ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

বঙ্গবন্ধু মাটির মানুষ!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮১৭ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১৬
বঙ্গবন্ধু মাটির মানুষ!

১৯৭০ এর রোজার ঈদের দিন। ঈদ মানেই আনন্দ, কিন্তু সেবার ঈদের আনন্দটা একটু বেশিই হয়েছিল।

বয়স আর কত হবে আমার, ১৪ বছরের টগবগে তরুণ আমি। ভাই আর বন্ধুদের সাথে চলে গিয়েছিলাম ঈদের নামাজ পড়তে ধানমন্ডির ৮ নম্বর রোডে অবস্থিত ধানমন্ডি ক্লাবের মাঠে। আমাদের লেক সার্কাস কলাবাগানের খুব কাছে হওয়াতে পায়ে হেঁটেই চলে গিয়েছিলাম নামাজ পড়তে।

সাধারণত কলাবাগানের বশিরউদ্দিন রোডের মসজিদেই আমরা ঈদের নামাজ পড়তাম। কিন্তু সেবার অন্য এক আকর্ষণে গিয়েছিলাম ধানমন্ডির মাঠে। আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন সেই সময়কার পূর্ব বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বঙ্গবন্ধু সব সময় ধানমন্ডি মাঠে নামাজ পড়তেন। তাই স্বপ্নপুরুষ বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছ থেকে দেখতে এবং তার সাথে নামাজ পড়ার দুর্লভ সুযোগ কাজে লাগাতে চলে গিয়েছিলাম ধানমন্ডির মাঠে। তেমন কোনো নিরাপত্তা বা প্রটোকল না থাকাতে আমরা বঙ্গবন্ধুর পিছনে খুব কাছের সারিতে বসেছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল নামাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথে বঙ্গবন্ধুর সাথে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা। নামাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল প্রিয় নেতার সাথে কোলাকুলির মাধ্যমে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে। এত ভিড়ে আমি আর পারিনি, বন্ধুদের কেউ কেউ পেরেছিলো। দূর থেকে দেখছিলাম আর অবাক হচ্ছিলাম এই ভেবে যে এতো বড় মাপের নেতা কিন্তু কোনো অহংকার নেই, সবার সাথেই হাসিমুখে শুভেচ্ছা বিনিময় করছিলেন।

তারপর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই একই মাঠে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সাথে ঈদের নামাজ পড়েছিলাম। সেই স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বল করছে। তখন তিনি ছিলেন জাতির জনক, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, ছিল প্রটোকল এবং নিরাপত্তা। তাই দূর থেকেই বঙ্গবন্ধুর হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখছিলাম আর ভাবছিলাম অবাক হয়ে যে, একটি রাষ্ট্রের প্রধান হয়েও তিনি জাতীয় ঈদগাহে যাননি নামাজ পড়তে। একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে পাড়া-প্রতিবেশীদের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নিতেই তিনি ভালোবাসতেন। কিন্তু আজ এই চিত্র বিরল! রাষ্ট্রপ্রধানদের না হয় বাদ দিলাম, সাধারণ এমপি, রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের এলাকা ছেড়ে চলে যান ঈদের নামাজ পড়তে জাতীয় ঈদগাহে। মনে করেন জাতীয় ঈদগাহে যেয়ে নামাজ পড়া একটা ‘প্রেস্টিজ! তাই বর্তমান তরুণ নেতাদের বলবো বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে নিজের এলাকা, নিজের লোকদের ভালোবাসতে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন একেবারে মাটির মানুষ, ছিলো না কোনো অহমিকা। আর তাইতো দেখি সাধারণ চেক লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি পরে চলে আসতেন ৩২ নম্বরের ব্যালকনিতে কর্মী আর জনগণের ভালোবাসা নিতে। তা ছাড়া ৩২ নম্বরের জাদুঘরে গেলে দেখা যায় কি সাধারণ জীবন যাপন করতেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু।

ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটি তিনি ভালোবাসতেন প্রাণ দিয়ে। আর বাংলার মানুষের ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দুও ছিল সেই ঐতিহাসিক বাড়িটি। প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি হয়েও এই বাসা ছেড়ে যাননি গণভবন বা বঙ্গভবনে। নিরাপত্তার কথা বললে বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘কোনো বাঙালি তাকে মারতে পারে না‘! কিন্তু হায়, কিছু ‘কুলাঙ্গার’ বাঙালির হাতেই সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে প্রাণ দিতে হলো এই বাড়িতে! বাঙালি জাতি হাজার বছর ধরে ছিল পরাধীন। দীর্ঘদিন ধরে নিপীড়িত শোষিত জাতিকে মুক্তির স্বাদ দিতে আল্লাহ বঙ্গবন্ধুকে পাঠিয়েছিলেন এই ধরণীতে। তার আত্মজীবনী পড়লে বোঝা যায় বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য কি আত্মত্যাগ তিনি করেছিলেন। যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো তিনি কাটিয়েছিলেন কারাগারে। পিতার আদর যত্ন ছাড়া সন্তানেরা বেড়ে উঠছিলো তার অবর্তমানে। আর তাইতো দেখি জেল থেকে বাসায় ফিরলে বড় ছেলে কামাল বোনকে আবদার করে বলতো, ‘হাসু আপু তোমার আব্বাকে কি আমি আব্বা বলে ডাকতে পারি’?

বঙ্গবন্ধুর মতো সাহসী এবং প্রত্যয়ী নেতা পেয়েছিলাম বলে আমরা এতো অল্প সময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম। দীর্ঘ সংগ্রামের পর এইতো সেদিন স্বাধীনতার স্বাদ পেলো ইরিত্রিয়া এবং দক্ষিণ সুদান। অনেক জাতি এখনো সংগ্রাম করে যাচ্ছে মুক্তির জন্য। তাই আমরা সত্যিই ভাগ্যবান। আজ বছর ঘুরে আবার এসেছে জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে কালো দিবস ‘১৫ আগস্ট’! ঘাতকরা ভেবেছিলো বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে শেষ করলে ‘৭১ এর পরাজয়ের শোধ নেওয়া হবে, বাংলাদেশ আবার পাকিস্তান হয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বন্দুকের নলে ২১ টি বছর পাকিস্তানি এজেন্টরা সেই ভাবেই দেশ পরিচালনা করেছিল। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তার সুযোগ্য কন্যার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাঙালি জাতি আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে, দেশ আবার পরিচালিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। আজ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বাঙালির হৃদয়ে গেঁথে আছেন আরো শক্ত হয়ে। মৃত বঙ্গবন্ধু জীবিত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে আরো শক্তিশালী। তাই আসুন আজ শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে বাঙালির মাটির মানুষ বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করি। তা হলেই বঙ্গবন্ধুর বিদেহী আত্মা শান্তি পাবে। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

ডা. মুহাম্মদ আলী মানিক: সহ-সভাপতি, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ

বাংলাদেশ সময়: ০৮১০ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১৬
এমজেএফ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।