ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

ছাত্ররাজনীতি : বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

ড. ফজলুল হক সৈকত | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৫ ঘণ্টা, জুলাই ১১, ২০১১
ছাত্ররাজনীতি : বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

মেধাবিকাশের চর্চা আর গবেষণা থেকে পিছিয়ে পড়লে কী ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে, তা নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে আমাদের আরো সময় নিতে হবে না। সারা দুনিয়ায় এমনকি এশিয়ার শিক্ষাপরিসরে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান অবস্থান বিবেচনায় রাখলে সে কথা বুঝতে আমাদের আর একদিনও অপেক্ষা করার কথা নয়।

এভাবে না দেখার ভাগ করে কিংবা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে আর কত দিন, কত রাত সময় পার করা যায়!

ছাত্ররাজনীতিকে তার প্রচলিত ছকের বাইরে নিয়ে আসার সময় হয়েছে এখন। দিনে দিনে নোংরা আবর্জনা জমে জমে এই বিশেষ রাজনৈতিক গতিটির চরিত্র নষ্ট হয়ে পড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা জাতির ভবিষ্যৎ মানবসম্পদ প্রস্তুতের পবিত্রভূমির মর্যাদা রক্ষা করতে হবে আর একদিনও কাল বিলম্ব না করে। কোটি কোটি মানুষকে মুক্তি দিতে হবে অপ্রয়োজনীয় এই রাজনীতিচর্চার কবল থেকে। কেউ কেউ অবশ্য মনে করছেন, ভবিষ্যতের জাতীয় নেতা তৈরির জন্য ছাত্ররাজনীতির কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু পৃথিবীর অগ্রসর দেশগুলোর দিকে চোখ রাখলে সহজেই ওই চিন্তার অপ্রাসঙ্গিকতা উপলব্ধি করা সম্ভব। এখন বোধকরি ভেবে দেখার সময় হয়েছে যে, ছাত্র রাজনীতির কী প্রয়োজন? শিক্ষার্থীদের কল্যাণের জন্য, না কি ভাবিষ্যতের কেন্দ্রীয় রাজনীতির নেতা উৎপাদনের জন্য? দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে অনেকেই ছাত্ররাজনীতি বন্ধের পক্ষে মত দিলেও অতীতের ইতিহাস তুলে আগামী দিনের বাংলাদেশ নেতৃত্ব শূন্য হয়ে পড়বে এমন আশঙ্কায় হয়তো তা বন্ধ করা হচ্ছে না।

যদি নেতা জন্ম দেবার জন্য এই রাজনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়, তাহলেও সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এর বিস্তার না ঘটিয়ে কেবল বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকার ও রাজনীতি কিংবা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ প্রভৃতি কিছু অতি প্রাসঙ্গিক বিষয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য অ্যাকাডেমিক লেখাপড়ার অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। সব শিক্ষার্থীকে তো আর নেতা হবার দরকার পড়ে না। সবার জন্য সে রকম জায়গাও নিশ্চয়ই রাষ্ট্র বরাদ্দ রাখেনি। চিকিৎসক, প্রকৌশলি, শিক্ষক, আইনজীবী, সংবাদকর্মী, ব্যাংকার, ব্যবসায়ী তৈরির মতো অ্যাকাডেমিক কাঠামোয় কেবল রাজনীতিবিদ বানানোর প্রক্রিয়া চালু রাখা যায়। অন্যথায় সব ধরনের শিক্ষাব্যবস্থায় রাজনীতি থাকলে শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য অর্জন করা অসম্ভব হয়ে পড়বে; পড়ছেও হয়তো। অবশ্য এমনটি করা গেলে রাজনীতির জন্য লাভই হবে; অশিক্ষিত-অযোগ্যদের করালগ্রাস থেকেও মুক্তি পাবে দেশের রাজনীতি, সরকারব্যবস্থা এবং প্রশাসন ও উন্নয়ন-পদ্ধতি।

যে রাজনীতি মেধার বিকাশ না ঘটিয়ে তার প্রসারে ব্যাঘাত ঘটায়, সে রাজনীতি থাকার প্রয়োজন আছে কি না তা খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। উন্নত বিশ্বের নামিদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দলবাজির কোনো হিংস্র রাজনীতি নেই। তাই বলে কি সে দেশের ছাত্ররা ভালো রাজনীতিক হচ্ছেন না ? বরং লেখাপড়ায় ভালো করে দেশের হাল ধরে তারা দেশকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যাচ্ছেন। কোনো কোনো দেশ, নিজস্ব সম্পদ তেমন একটা না থাকলেও, শুধু ভৌগোলিক অবস্থান আর রাষ্ট্রের অবকাঠামোকে সম্বল করে পৃথিবীর বুকে মডেল দেশে পরিণত হয়েছে। ওইসব রাষ্ট্রে যারা দেশের হাল ধরেছেন, তারা রাজনীতি নয়; মেধা আর যোগ্যতার পরিচয়েই পেয়েছেন গ্রহণযোগ্যতা। রাজনীতি না থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় যদি শুধুই লেখাপড়া থাকতো, তাহলে কী এমন ক্ষতি হতো? মেধাহীন ঘুণে জর্জরিত এ ছাত্র রাজনীতি আমাদের কি উপহার দিয়েছে? বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই সংঘর্ষের ও হীনস্বার্থের রাজনীতি পছন্দ করে না। হিসেব করলে হয়তো দেখা যাবে, প্রায় সত্তর শতাংশ শিক্ষার্থীই, নোংরা রাজনীতির কারণে লেখাপড়ার পরিবেশ নষ্ট হোকÑ এমনটি প্রত্যাশা করে না। এমন একটি জনমত [নাকি শিক্ষার্থীমত?] জরিপের কাজ শুরু হতে পারে এখনই।

শিক্ষার্থীসমাজকে শিক্ষার মূল আবহে নিয়োজিত করতে হবে। ক্লাসওয়ার্ক, প্রেজেন্টেশন, গ্রুপওয়ার্ক, মাঠকর্ম এবং পাঠাগার ও গবেষণাগার নির্ভর করে তুলতে হবে পাঠব্যবস্থাকে। পাশাপাশি থাকবে মানসিক ও চিন্তাবৃত্তির জন্য সহায়ক কিছু প্রাসঙ্গিক কর্মসূচি। সৃজনশীল কাজ এবং ক্রীড়া নিশ্চয়ই শিক্ষাকে অনুপ্রেরণা ও শক্তি যোগাবে। আদর্শগত প্রেরণা শিক্ষার জন্য একটি অতি জরুরি প্রসঙ্গ। শিক্ষাঙ্গণে রাজনীতি আদর্শবর্জিত হয়ে পড়ায় তা প্রায় সর্বমহলে নির্ভরযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে।

ভর্তিবাণিজ্য, হলদখল, টেন্ডারবাজিসহ শিক্ষাবহির্ভূত কার্যক্রমে এবং অনধিকার প্রবেশের জায়গাগুলিতে ঢুকে পড়েছে ছাত্ররাজনীতি। বিগত কয়েক বছরে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কার্যক্রমে শিক্ষার্থীরা যেভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে, তাকে কোনোমতেই ইতিবাচক বলা চলে না। পাঠব্যবস্থার আরম্ভকালে যদি ওই প্রতিষ্ঠানে পাঠরত শিক্ষার্থীরা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তবে তাকে ভালো উদ্যোগ বলি কীভাবে? অনেক সময় আবার তারা শিক্ষকদেরকে লাঞ্ছিত পর্যন্ত করে চলেছেন। শিক্ষার্থীর এই অনভিপ্রেত ঔদ্ধত্য থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে হবে। আর তা করতে হবে সৃষ্টিশীল ও পাঠমুখি শিক্ষার্থীকে নেতৃত্বপ্রদানের পরিবেশ ও সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়ার মাধ্যমে। এবং এ কাজ করার জন্য সরকারকে গ্রহণ করতে হবে অগ্রণী ভূমিকা। জাতির জনক হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় প্রতিষ্ঠা এবং সংবিধান সংশোধনে অপরিচ্ছন্নতা পরিহারের মতো অতি জরুরি রায় ও পদক্ষেপ গ্রহণে যে রকম আন্তরিকতা ও প্রচেষ্টার পরিচয় দিয়েছে বর্তমান সরকার, আমরা আশা করি, ছাত্ররাজনীতিকে তার বহাল চরিত্র থেকে বের করে প্রকৃতঅর্থে শিক্ষার্থী কল্যাণ পরিষদ গঠনে তারা বিশেষ অবদান রাখতে সমর্থ হবেন।

অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদকে, বিশেষত ডাকসুকে, মিনি পার্লামেন্ট ভেবে থাকেন। দেশের অনেক সংকটে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীরা স্মরণীয় ভূমিকা রেখেছে। কাজেই জাতীয়ভাবে ছাত্ররাজনীতি গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছিল তখনকার অনিবার্যতায়। কিন্তু কালক্রমে সে ঐতিহ্য থেকে দূরে সরে পড়েছে ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক রাজনীতির চরিত্র। বর্তমানে, অতীত গুরুত্বকে বিবেচনায় রেখে এবং এর পরিবর্তীত চরিত্র থেকে মুক্তি দেবার প্রয়োজনে নতুন করে সাজানোর চিন্তা প্রয়োগ করা যেতে পারে। যেমন, জাতীয় সংসদের নির্বাচনের মতো করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগকে একেকটি নির্বাচনী অঞ্চল ঘোষণা করে প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া যেতে পারে। এমনটি করতে পারলে সব পর্যায়ের শিক্ষার্থীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা যাবে। আর প্রতিটি বিভাগ বা ইনস্টিটিউট থেকে প্রতিনিধিত্ব থাকলে শিক্ষার্থীরা তাদের অধিকার এবং মর্যাদা বিষয়ে যথার্থ ভূমিকা রাখতে সমর্থ হবে। আর অবশ্যই, প্রতিটি বিভাগ থেকে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি মনোনয়ন দিতে হবে মেধা ও সৃজনশীলতার পরিচিতির ভিত্তিতে। বিগত পাবলিক পরীক্ষা কিংবা অভ্যন্তরীণ বা বিভাগীয় পরীক্ষায় ভালো ফল অর্জনকারী এবং শিক্ষা সহায়ক বা সম্পূরক কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষার্থীকে মনোনয়ন দিলে তারা নিজেদের এবং সহপাঠীদের কল্যাণে চিন্তাবিনিয়োগ করতে সক্ষম হবে। যে শিক্ষার্থী তার শিক্ষাজীবনে কখনো মেধা কিংবা যোগ্যতা অথবা সাফল্যের পরিচয় দিতে পারেনি, তার ওপর শিক্ষার্থীসমাজের ভালোমন্দের ভার ছেড়ে দেওয়া বোধকরি বোকামি ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না।

প্রচলিত ধারার ছাত্র সংসদের নাম পরিবর্তিত হয়ে তা হতে পারে “শিক্ষার্থী-অধিকার ও কল্যাণ পরিষদ” এবং অনুরূপভাবে গঠিত বা নির্বাচিত হতে পারে “শিক্ষক-অধিকার ও কল্যাণ পরিষদ”। শিক্ষকদের অ্যাকাডেমিক যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা অর্জন এবং প্রসারণে কাজ করবে ওই পরিষদ। নেতৃত্ব মনোনয়ন কিংবা নির্বাচনেও শিক্ষকদের অ্যাকাডেমিক যোগ্যতা এবং গবেষণা ও শিক্ষাসম্পূরক কাজের সাথে সম্পৃক্ততার বিষয়গুলো বিবেচনায় আনতে হবে। এছাড়া ক্যাম্পাসে ও ক্যাম্পাসের বাইরে তাদের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং সমুন্নত রাখার ব্যাপারেও তারা ভূমিকা রাখতে পারে। বিশ্বব্যাপী জ্ঞানচর্চার বিশাল পরিসরে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করার ব্যাপারেও সমন্বিত প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারবে শিক্ষকদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। কেবল ক্যাম্পাসভিত্তিক কাজ করার জন্য এই প্রতিনিধি নির্বাচনের ধারণাটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং পর্যায়ক্রমে কলেজ ও স্কুলে প্রসারিত হতে পারে। জাতি গঠনে আদর্শ হিসেবে দাঁড়াতে পারে “শিক্ষার্থী-অধিকার ও কল্যাণ পরিষদ” এবং “শিক্ষক-অধিকার ও কল্যাণ পরিষদ”। এছাড়া কেবল সিনিয়রিটির ভিত্তিতে বিভাগের চেয়ারম্যান নিয়োগ না করে অ্যাকাডেমিক যোগ্যতাকে গুরুত্ব দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন, ট্রেজারার, প্রোভিসি, ভিসি কলেজের অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ স্কুলের প্রধানশিক্ষক, সহকারী প্রধানশিক্ষক প্রভৃতি পদে যোগ্য ও অভিজ্ঞ শিক্ষকদের নিয়োগ করার ব্যাপারেও তৈরি করা যেতে পারে প্রয়োজনীয় নীতিমালা।

এছাড়া, হলে মেধাবীদেরকে বিভাগওয়ারি কোটাভিত্তিতে সিট বরাদ্দ, সিনিয়রিটি ও পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে হল পরিষদ গঠন, যোগ্য শিক্ষকদেরকে প্রক্টর, সহকারী প্রক্টর, আবাসিক শিক্ষক, প্রভোস্ট প্রভৃতি পদের দায়িত্ব দিতে পারলে ক্যাম্পাসের শিক্ষা ও বসবাসের পরিস্থিতি অনেক পাল্টে যাবে; তৈরি হবে কাক্সিক্ষত অনুকূল ও শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ।

ইতিবাচক চিন্তা বা ধারণাকে বাস্তবে রূপ প্রদান করা আগে বা পাশাপাশি ভাবতে হবে আরো কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয়। বর্তমানে সবার জানা হয়ে গেছে যে, অছাত্র এবং অস্ত্রধারি সন্ত্রাসিরা প্রবেশ করেছে বিদ্যাপীঠের রাজনীতির উঠানে। খুঁজে বের করতে হবে, কারা আমাদের ছাত্ররাজনীতির লাগাম ধরে আছে? আরো দেখা প্রয়োজন, প্রশ্রয় এবং অস্ত্র ও সাহস আসছে কোথা থেকে? কী অভিপ্রায়ে তারা এমনটি করছে? এসব প্রশ্নের মীমাংসাও খুব জরুরি হয়ে পড়েছে বোধ করি


লেখক: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, রেডিও সংবাদপাঠক এবং সাহিত্য সমালোচক।

বাংলাদেশ সময় ১৬৫৪, জুলাই ১১, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।