ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

...দুই পাকি। বজ্জাতগুলো এখনও বাঙালির সমস্যা করছে

ফজলুল বারী, অতিথি কলামিস্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩৮ ঘণ্টা, জুলাই ২৮, ২০১১
...দুই পাকি। বজ্জাতগুলো এখনও বাঙালির সমস্যা করছে

একেবারেই কাকতালীয় মামুনের সঙ্গে পরিচয়টা। ট্রেনে এক বাঙ্গালি ভদ্রলোক ফোনে জোরে শব্দ করে কথা বলছিলেন।

এদেশে অভিবাসী অনেকে এই ভব্যতার বিষয়টি মনে রাখেন না। তবে এ কাজটিই যেন মামুনের জন্য পজিটিভ হয়েছে। টেলিফোন সূত্রে একজন বাঙ্গালি দেশি ভাইকে শনাক্ত করে তার কাছে জব চাইতে শুরু করে দেয় সে।

যুবক অস্ট্রেলিয়া এসেছে দশ দিন হয়। আইএলটিএস’এ যথেষ্ট স্কোর না থাকাতে এখানে আসার পর ধরিয়ে দেয়া হয়েছে ষোল সপ্তাহের বাড়তি একটি ইংলিশ কোর্স। ফাঁকে ফাঁকে খুঁজছে জব। কিন্তু এখনও জবের কোনও কিনারা করতে না পেরে তার একুশ বছরের মুখটা বেশ বিধবস্ত। মলিন। তাকে দেখি আর মনের ভিতরটা মোচড় মারে। এতো আমার সাবজেক্ট! কিন্তু পথের সিডনাম স্টেশনে নেমে যাব বলে গায়ে পড়ে নিজের নম্বরটি দিয়ে বলি, এতে একটা মিসকল ফেলে রাখুন। আপনার সঙ্গে পরে কথা বলব।

সিডনামের কাজ সেরে চলে এসেছি সিডনির পাঞ্চবলে আরেক কাজে। পাশের ওয়ালি পার্কে ডেরা আমার। পাঞ্চবলের কাজ প্রায় শেষ করতে কল পাই মামুনের। রিসিভ করি না। সেটি মিসকল হবার পর কলবেক করে বলি, আমাকে আপনি কল করবেন না। মিসড কল দেবেন। কারণ আমি অস্ট্রেলিয়ার ভিতরের যে কোন ফোনে আনলিমিটেড ফোন করতে পারি। তা ছাড়া তার ফোনটি প্রিপেইড। লিব্রা কোম্পানির। আমারটা অপটাসের। কাজেই সে আমাকে কল করলে আর আমি রিসিভ করলে তরতর তার সব ক্রেডিট কাটা যাবে। তার দরকার জব। আর আমি শুরুতেই তাকে মিসড কল দেবার অনুমতি দিচ্ছি দেখে খুব স্বাভাবিকভাবেই  প্রীত হয় যুবক। তার লোকেশন জেনে অপেক্ষা করতে থাকি পাঞ্চবল স্টেশনে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় বাড়ি। পুলিশ অফিসার বাবা মারা যাবার পর বড় ভাই অভিভাবক। ঢাকায় থাকতেন মিরপুরে। সিডনিতে নিজের কোন আত্মীয়স্বজন নেই। বড়ভাইর পরিচিত দয়ালু এক ভদ্রলোক তার স্পন্সর হন। তাও আবার সাদামাটা স্পন্সর না। সত্তুর লাখ টাকার মতো ব্যাংকে দেখানোয় একটি ব্যাচেলর কোর্সের বিপরীতে প্রায় চার বছরের ভিসা নিয়ে সে এসেছেন। জমা টাকা দেখানোর সমস্যায় আজকাল বাংলাদেশ থেকে অনেক ছাত্র এক-দেড় বছরের ভিসা নিয়ে চলে আসছেন। এক-দেড় বছর পর পর নতুন করে স্পন্সর চাইলে ভিসা বাড়ানো নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। মামুনের ব্যাপারে এ ব্যাপারে প্রথম পজিটিভ খবরটা শুনি। অর্থাৎ এক-দেড় বছর পর তার অন্তত ভিসার পেরেশানিতে পড়তে হবে না।

সেই দয়ালু স্পন্সর ভদ্রলোকের শ্যালকই তাকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করেন। সিডনির ইস্টলেকসের নিজের বাসায়  রাখেন দু’দিন। এরপর পাঞ্চবলে তুলে দিয়ে যান পরিচিত ছাত্রদের ডেরায়।

এদেশে ওভারসিজ স্টুডেন্ট হিসাবে ওই বেচারারাও যার যার কাজ-ক্লাস-সংগ্রাম নিয়ে ব্যস্ত। অথবা তারা আপদকালীন থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা দিয়েছে দেখে মামুন হয়তো কাছে কাজ চেয়ে তাদের অখুশি করতে চাননি।

এমন মনভাঙ্গা ছেলেদের প্রথম সঙ্গে নিয়ে আমি খাইদাই, ঘুরি। স্বাভাবিক নানা গল্প করে বুস্টআপ করার  চেষ্টা করি। পাঞ্চবল স্টেশন থেকে মামুনের জন্য একটি রিটার্ন টিকেট কিনি কেমসি স্টেশনের। ওখানের একটি চীনা দোকানে সপ্তাহের মাছ কিনতে যাই। কেমসি সিডনির চীনা-কোরিয়ান অধ্যুষিত এলাকা। এ দোকানের খদ্দের বেশিরভাগ একটা-দুটো বা এক-দু’ টুকরো মাছ কেনে। আমরা বাঙ্গালিরা একসঙ্গে অনেক মাছ কিনি বলে দোকানিরও বেশ সমাদর পাই।

সামুদ্রিক কোনও মাছের কি নাম জিজ্ঞেস করেন মামুন। সবগুলোর নাম জানি না বা মনে রাখতে পারি না। মাছের বক্সের গায়ে লাগানো নামাঙ্কিত স্টিকার দেখিয়ে তাকে জ্ঞানার্জনে সহায়তা করি। কাটাকুটি পরিষ্কারের পর পলিথিনের ব্যাগে ভরা মাছসব দুহাতে দু’জনে নিয়ে স্টেশনের পথে হাঁটতে হাঁটতে বলি, `এখানে বাংলাদেশের টাকায় প্রায় চার হাজার টাকার মাছ। বাংলাদেশের টাকার সঙ্গে গুণ করলে এখানে কিছু কিনতে, খেতে পারব না। প্রথম প্রথম সবাই এমন করে। আমিও করেছি। এখন আর করি না। তুমিও এক সময় করবে না। মামুনকে ততক্ষণে তুমি বলা শুরু করেছি। আমি হয়ে গেছি তার বারী ভাই। `

কেমসি থেকে এসে নামি লাকেম্বায়। এটিকে বলা হয় সিডনির বাঙ্গালিদের ইস্ট লন্ডন। এক জায়গাতে বাঙ্গালি মালিকানাধীন দোকান এখানেই বেশি। বাংলাদেশের সবধরনের খাবার থেকে শুরু করে বটি-দা’, পাটা-পুতাও পাওয়া যায়। লাকেম্বায় নামার কারণ মামুনের জন্য জব-বাসা দুটোই খোঁজা। নতুন আসা স্টুডেন্ট দু’জন এখন আমার কাছে। উলুঙ্গন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা খুলনার ছেলে শাওন আর এই মামুন। দু’জনের জন্য একটা রূম পেয়ে গেলে ভালো হয়। লাকেম্বার এ দোকানগুলোর দেয়ালে শেয়ার অ্যাকোমডেশনের অনেক বিজ্ঞাপন। একটা একটা নম্বর নিয়ে ফোন করা শুরু করেছি। এক নম্বরে ফোন যেতেই বাঙ্গালি এক ভদ্রমহিলা বলেন, আমাদের ফ্যামেলি বাসা। আমরা ছোট কোনও কাপল বা কোনও মেয়ে স্টুডেন্ট খুঁজছি।

আরেক নম্বরে ফোন করতে দেখি ভদ্রলোক পরিচিত। নম্বরটা সেভ করা। তারা দু’জন দুটি রুমে থাকেন। লাউঞ্জে ভাড়া দেবার জন্য কোনও সিঙ্গেল স্টুডেন্ট খুঁজছেন। অস্ট্রেলিয়ার অনেক স্টুডেন্ট এমন লাউঞ্জের সোফা বেডে থাকেন। লাউঞ্জে যিনি থাকেন তাকে তুলনামূলক কম ভাড়া দিতে হয়। মামুনের আবাসিক সমস্যার আপাতত একটি সমাধানের ইঙ্গিত দেখি। লাকেম্বায় আমরা সাধারণত গোস্ত আর বাঙ্গালিদের গ্রোসারি সামগ্রী কিনতে আসি। তেমন কিছু কেনাকাটা শেষে ট্রেন ধরে আবার পাঞ্চবল।

সকাল থেকে গাড়িটা বিশ্রাম নিচ্ছে সেখানকার পার্কিং’এ। গাড়িতে বাজার-সদাই জায়গা করে স্টার্ট নিয়ে ওয়ালি পার্কের ডেনমান এভিনিউর ডেরায়। আমার নতুন বন্ধু মামুনের আগে  খাওয়া-দরকার। বাঙ্গালির মাছ-ভাত।

খাবার টেবিলে মাছের নাম নিয়ে আবার পড়ি বিপদে। নতুন শহরে সবকিছু নিয়ে কৌতূহল মামুনের। এ মাছটার নাম কি? বললাম, মনে করতে পারবনা। বাংলাদেশের কালি বাউশের মতো দেখতে। খেতে মজা আর সস্তা বলে কিনি। মামুন বললো স্বাদটা অনেকটা ইলিশের মতো। বললাম এদেশের সামুদ্রিক অনেক মাছই ইলিশের মতো দেখতে অথবা খেতে। কিন্তু এই মাছটা দেখতে মোটেই ইলিশের মতো নয়। অনেকটা ছোট আকারের কালি বাউশ।

ক্রমশঃ মামুনকে অনেকটা স্বাভাবিক দেখাচ্ছে দেখে ভালো লাগে। মনে হয় ও’বেশ আশ্বস্ত বোধ করছে। এটিও ভালো লাগে খুব। খাওয়ার পর দু’জনের জন্য দু’মগ কফি বানিয়ে নিয়ে আসি দোতলার স্টাডি রূমে। আমার ডেরার লাউঞ্জ-ডাইনিং-কিচেন নিচে। বেডরুম-স্টাডিরুম উপরে। এগুলোকে এদেশে বলে টাউন হাউস।

কাজের জন্য ফোন দিই কয়েক জায়গায়। একজনের সঙ্গে রাত ন’টায় তার বাসায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়। অতএব ততক্ষণ মামুন আছে আমার সঙ্গে। শাওনের গল্প তাকে বলি। রাত আটটায় কাজ শেষ হবে শাওনের। এরপর তার সঙ্গে দেখা করতে তাকে বাসায় পৌঁছে দিতে যাব। এই ফাঁকে মায়ের সঙ্গে মামুনকে কথা বলিয়ে দিতে কলিংকার্ডে পিন টিপে ফোন লাগাই বাংলাদেশে। কিন্তু এবার পড়ি সমস্যায়। মা’র গলা শুনেই কাঁদতে শুরু করে মামুন। এক ভাই আমাকে পথ থেকে ধরে তার বাসায় নিয়ে এসেছেন। এখন আমার জবের জন্য চেষ্টা করছেন। ফোন দিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলেন মা। বাবা তোমারে আমারে আল্লায় মিলাইয়া দিছেন। চোখ ভরে জলে। মাকে আশ্বস্ত করে বলি, আমি ভালো থাকলে আমার এই ভাইটিও ভালো থাকবে।

মামুনকে শাওনের কাজের জায়গায় নিয়ে আসি। কাজ শেষে বেরিয়ে অপেক্ষায় বসেছিল সে পার্কিং এলাকায়। মামুনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই। কাজের জায়গায় শাওনের সঙ্গে সমস্যা করছে দুই পাকি। বজ্জাতগুলো এখনও নানান জায়গায় বাঙালির সমস্যা করে। সব শুনে সম্ভাব্য কিছু সমাধান নিয়ে শেয়ার করি আমরা তিনজন। এরপর গাড়ি নিয়ে চলে আসি ওয়ালি পার্কের হিলার্ড স্ট্রিটে। রাত ৯ টার অ্যাপয়েন্টমেন্ট। ভদ্রলোকের বাড়ি সিলেটে। আমাদের মধ্যে সিলেটি আঞ্চলিক ভাষার কেমিক্যাল রিয়েকশন হয়। খুব স্বাভাবিক আমাদের কথাবার্তার বেশিরভাগ বুঝতে পারে না খুলনার ছেলে শাওন আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছেলে মামুন।

অতকিছু বোঝার দরকারও নেই। আমার দরকার মামুনের জন্য একটা কাজ। শাওন এখন একটা কাজ করছে। আর এখানকার কাজ তার ক্লাসের সময়ের সঙ্গে মিলবে না।

নানা সিলেটি গল্পের পর চূড়ান্ত হয় পরের বিকেল থেকে মামুনের ট্রেনিং শুরু হবে। কাজ যত দ্রুত সে রপ্ত করতে পারবে অফিসিয়াল শিফট শুরু হবে তত দ্রুত। আমার ভিতরটা নাচতে থাকে আনন্দে। ভদ্রলোককে বলি আপনি এখন ক্লান্ত। আজ উঠি। কাল বিকেলে আমি এসে মামুনকে আপনার বাসায় নামিয়ে দিয়ে যাব। ওর থাকার ব্যবস্থাও হয়ে যাচ্ছে আপনার বাসার পাশে। যাতে সে আপনার সঙ্গে কাজে যাওয়া-আসা করতে পারে।

হিলার্ড স্ট্রিটের ফুটপাত ধরে গাড়ির দিকে এগিয়ে যাই আমরা তিনজন। মামুনকে সেলিব্রেট করি। হঠাৎ সে অন্য এক মামুন আমাদের মধ্যে। উচ্ছল। আত্মবিশ্বাসী। সকৃতজ্ঞ। গাড়ির আলোতে দেখি মামুনের চোখে জল। তাকে আদর করে বলি আমরা দু’জন তোমার ভাই। বাংলাদেশের মামুনেরা এমনিই কাজের প্রস্তুতিবিহীন বিদেশে আসে। আইএলটিএস দেয়, সবকিছু করে। কিন্তু যা কিছু করে এখানে খেয়েপরে চলতে হবে টিউশন ফি জোগাড় করতে হবে সে কাজের কোন প্রস্তুতি ট্রেনিং নিয়ে আসে না।

মামুনদের প্রথম উদ্বিগ্ন উদভ্রান্ত দিনগুলোতে একটু সাপোর্ট দিলেই এনাফ। এরপর মামুনরা একাই চলতে-হাঁটতে পারে। যখন নতুন আরেকজন মামুন বাংলাদেশ থেকে আসবে, হাত বাড়িয়ে দেবে পুরনো মামুনরা। বিদেশে এভাবেই শুধু বাড়বে বাঙ্গালির পরিশ্রমী মেধাবী প্রজন্ম। এ স্বপ্নের কথা মামুনকে বলা হয়েছে।

ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।