সিডনির রাস্তায় গাড়ি চালাই আর ভাবি, বাংলাদেশে গেলেতো কখনো গাড়ি চালাতে পারব না। অথবা অস্ট্রেলিয়ায় গাড়ি চালানো যতটা নিরাপদ, বাংলাদেশে তা শতগুণ ঝুঁকিপূর্ণ! সিডনির পথঘাট কিন্তু ঢাকার চেয়ে চওড়া বেশি না।
বেত মানে ফাইন-জরিমানা! টহল পুলিশ ঘুরছে রাস্তায়। রাস্তার মোড়ে মোড়ে এখানে সেখানে শুধু ক্যামেরা আর ক্যামেরা। মহাসড়কে জায়গায় জায়গায় ক্যামেরা। অথবা বলা চলে এদের পুরো দেশটা ক্যামরার মধ্যে! অতএব পথ আইনের একটু ওলটপালট করেছেনতো জরিমানা আর পয়েন্ট খোয়া! পয়েন্ট মানে এদেশের প্রতিজন ফুল লাইসেন্সধারী চালকের অ্যাকাউন্টে বছরে পয়েন্ট থাকে ১২ টি। বেশিরভাগ জরিমানার সঙ্গে তিন পয়েন্ট খোয়া যায়। এভাবে বছরের ১২ পয়েন্ট খোয়া গেলে ওই বছর আপনি আর গাড়ি চালাতে পারবেন না।
নতুন চালক তথা রেড-পি ধারীদের পয়েন্টের পরিমান ৪। এরা আবার একটা পেনাল্টি খেলে জরিমানার সঙ্গে তার ওই চার পয়েন্ট খোয়া যায় তিন মাসের জন্য। অর্থাৎ তিনমাস আপনি গাড়ি চালাতে পারবেন না। ওই অবস্থায় গাড়ি চালাতে পাওয়া গেলে সোজা জেলে! অতএব এদেশে যে যতবড় মস্তান হোক, রাস্তায় সবাই আমার মতই সুবোধ-সোজা!
সড়ক শাসনের কঠোর-কঠিন সব ব্যবস্থার কারণে এদেশে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়াও অনেক কঠিন।
তাই মজা করে বলা হয় অস্ট্রেলিয়ায় ড্রাইভিং লাইসেন্স পাবার চেয়ে নাগরিকত্ব পাওয়া সহজ। ড্রাইভিং শিখতে যাবার আগে কম্পিউটারে অনলাইনে প্র্যাকটিস করে পরীক্ষা দিয়ে লারনার পাস করতে হয়। ওই লারনার প্র্যাকটিসের সময়েই সড়কের আইন-নিয়মকানুনের ব্যাপারে আপনার ভালো একটি ধারনা হয়ে যাবে। কোথায় কোন সড়কে ওঠার আগে থামতেই হবে। গিভওয়ে, সিগন্যাল, স্পিডলিমিট, জরিমানা, কখন কখন আপনি ড্রাইভিং করতে পারেন না, এর সবই ওই লারনার প্রশিক্ষণে শেখা হয়ে যায়।
এরপর লারনার হিসাবে আপনি যে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেলেন, সেটি সঙ্গে রেখে কোন অনুমোদিত প্রশিক্ষক বা কোন একজন ফুল লাইসেন্সধারীর সঙ্গে আপনি রাস্তায় ড্রাইভিং শিখতে পারবেন রাস্তায়। এসব দেশেতো কেউ কাউকে দেবার মতো এক্সট্রা-আলগা টাইম নেই! তাই বেশিরভাগ লোকজন ড্রাইভিং প্রশিক্ষকদের কাছে ড্রাইভিং শেখেন। এটিও খুব ব্যয়বহুল। ঘন্টায় ৩৫-৫০ ডলার। যাদের অনেকদিন ধরে প্রশিক্ষকের কাছে গাড়ি চালানো শিখতে হয়, তাদের মোট কত শ’ বা হাজার ডলার যায়, তা তারাই জানেন। প্রশিক্ষকও নিখুঁতভাবে গাড়ি চালনা শেখান। কোথায় স্টপ সাইনে না থামলে, গিভওয়ের সময়, বা রাউন্ট অ্যাবাউটে ঢোকার আগে ডাইনে-বাঁয়ে না তাকালে বা চালানোর লেন মার্কিং টাচ করলেই যে ফেল, এমন খুঁটিনাটি বিষয় শেখান প্রশিক্ষক। এরপর প্রশিক্ষক যখন আপনাকে উপযুক্ত মনে করবেন তখন ড্রাইভিং টেস্টের বুকিং নেবার পরামর্শ দেবেন। নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে নিতে হয় সেই বুকিং।
এদেশের আরটিএ তথা রোড অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির পরীক্ষকরা নেবেন আপনার টেস্ট। আপনি গাড়ি চালাবেন আর পাশে পরীক্ষক বসে বসে বলবেন, এদিকে যাও, ওদিকে যাও! লেন চেঞ্জিং, কিছু পার্কিংও করানো হবে ওই সময়ে। এমন ৩০-৪৫ মিঃ চালনায় পরীক্ষক সন্তষ্ট হলে আপনি পাশ করবেন ড্রাইভিং টেস্ট। এদেশে এই টেস্টে খুব কম লোক একবারে পাশ করে। হান্ড্রেট পারসেন্ট নিখুঁত না দেখে সাধারণত কোন প্রশিক্ষক পাশ দেন না। ফেল করালে বলে দেন, কি কি কারণে ফেল। পরের টেস্টের আগে কি কি বিষয় ইম্প্রুভ করাতে হবে।
টেস্টে পাশ করলে নতুন একজন চালককে একবছরের জন্য প্রভিশনাল লাইসেন্স তথা রেড পি লাইসেন্স দেয়া হয়। রেড পি’ওয়ালাদের স্পিডলিমিট ঘন্টায় ৯০ কিঃমিঃ। এভাবে এক বছর গাড়ি চালানোর পর অনলাইনে হ্যাজারড প্রটেকশন টেস্টে পাশ করলে ২ বছরের জন্য ২ বছরের জন্যে দেয়া হয় গ্রিন পি। ১০০ কিমিঃ ঘন্টায় স্পিড লিমিট গ্রিন-পি ধারীর। রেড ও গ্রিন পি তথা প্লেটওয়ালাদের বাধ্যতামূলক ওই স্টিকার লাগানো অবস্থায় গাড়ি চালাতে হয়। এভাবে রেড ও গ্রিন পি’ জীবনের মোট তিন বছর পার করে একজন ফুল লাইসেন্স পান।
এদেশে ফুল লাইসেন্সধারী ছাড়া কেউ ট্যাক্সি ক্যাব চালাতে পারেন না। বিগত পাঁচবছর যাদের কোন ট্রাফিক অফেন্স ছিলো না, তারাই শুধু ড্রাইভিং প্রশিক্ষক হতে পারেন। বাংলাদেশ থেকে অনেকে জাল ফুল লাইসেন্স আনিয়ে এদেশের আরটিএ’র কাছে জমা দিয়ে সরাসরি ফুল লাইসেন্স নিয়েছেন। কিন্তু এসব কেলেংকারি ধরা পড়ার পর এরা এখন এসব লাইসেন্সের ব্যাপারে দূতাবাসের ভেরিফিকেশন সার্টিফিকেট চায়। কিন্তু দেশটা আমাদের বাংলাদেশতো। তাই ওই সার্টিফিকেটও এখানে জাল হচ্ছে।
এত সতর্কতা সত্ত্বেও এদেশে দুর্ঘটনা হচ্ছে। এসব দুর্ঘটনার বড় দুটি কারণ ড্রাংক ড্রাইভিং আর মোবাইল ইউজিং। এরকারণে কেউ মদ্যপান করে গাড়ি চালাচ্ছে কিনা তা চেক করতে রাস্তার ব্রেথ টেস্টিংসহ নানা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। বিশেষ করে শনিবার রাতে এমন পরীক্ষা চলে বেশি। পরীক্ষায় মদ্যপান প্রমাণিত হলে জরিমানাসহ লাইসেন্স সাসপেন্ড। সোজা হাজতের উদ্দেশেও নিয়ে যেতে পারে।
ড্রাইভিং’এ মোবাইল ফোন ব্যবহাররত অবস্থায় টহল পুলিশের নজরে পড়লে আপনার জরিমানা-লাইসেন্স সাসপেন্ড বা পয়েন্ট খোয়া সব হাতেনাতে পেয়ে যাবেন। এদেশে পুলিশ ঘুষ খায়নাতো! তাই কিছু একটা গুঁজে দিয়ে যে পার পেয়ে যাবেন সে ব্যবস্থাও নেই। সে চেষ্টা করতে গেলেতো সোজা জেল! এদেশের পুলিশ কোথাও আপনাকে মারবে না বা রূঢ় আচরণ করবে না। জরিমানাও কোথাও নগদে নেবে না কেউ। মিষ্টি মিষ্টি কথায় আপনাকে একটা রসিদ দেবে বা আপনার ঠিকানায় হেঁটে হেঁটে চলে আসবে পেনাল্টি নোটিশ! এদেশে আমাদের জীবন কঠিন-ব্যয়বহুল। এর সঙ্গে আসে যদি অনাকাঙ্ক্ষিত কোন পেনাল্টি নোটিশ! সেজন্য সবাই খুব সাবধানে চলি। এসব সাবধানতা থেকে সংযুক্ত একটি নিরাপত্তা তৈরি হয় অস্ট্রেলিয়ার সড়কে।
এসব থেকে বহু দূরে ভিনগ্রহের নিয়মে চলে স্বেচ্ছাচারী বাংলাদেশ! যেখানে বিনা টেস্টে লাইসেন্স দেবার প্রকাশ্যে আবদার করেন মন্ত্রী! এমন বেআইনি বক্তব্যের পরে তাঁকে পদচ্যুত-গ্রেফতার করা হয় না। সড়ক যোগাযোগের পুরো ব্যবস্থাই দুর্নীতিগ্রস্ত। বেশিরভাগ চালক হেলপার থেকে ড্রাইভার। ওস্তাদের সঙ্গে থাকতে থাকতে ড্রাইভিং শিখেছেন। ওস্তাদ যেহেতু রাস্তার আইন-নিয়ন কানুনের কিছু জানেন না, সাগরেদও জানে না। লাইসেন্সও তারা পেয়ে যান অবলীলায়! এমন দেশে জীবন হাতে নিয়ে মানুষকে স্বপ্ন দেখান কৃতি তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীররা। তারা তারেক মাসুদ-মিশুক মুনীর বলেই মানিকগঞ্জ ট্র্যাজেডির পর আজ এমন সবাই মিলে আমরা হৈচৈ করছি। প্রতিদিন যে কত লোক মরেন সড়ক দূর্ঘটনায়, বেশিরভাগ সময় তা পাত্তাই দেইনা, লাশ কম হলে ভালো কাভারেজও দিই না মিডিয়ায়! আর কতো কৃতীর লাশ গুনে হবে সড়ক নিরাপদ? কেউ জানে না!
এমন আল্লার ওয়াস্তে চলছে অথবা আল্লায় চালাচ্ছে আমার বাংলাদেশ!
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক।