ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

জঙ্গি হচ্ছে সন্তান! মা-বাবা কী অসহায়?

মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৪ ঘণ্টা, জুলাই ৫, ২০১৬
জঙ্গি হচ্ছে সন্তান! মা-বাবা কী অসহায়?

স্কুল-কলেজ কিংবা কোচিংয়ে যাওয়ার সময় নাস্তা বানিয়ে মা বলছেন, একটু খেয়ে যা বাবা! আর সন্তান বলছে, মা আমার এখন ক্ষুধা নাই। পরে এসে খাবো!

ছেলের বাহানা, মায়ের পিঁড়াপীঁড়ি এমন মধুর দৃশ্য কার ঘরে না হয়! সন্তানের জন্য মায়ের মনে সামান্য ক্ষুধার কষ্টটিও ধরে থাকে।

তেমনইতো এক মা ছিলেন মুসাব্বিরের। পাউরুটিতে নসিলা মাখিয়ে (হয়তো সেটাই তার ছেলের সবচেয়ে পছন্দের ছিলো) তিনি যখন তা খেয়ে যেতে বললেন, ছেলে বললো ফিরে এসে খাবো। কি ঢাহা মিথ্যা কথা! কী ভয়ঙ্কর এক ধোকা মাকে। কারণ সে ছেলে তখন জানে এই যে যাচ্ছে, আর ফিরছে না। কারণ ততক্ষণে যে জঙ্গি। একটু পরেই গাড়ির ড্রাইভারকেও ফাঁকি দিয়ে সে পা বাড়াবে অন্ধকার হিংস্রতার পথে। মা কি কোনওভাবেই জানবেন শহরের নামি-দামি স্কুল থেকে যে ছেলেকে ও-লেভেল শেষ করিয়েছেন, যার মুখে চোখে এখনো স্রেফ সরলতার ছাপ, সে জঙ্গি হয়ে গেছে।

আরেক সন্তান মাকে বলে যাচ্ছে, মা আমি চিল্লায় যাচ্ছি। মানে তবলিগ জামায়াতে। মা ভাবছে, আহা সন্তান তার এই তারুণ্যেই আল্লাহওয়ালা হয়েছে। সেই আবেগেই হয়তো মা তার মুগ্ধ। কিন্তু তিনি কি জানতেন সন্তান শফিকুল তার যাচ্ছে জঙ্গি প্রশিক্ষণে। ধর্মের নামে মিথ্যাচার করে, ধর্মরক্ষার নামেই শফিকুল হয়ে উঠবে ধুর্ধর্ষ হিংস্র এক জঙ্গি।

নিজের সন্তানকে আগলে রাখতে চান যে কোনও মা-বাবাই। তাদের কাছে সন্তানটি ছিলো খুবই নম্র-ভদ্র, চুপচাপ। স্কুল-কোচিং ছাড়া বাড়ির বাইরেও নাকি যেত না। এমনকি কোনো পারিবারিক বা সামাজিক অনুষ্ঠানে গেলেও বাবা-মায়ের সঙ্গে সঙ্গেই থাকত। একটি ছবিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে তাতে মা-বাবার মাঝখানে ছেলেটি। বাম হাতে একটি জুস কিংবা কফির মগ। আর মা তার ডান হাতটি আগলে ধরে নিজের গায়ের দিকে টেনে নিয়েছেন প্রিয় সন্তানটিকে। ইমতিয়াজ নামের এই ছেলে কী করে লা-পাত্তা হলো, কী করে জঙ্গিদের সঙ্গে মিশল, কোনোভাবেই আর বুঝতে পারছেন না বাবা-মা।

আরেকজন ফুটবল খেলতে পছন্দ করতো, তার আচরণ ছিলো অমায়িক তাই বেশ জনপ্রিয় ছিল। নামটাও অন্যরকম নিবরাস ইসলাম। গ্রাজুয়েশনের দিন গর্বিত মা এসেছিলেন ছেলের সঙ্গে ক্যাম্পাসে। সামাজিত মাধ্যমে মা-ছেলের সেই ছবিও রয়েছে। সেই গর্বের মাঝেই যে লুক্কায়িত ছিলো লজ্জিত হওয়ার মতো কিছু, আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু তা কি আর নিজের সন্তানটিকে নিয়ে ভাবতেও পেরেছিলেন ওই মা।

এরা কী কেউ জানতেন দীর্ঘ নিখোঁজের পর একদিন তাদের সন্তান নিহত হবে। তার আগে সে নিজ হাতে জবাই করবে ডজন দুয়েক মানুষ।

নিঃসন্দেহে বলা চলে এইসব মা-বাবা বড় অসহায়।

আমরা দেখেছি এই পাঁচ জঙ্গির মধ্যে চারজনই উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। শফিকুলের বাবা কৃষি শ্রমিক, কেবল সেই এই দলে দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছে। সুতরাং বলা চলে, জঙ্গিতে যোগ দেওয়ার জন্য উচ্চ আর নিম্নবিত্তে কোনও ভেদাভেদ নেই।

আরেকটি বিষয় এসেছে, এরা সকলেই কোনও নামি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, কিংবা নামি-দামি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষার্থী। তাহলে অতীতের একটি সরল সমীকরণ ছিলো মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিয়ে জঙ্গি হচ্ছে যেটি ভুল। অর্থাৎ সেটিই একমাত্র বিশ্লেষণ নয়। উচ্চবিত্তের পরিবার থেকে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরাও এই পথে পা বাড়িয়েছে।

আমরা দেখেছি একটাই মিল, ঘরে এদের মমতাময়ী মা রয়েছেন, বাবা রয়েছেন যাদের ভালোবাসা এদের কাছে মূল্যহীন।  

এর পেছনে কী থাকতে পারে? কী এমন ব্যবস্থা যাতে কোমলমতিরা এমন জঘন্য অপরাধে জড়িয়ে যেতেও কুণ্ঠা বোধ করছে না। আমাদের আসছে খুঁজে বের করতে হবে জঙ্গিদের মদদদাতা ও নেপথ্যের লোকদের। নিহত সন্দেহভাজন জঙ্গিরা পরিবার থেকে অন্তর্ধানের পর এবং হামলার আগ পর্যন্ত কোথায়, কাদের আশ্রয়ে ছিল, কারা তাঁদের জঙ্গি দলে টানল এসবই খুঁজে বের করতে হবে।

আমাদের এটাও ভাবতে হবে, কিসের এমন টান যার জন্য মা-বাবার ভালোবাসাকে উপেক্ষা করা চলে।

তবে এটাও সত্য, যতই অসহায়ত্ব থাকুন, দায় এড়ানো যাবে না। আপনার সন্তানকে ভালো রাখার বড় দায়িত্বটি আপনারই। তাই সকলের প্রতি আহ্বান, সন্তানদের প্রতি খেয়াল রাখুন। কোনও ধরনের অস্বাভাবিকতা টের পেলে বড় ধরনের বিপদ ঘটিয়ে ফেলার আগেই সন্তানকে সুপথে ফিরিয়ে আনুন। আসলে পারিবারিক সচেতনতাই পারে সন্তানকে বিপথগামীতা থেকে ফিরিয়ে আনতে।

বাংলাদেশ সময় ১২২০ ঘণ্টা, জুলাই ০৫, ২০১৬
এমএমকে/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।