অন্তত পরিবেশিত তথ্য এবং বিষয়ের প্রাসঙ্গিকতা যাচাই করা যায়। এমন কোনো নিবন্ধ প্রকাশ করা ঠিক নয় যাতে লেখক এবং পত্রিকা- দুয়েরই গ্রহণযোগ্যতা কমে, পাঠক তাদের প্রতি আস্থা হারায়।

পেশাদারিত্ব এবং জনগণের আস্থা ও নির্ভরতা বাড়াতে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের কাজে লাগাতে হবে। বিশেষ করে, অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সি সরকারি রেডিও এবং টেলিভিশন থেকে অবসরপ্রাপ্ত সংবাদকর্মীদের বেসরকারি রেডিও-টিভিতে কাজের সুযোগ প্রদান করলে তাদের অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করা যায়। দু-একটি প্রতিষ্ঠান অবশ্য এমন উদ্যোগ নিয়েছে। এটি ব্যাপকভাবে করা দরকার। ভিনদেশি প্রচারমাধ্যমে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন ব্যক্তিদের মেধা ও যোগ্যতাকে কাজে লাগানোর পরিবেশ তৈরি করতে হবে। জাতীয় সংস্কৃতির লালন এবং বিকাশে প্রচারমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ; এই সহজ-সরল কথাটি আজ বোধকরি বাংলাদেশের মানুষকে আবার নতুন করে, বিশেষ করে অনুভব করতে হবে। আর সেই অনুভবজ্ঞানে পরিশুদ্ধ হবে আমাদের মিডিয়াভাবনা- এই প্রত্যাশা।

লেখক : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, রেডিও সংবাদপাঠক ও সাহিত্য সমালোচক।
ই-মেইল : snue90@yahoo.com

বাংলাদেশ সময় ২০০১ ঘণ্টা, জুলাই ৬, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।