ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

গোলটেবিলে নয় মাঠের রিপোর্টিংয়েই প্রকৃত সাংবাদিকতা

মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ৮, ২০১৬
গোলটেবিলে নয় মাঠের রিপোর্টিংয়েই প্রকৃত সাংবাদিকতা ছবি: প্রতীকী

গোলটেবিল আলোচনা। কথাটার সঙ্গে এনজিওর গন্ধমাখা।

এই সংস্থাগুলো নানাবিধ উন্নয়ন ইস্যু নিয়ে কাজ করে। সামাজিক সঙ্কট, মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয়ের পাশাপাশি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতেও এদের গবেষণা থাকে, ফাইন্ডিংস থাকে। সেগুলো নিয়ে স্টেকহোল্ডারদের ডেকে গোল হয়ে বসে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করে। তা থেকে তথ্য বেরিয়ে আসে। যা হতে পারে বড় কোনও খবর, কিংবা খবরের উৎস।

সংবাদ কর্মীরা কখনো আমন্ত্রিত হয়ে, কখনো নিজের গরজেই এসব গোলটেবিলের পেছনের সারিতে গিয়ে বসেন। একটি রিপোর্ট যদি হয়! কেউ কেউ আবার সেখান থেকেই বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি চেষ্টা করেন। এটাই সংবাদকর্মীর কাজ।

কিন্তু খবরের খোঁজে নয়, বরং খবর তৈরির আয়োজক হয়ে গেছে কিছু কিছু সংবাদমাধ্যম। পুরোপুরি এনজিও’র ভূমিকায় নেমে এরা নিজেরাই আয়োজন করছে গোলটেবিল আলোচনা। শুরুটা অনেক আগের একটি সংবাদপত্রকে দিয়ে। এজেন্ডাভিত্তিক সাংবাদিকতার অন্যতম একটি কৌশল হিসেবে প্রধানসারির ওই সংবাদপত্রটি গোলটেবিলকে ঢুকিয়ে ফেলে নিজের দফতেরই। বাইরে যারা আলোচনা করবেন তাদেরকেই ডেকে এনে বসানো হয় সংবাদপত্রের কার্যালয়ে।

লম্বা করে পাতা টেবিলকে ‘গোলটেবিল’ বলে চালিয়ে শুরু হয়ে এনজিওগিরি।

‘অভিনবত্ব’ সাংবাদিকতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আর সে কারণেই গোড়ার দিকে অনেকে বিষয়টিকে ‘অভিনব’ কিছু একটা ভেবে বাহবাও দিতে থাকে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই গোলটেবিলের মাত্রা যখন বাড়তে থাকে, তখন অনেকের কাছেই স্পষ্ট হয় যে এটি ফান্ডভিত্তিক একটি কার্যক্রম।

মোটেই কোনও গুরুত্বপূর্ণ সমসাময়িক বিষয়কে সামনে আনতে নয়, বরং ইস্যু ও এজেন্ডাভিত্তিক কিছু সুনির্দিষ্ট আলোচনাকে সামনে এনে সুনির্দিষ্ট কিছু বক্তাকে দিয়ে বলিয়ে তা প্রকাশ করাই উদ্দেশ্য। নিজে নিজে বলা হলো না, সাংবাদিকতার নীতিমালার মধ্যে থেকেই করা হলো এই বলে পাঠকের চোখে ধুলো দিয়ে সস্তা জনপ্রিয়তা কুড়োনোও একটা উদ্দেশ্য ছিলো বটে।

প্রক্রিয়াটি এখনও চলছে। একটু সংক্রমিতই হয়েছে বলতে হবে। এখনও কারওয়ানবাজার থেকে আরও একটি দুটি পত্রিকার চিঠি আসে, গোলটেবিল আছে, অ্যাসাইনমেন্ট চাই।  
গৌরচন্দ্রিকাটি একটু বড় হয়ে গেলো। কারণ এই লেখার উদ্দেশ্য কোনও সংবাদপত্রের এজেন্ডা বিষয়ক নয়। পেশাদারিত্বের দৃষ্টিকোন থেকে স্রেফ একটু আলোচনা তোলা- কোন দিকে যাবে সংবাদমাধ্যম? গোলটেবিলের খবর দেবে, নাকি নিজেই গোলটেবিলের আয়োজক হবে? আরও একটি প্রশ্ন গোলটেবিল আয়োজনে, নাকি মাঠের রিপোর্টিংয়ে প্রকৃত সাংবাদিকতা।

গুগল দুনিয়ায়তো সবই পাওয়া যায়! একটু সার্চ দিয়ে দেখার চেষ্টা- ওয়াশিংটনপোস্ট কি কখনো এমন গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেছে? সহজেই মিললো না। অনেক গোলটেবিল আলোচনার খবর ওয়াশপোস্টে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু নিজেদের আয়োজনের খবর পাওয়া যায়নি। তবে এদিয়ে নিশ্চয়ই সিদ্ধান্ত টানা যাবে না। শুধু এইটুকু বলা যায়, বিবিসি, সিএনএনসহ বিশ্বের নামকরা সংবাদমাধ্যমগুলোর এমন রাউন্ডটেবিল আলোচনা আয়োজনের খবর সার্চইঞ্জিন দিচ্ছে না।

দ্য গার্ডিয়ানের একটি গোলটেবিল আলোচনা আয়োজনের তথ্য মিললো- সেটি ছিলো ‘হাউ টু স্টপ সাইবার অ্যাটাক অন ইওর অর্গানাইজেশন’ এই শিরোনামে। সংবাদমাধ্যমের নিজেদের জন্য বিষয় এটি। ফলে এই আলোচনা হয়তো আর কেউ করবে না, তাই দ্য গার্ডিয়ানকে নিজেকেই করতে হয়েছে।

আসলে একটি সংবাদপত্রের বা সংবাদমাধ্যমের কাজ হচ্ছে সংবাদ সংগ্রহ ও প্রকাশ, নিজেই সংবাদের উৎস হয়ে না ওঠা।

সমাজের কোনও ইস্যুকে সংবাদমাধ্যম যদি বিশেষ গুরুত্ব দিতে চায়, তাহলে সে বিষয়ে আলোচনা ফেঁদে নয়, বরং সে বিষয়ে ইনডেপথ রিপোর্ট করে তবেই তা সামনে আনতে হবে।

বাঘা বাঘা কিছু লোককে ডেকে মোটা মোটা কথা বলিয়ে তা ছেপে সমাজ কতটুকু পাল্টানো যায়, সেটি এখন আর বোঝার বাকি নেই। তবে মাঠ থেকে তুলে আনা খবরের যে গুরুত্ব আর সমাজে তার যে প্রভাব সেটি অবশ্যই প্রমাণিত।

খবরের মূল উদ্দেশ্যগুলো হচ্ছে, লোকচক্ষুর আড়ালের কোন বিষয় তুলে আনা আবার যা কিছু লোকচক্ষের সামনে থাকে তারও নানা অ্যাঙ্গেল, বিচার বিশ্লেষণ তুলে ধরা। তবে অবশ্যই তা চারদেয়ালের মধ্যে বসে দামি দামি কথা কপচিয়ে নয়। মাঠে গিয়ে সেখানকার প্রকৃত চিত্র দেখে বুঝে, ছবি তুলে, ভিডিও করে তবেই প্রতিবেদন করতে হবে।

একটি মাঠের রিপোর্ট, কোনও ঘটনার গভীরের খবর বের করে এনে তার প্রকাশ থেকে যে কাজটুকু হয় তা শত গোলটেবিল আলোচনা থেকেও অর্জন সম্ভব নয়।

একজন পেশাদার সাংবাদিক, যার দীর্ঘ রিপোর্টিং ব্যাকগ্রাউন্ড থাকে তিনি কিন্তু এই রিপোর্টিংয়ের মধ্য দিয়েই পরিবর্তনটি দেখতে বা দেখাতে চান। এই সময়ের সংবাদমাধ্যমগুলোর মধ্যে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম যার একটি অন্যতম উদাহরণ হতে পারে। এডিটর ইন চিফ আলমগীর হোসেন দীর্ঘ চল্লিশ বছরের ক্যারিয়ারে তেত্রিশ বছরই মাঠ পর্যায়ে রিপোর্টিংয়ে সময় পার করেছেন। তার নেতৃত্বে বাংলানিউজ ওই রিপোর্টিংকেই বড় গুরুত্ব দিচ্ছে।

কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। এক. দেশের সাংবাদিকতা জগতে এখন প্রতিষ্ঠিত, আর পাঠকের কাছে সুস্পষ্ট যে, দেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন প্রকল্প পদ্মাসেতু নির্মাণ কাজের রিপোর্টিংয়ে বাংলানিউজের চেয়ে এগিয়ে কেউ নেই। গত দেড় বছরে ডজনখানেক বার বাংলানিউজের বড় বড় টিম পদ্মাসেতু প্রকল্প এলাকায় সরেজমিন ঘুরে ‘ম্যাসিভ রিপোর্টিং’ করেছে। পদ্মাসেতুর প্রতিটি অগ্রগতি বাংলানিউজের মাধ্যমে পাঠক জানতে পেরেছে।

দুই. গণজাগরণ মঞ্চের খবর পরিবেশনায় বাংলানিউজের রিপোর্টিং টিম শাহবাগে বার্তাকক্ষ বানিয়ে তবেই কাজ করেছে। যার সুনাম এখনো রয়েছে।

তিন. যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও ফাঁসি কার্যকরের সময় বাংলানিউজের বড় টিম কাজ করে, তা অনেকেরেই জানা।

এছাড়াও কোনও একটি মেলা, জাতীয় কোনও উৎসব কোনও একটি দিবসকে ঘিরে আয়োজনেও বাংলানিউজের থাকে বিস্তারিত ও পুঙ্খানুপুঙ্খু রিপোর্টিংয়ের আয়োজন।

২০১৬ সালকে সরকার পর্যটন বছর হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই বছরটিতে দেশের পর্যটনকে ঘিরে ব্যাপকভিত্তিক রিপোর্টিংয়ের উদ্যোগ বাংলানিউজ নিয়েছে সেই গোড়ার দিকেই। এরই মধ্যে বিভিন্ন পর্যটন এলাকা ঘুরে বিস্তারিত রিপোর্ট হয়েছে। চলনবিল চষে বেড়িয়ে কয়েক ডজন রিপোর্টে তার সবদিক উঠিয়ে এনেছে বাংলানিউজ টিম। বর্তমানে চলছে দেশের প্রধানতম পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজারের ওপর রিপোর্টিং। এরই মধ্যে বাংলানিউজের ২১ জন সদস্য কক্সবাজারে অবস্থান করে রিপোর্টিং করছেন। যা কিছু প্রয়োজনীয় এই কক্সবাজারকে সত্যিকারের পর্যটননগর করে গড়ে তুলতে তার আদ্যোপান্ত উঠে আসছে এসব রিপোর্টে। কোনও গোলটেবিল আলোচনা করে যা কোনওভাবে সম্ভব হতো না।

আর সবচেয়ে বড় কথা গোলটেবিল আলোচনা সাংবাদিকতার অংশও হতে পারে না। চলুন আমরা সবাই মাঠে কাজ করি, সাংবাদিকতা করি।

বাংলাদেশ সময় ১৩০২ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৮, ২০১৬
এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।