ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

রানা প্লাজার দুঃসহ স্মৃতি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১৬
রানা প্লাজার দুঃসহ স্মৃতি

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ পাস করে  আমি সবে মাত্র একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেছি। ২৪ এপ্রিল ২০১৩, সকাল আনুমানিক ৯:৩০ মিনিট, হরতালের দিন তাই সেদিন ক্লাস ছিলো না।

সাভার বাসস্ট্যান্ডের খুব কাছাকাছি আমার ‘ছায়াবীথি’র বাসায় সকালের নাস্তা করছিলাম। হঠাৎ বাইরে রাস্তায় একজন মহিলার আর্তনাদ শুনতে পেলাম। ধরে নিয়েছিলাম হয়তোবা উনার কেউ অসুস্থ তাই কাঁদতে কাঁদতে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার কয়কজন মহিলার গগনবিদারী কান্নার শব্দ। বারান্দায় এসে দেখি সবাই পড়িমরি করে বাস-স্ট্যান্ডের দিকে যাচ্ছে। কি হয়েছে, কি হয়েছে জানার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কাজ হলো না। এলাকার এক দোকানদার-চাচাকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি একটা কথাই শুধু বললেন: ‘রানা প্লাজা শেষ’!

শেষ মানে? একটা ৮ তলা সুসজ্জিত বিল্ডিং শেষ! মাত্র ক’দিন আগেও সেখানের ব্রাক ব্যাংকে গিয়েছি, এ কীভাবে সম্ভব! আমি, আমার এক খালাতো ভাই আর বড় মামা রওয়ানা দিলাম রানা প্লাজার দিকে। দুই মিনিট হাঁটার পরেই দেখলাম আমাদের এলাকার এক লোককে একটা আটো-রিক্সায় করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, মাথাটা একপাশে ফেটে গিয়েছে আর সারা রিকশা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। আমাদের ভাড়াটিয়ার মেয়েটাকে দেখলাম কারা যেন ধরে নিয়ে যাচ্ছে বাসার দিকে, আরেকজন কোথায় যাবে বলতে পারছে না, সারা শরীর রক্তাক্ত। ততক্ষণে আমাদের এলাকার অলি-গলি সারা রাস্তায় হাজারো মানুষের ঢল। সবার একটাই গন্তব্য, “রানা প্লাজা”।

সাভার ওয়াপদা রোড দিয়ে গিয়ে বাজার রোডে পৌঁছানোটাই প্রচণ্ড কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে পড়লো। রানা প্লাজায় কাজ করা অনেক শ্রমিকের আবাসস্থল আমাদের বাসার আশেপাশেই, রানা প্লাজায় চাকুরিরত হতভাগ্য মানুষগুলোর পরিবার-পরিজনের আহাজারিতে গোটা এলাকার পরিবেশটা প্রচণ্ড ভারী হয়ে পড়লো। ভিড় ঠেলে, ধাক্কাধাক্কি করে সাভার বাস-স্ট্যান্ডে পৌঁছলাম, কিন্তু গিয়ে সেই বিল্ডিংটার অবস্থা যা দেখলাম সেটা দেখে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিলো। কোনো অনুভূতিই কাজ করছিলো না। প্রচণ্ড জোরে একটা ধাক্কা খেলাম পেছন দিক থেকে, অনুভূতি ফিরে পাবার সাথে সাথে আমি আমার বড় মামাকে জড়িয়ে ধরলাম। মামা কাঁদছিলেন, শুধু কি উনি, সেই জায়গায় থাকা প্রতিটি মানুষের বুক ফাটা কান্না। তীব্র আর্তনাদ, আহাজারিতে প্রকৃতিও বোধহয় গোমট বেঁধে কাদছিলো সেদিন।

পকেট থেকে মোবাইলটা বের করি, রাতে চার্জ দেয়া হয়নি, অল্প একটু চার্জ আছে। ফেসবুক থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাইকে উদ্দেশ্য করে একটা স্ট্যাটাস দেই “রানা প্লাজা ধ্বসে পড়েছে, যেন সবাই রক্ত দেবার জন্য প্রস্তুত থাকে। আমার মনে হয় তখনো সবাই তেমন ভালোভাবে জানেনি বিষয়টা, তাই কয়েকজন রিপ্লাই দিলেও বাকিদের কাছ থেকে তেমন সাড়া এলো না।

তখনো কোন প্রাতিষ্ঠানিক উদ্ধারকারী দল এসে পৌঁছায়নি। সাধারণ মানুষ যে যার মতো করে জীবনের বাজি রেখে সেই ধসে পড়া বিল্ডিংয়ের ভেতরে গিয়ে উদ্ধার অভিযান চালাতে লাগলো। যাদের আত্মীয়-স্বজন ভেতরে আটকা পড়েছিলো, তারা যে কতোভাবে চেষ্টা করছিলো ভেতরে যাবার। কিন্তু বিল্ডিংটা এমনভাবেই ভেঙ্গে পড়েছিলো যে সাধারণ মানুষের ভেতরে যাবার তেমন কোনো সহজ রাস্তা ছিলো না। প্রচণ্ড এলোমেলোভাবে হচ্ছিলো সব কাজ। কয়েকটা অ্যাম্বুলেন্স আহতদের এনাম হাসপাতালে নেয়া শুরু করে দিলেও মানুষের ভিড়ের কারণে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিলো। আমরা যারা ভেতরে যেতে পারিনি তারা সবাই মিলে মানবপ্রাচীর বানালাম যেন আহতদের বহনে কোনো অসুবিধা না হয়। কিন্তু যার যায় সেই বোঝে। কোনভাবেই মানুষের চাপকে আটকে রাখা যাচ্ছিল না। একটু পরে স্থানীয় সাংসদ মুরাদ জং এর গাড়ি বের হয়ে যেতে দেখি। আমরা ভেবেছিলাম যে, জন প্রতিনিধি হিসেবে উনি সেখানে এসেছেন, কিন্তু পরে সংবাদপত্রের মাধ্যমে জেনেছিলাম উনি তার কলিজার টুকরা সোহেলকে বাঁচানোর মিশন নিয়েই সেখানে এসেছিলেন।

ততক্ষণে সেনাবাহিনি চলে এসেছে। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি, পুলিশের গাড়ির সাথে অসংখ্য সাংবাদিকদের গাড়ি সে জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে। হাজার হাজার মানুষকে সামলানোটা অনেক কঠিন হয়ে পড়েছিলো। মানুষের ঢল সামলাতে পুলিশ মাঝেমাঝেই লাঠি-চার্জ করছিলো। এমন অবস্থায় এনাম মেডিকেল কলেজের ছাত্র সংগঠন ‘স্পন্দন’ ক্লাবের সভাপতি ইমরান ভাইয়ের কাছ থেকে ফোন আসে। প্রচুর রক্ত লাগবে বলে তারা জানান।   আমি একটা অ্যাম্বুলেন্সে করে এনাম মেডিকেলে চলে যাই।

এনাম মেডিকেলের ব্লাড ব্যাংকের সামনে বসে আমি আমাদের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়য়ের সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ক্লাবের সভাপতি হিমুকে ফোনকল দেই এবং সাথে সাথে আরো কয়েকজন সদস্য সৌরভ, বাপ্পী এবং আসিফকে ফোনকল দেই। ঘটনা বলার সাথে সাথেই ওরা জাহাঙ্গীরনগরের হল থেকে সাভারের দিকে রওনা দিয়ে দিল। কিন্তু গাড়ি না পাওয়াতে ওদের আসতে অনেক দেরি হচ্ছিল। সাভারে থাকা আমার আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, মামাদের বন্ধু এবং মামাতো ভাইদেরকে বলি যেন যত পারে রক্তদাতা সংগ্রহ করে রাখে। এনাম মেডিকেলের অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী ব্লাডব্যাংকের সামনে। সবাই পর্যায়ক্রমে রক্ত দিচ্ছে। নিচে গেলাম, গোটা এনাম মেডিকেলের বাতাস আহতদের আর্তনাদে ভারী। আমি লিফটের পাশে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, একেকটা অ্যাম্বুলেন্স আসছে আর এনামের ছাত্র-ছাত্রীরা পাগলের মতো ছুটে যাচ্ছে স্ক্রলার নিয়ে। ডাক্তারি যে কতো মহতী একটা পেশা, তখনকার প্রতিটি মুহূর্তই আমাকে কথাটি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলো বারবার।

ঘণ্টা দুয়েক পর সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ক্লাবের সবাই পৌঁছালো। ওরা আসার সাথে সাথে আমার ভিতর থেকে অনেক বড় একটা দুশ্চিন্তা দূর হয়ে গেল। ওরা সবাই আসার পরপরই রক্ত দিল। ততোক্ষণে সারা বাংলাদেশ জেনে গিয়েছে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কথা। হাজার হাজার মানুষ এনামের সামনে। সবাই এসেছে রক্ত দিতে। আমরা ভিতর থেকে রক্তদানের কাজটা সঠিকভাবে পরিচালনা করতে হিমশিম খাচ্ছিলাম। বিকেল নাগাদ আমাদের জাহাঙ্গীরনগর আইবিএ এবং অন্যান্য অনুষদের অনেকেই এনামে চলে এলো রক্ত দিতে। সন্ধ্যায় আমি বাসায় চলে এলাম। বাকিদেরও জাবিতে ফিরে যাবার কথা।

ভোরবেলায় সৌরভের সঙ্গে কথা হয়। জানতে পারি, ওরা সারারাত হাসপাতালেই ছিল। আমি সকালে গেলাম হাসপাতালে। গিয়ে দেখি আমার এই ছোটভাইগুলো সারারাত ধরে এনামের ডাক্তারদের সাথে মিলে আহত, নিহত এবং নিখোঁজদের তালিকা বানিয়ে ফেলেছে। আর এনামের গেটে তথ্যসেবার বুথ নিয়ে বসে পড়েছে। আসলে ওরা সারারাত এনামের ডাক্তার-বন্ধুদের সাথে বসে কর্ম পরিকল্পনা ঠিক করে ফেলেছিল। এই ছেলেগুলোর মুখে কোনো ক্লান্তির ছাপ নেই। মানবসেবার নেশা ওদের পেয়ে বসেছিল সেদিন। যারা সকালে ছিলাম তারা এবং এনামের ডাক্তার বন্ধুরা মিলে চাঁদা তুলে রুটি, কলা কিনলাম। আল্লাহ্‌ পাকের মেহেরবানিতে সেই রুটি-কলা ই ছিল রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পরের দিন এনাম মেডিকেলের আহতদের মুখে দেয়া প্রথম খাবার। কষ্ট লাগছিল। কিন্তু তাদের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার সময় দু’এক ফোঁটা তৃপ্তির অশ্রুও চোখ বেয়ে পড়ছিলো।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সারা বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষ চলে এলো এনামে। এনামের ডাক্তার বন্ধুরা সেদিন সৃষ্টিকর্তার সবটুকু আশীর্বাদ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন আর্তমানবতার সেবায়। আর আমরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়য়ের শিক্ষার্থীরা ভেতরে ত্রাণ এবং তথ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেছি। প্রচণ্ড যানবাহন-সংকট ছিলো। এই সংকটের মধ্যেও অনেক বোন চলে এসেছিল। যারা আসতে পারেনি তারা ঢাকা থেকেই অনুদান সংগ্রহ, হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে  ডাটাবেজ সংগ্রহ করার কাজে লেগে পড়েছিল। আমাদের একতাই আমাদের শক্তিতে পরিণত হয়েছিল সেই সময়টায়। আহতদের জন্য অনেক খাবার আসতো বাইরে থেকে কিন্তু তারা সেগুলো খেতে পারতেন না। আমরা  ব্যক্তিগত অনুদান সংগ্রহের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিয়ে টানা ৪ দিন এনামের রোগীদের রাতের খাবার পরিবেশন করি। আহতদের জন্য জাহাঙ্গীরনগর থেকে বিশেষভাবে খাবার রান্না করে নিয়ে আসা হতো। জাহাঙ্গীরনগর থেকে খাবার রান্না করা এবং নিয়ে আসার ব্যাপারে জাবির প্রশাসন সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে।

সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ক্লাবের পক্ষ থেকে সংগ্রহ করা ডাটাবেজের সাথে সরকারি ডাটাবেজের আকাশ-পাতাল পার্থক্য ছিল। প্রতিটা পত্রিকা, টেলিভিশন আমাদের ডাটাবেজের রেফারেন্সে সংবাদ পরিবেশন করছিল। যার ফলে আমাদের কিছুটা চাপে থাকতে হয়েছে। যদিও পরবর্তী সময়ে নিখোঁজদের সংখ্যা মেলানোনর পর আমাদের তথ্যই সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। আহতদের নিয়ে অনেক বড় পরিকল্পনা থাকলেও সেটা সম্ভব হয়নি। কারণ আমাদের সম্ভাব্য স্পন্সরদের টাকা সরকারি তহবিলে জমা দেবার অলিখিত একটি নির্দেশনা ছিল।
আমার বাসা থেকে রানা প্লাজার দূরত্ব পাঁচ-দশ মিনিটের। ওই সময়টায় এমনও হয়েছে, খেতে বসেছি আর লাশের গন্ধ পাচ্ছি। ঘুমাতে গিয়েছি কিন্তু রাতে শুধু হতভাগ্য ভাইবোনদের গলিত লাশের দৃশ্য চোখে ভেসে উঠছে। তথ্যসেবাকেন্দ্রে নিখোঁজ মানুষের স্বজনদের আহাজারি মনে করে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছে অনেক বার। এখনো সেই স্মৃতি তাড়া করে ফেরে। আজকের এই দিনে সকল বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি এবং যারা দোষী তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি।

বাংলাদেশ সময়: ১১৩৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১৬
জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।