ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

মানুষ মরুক-ভোটবাক্স থাকুক অক্ষত

স্বপন চক্রবর্ত্তী, নিউইয়র্ক থেকে | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৩ ঘণ্টা, আগস্ট ১৬, ২০১১
মানুষ মরুক-ভোটবাক্স থাকুক অক্ষত

শনিবারটি কোন কোন সময় অনেক বেশী ব্যস্ততায় কাটাতে হয় । এমনই একটি শনিবার ভোর ছয়টায় ঘুম থেকে উঠেই শুরু হলো একের পর এক কাজ, সেসব কাজের ফিরিস্তি দিয়ে লাভ নেই, একটি নুতন কাজ যোগ হয়েছে গত কয়েক দিন ধরে সেই লিস্টে, আমার পাশের প্রতিবেশিনী নিউইয়র্ক স্কুল অথরিটির অবসর প্রাপ্ত অশীতিপর প্রবীণাকে তার অনুরোধে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসার পর থেকে তার শারীরিক অবস্থা ও নিত্যদিনের প্রয়োজন সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া ও তার প্রয়োজনীয় খাবার ও সামগ্রীর যোগান দেওয়া।

আমার মা তার রান্না করা খাবার দেবার জন্য আমায় পীড়াপীড়ি করেন বটে, কিন্তু উত্তর আমেরিকার খাস বাসিন্দা আমার এই প্রতিবেশিনীর আবার আমাদের পদ্ধতির রান্না খুব একটা মুখে রোচে না । তদুপরি আমার মায়ের ঝাল দেয়া তরকারী খেয়ে বুড়ির যদি কোন সমস্যা হয় তখন আরেক বিপদ । আমার স্ত্রী গেছেন বাংলাদেশে বেড়াতে গ্রীষ্মের ছুটিতে ছেলেমেয়ে নিয়ে, আমার বাবার শরীর ভালো না বলে আমার যাওয়া হয়নি, তাই আমি আছি বাবা মা কে নিয়ে এখানে । বুড়ির দেখাশোনার এই অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের ভারটা আমার কাছে মনে হলো খুব জরুরি, কারণ একেত উনি বিধবা ও নিঃসন্তান, তদুপরি উনার যে বোনটি উনার নিত্য দেখাশোনা করেন তিনি ও গেছেন বেড়াতে; এই অবস্থায় আমার মায়েরই প্রায় সমবয়সী এই বৃদ্ধার দেখাশোনা করাটা আমার নিত্যদিনের কাজের লিস্টে এভাবেই যোগ হয়ে গেলো ।

শনিবারটিতেই সব রকমের বাজারপাতি সারতে হয় যেহেতু কাজের চাপে সপ্তাহের অন্যদিনগুলোতে সুযোগ পাওয়া যায় না। আমাদের খাবারের প্রায় অধিকাংশ বাজারই করতে যাই জ্যাকসন হাইটসের বাঙ্গালী মার্কেটে । আর জ্যাকসন হাইটসে গেলেই একবার ঢুঁ মারি আমাদের বিশ্বজিতের বিখ্যাত বই-সিডি কাম ডিভিডি’র দোকান ‘মুক্তধারা’ তে । খোঁজ নিই নুতন কি বই এলো বা আমার নিয়মিত সংগ্রহের ‘দেশ’ পত্রিকাটি নেবার জন্যে । আজ গিয়ে দেখি বিশ্বজিত ব্যস্ত এক গ্রাহক নিয়ে, আমায় দেখে বললো, ‘দাদা, ‘দেশ’ এর শারদীয় সংখ্যা আপনি কি নেবেন তা একটু লিখে দিয়ে যান’। বিশ্বজিতের সহকর্মী ভারী মিষ্ট স্বভাবের ‘আজাদ’ নামের ছেলেটি একটি লিস্ট এগিয়ে দিলো, আমি তা দেখছিলাম, আর এই ফাঁকে বিশ্বজিত বললো, ‘দাদা শুনেছেন স্যাড নিউজটা’? আমি চোখ তুলে ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকালাম, সে বললো, ‘তারেক ভাই আর নেই, তারেক মাসুদ, সড়ক দূর্ঘটনা! আমি কতক্ষণ মূক ও বধিরের মতো বিশ্বজিতের দিকে তাকিয়ে রইলাম । বিশ্বজিত বললো, দাদা আজ সন্ধ্যায় আমরা উনার স্মরণে ছোট্ট আয়োজনে একটি শোকসভা করবো, প্লিজ আসবেন । স্তব্ধ বধির আমি আড়ষ্ট শরীর টেনে বিশ্বজিতের দোকান হতে বের হয়ে রাস্তায় নেমে এলাম। কি হবে আরেকটি শোকসভা করে, তারেক- মিশুক কি আর ফিরে আসবে? শোকসভা হবে, কিছু উত্তাপময় বাক্য ছড়াবে ইথারে, তারপর একটি প্রেসবিজ্ঞপ্তি, তারপর সব ভুলে যাওয়া! অনেকই তো দেখলাম, এভাবেই তো চলছে চিরকাল ধরে!

প্রতিদিনই সারাবিশ্বে অসংখ্য সড়ক দুর্ঘটনায় মরছে মানুষ, মানুষ হারাচ্ছে প্রিয়জন । আমেরিকা বা উন্নত দেশগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনার কারণ, আর বাংলাদেশের কারণ এর চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমেরিকা বা উন্নত দেশগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে ড্রাগ আসক্তি বা মদ্যপান করে গাড়ি চালানো, কিংবা সেল ফোনে কথা বলতে গিয়ে বা টেক্সট মেসেজ পাঠাতে গিয়ে অমনোযোগী হওয়া। বাংলাদেশে সড়ক দূর্ঘটনার মূল কারণ এর জন্যে প্রধানতঃ দায়ী সরকার ও প্রশাসনিক কাঠামোগত অব্যবস্থা। উন্নত দেশগুলোতে গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পাওয়া আর একটি কলেজ ডিগ্রি নেওয়া প্রায় সমার্থক। আর বাংলাদেশে গাড়ি না ছুঁয়েও লাইসেন্স পাওয়া কোন ব্যাপারই নয়! সাম্প্রতিককালে নাকি এক বিজ্ঞ মন্ত্রীবর চালক – মালিক সমিতিকে খুশী করার অত্যুৎসাহে বলেছেন, গাড়ী চালানোর লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে দেশে নাম মাত্র যে পরীক্ষার নিয়ম আছে তাও তুলে দিতে, বাহ- বাহ , কী গুণধর মন্ত্রী আমাদের মন্ত্রীসভায়!! এই গণ্ডমূর্খগুলো আমাদের দেশে পায় আইনপ্রণেতা হবার সুযোগ, তা দেশে আইনের হাল এমন হলে আর দোষ কোথায়!! বিগত দিনগুলোতে বহুবার এই বিষয় নিয়ে বলা হয়েছে, লেখা হয়েছে, বিভিন্ন মিডিয়ায় তুলে ধরা হয়েছে নানাভাবে, তুলে ধরা হয়েছে প্রশাসনিক কাঠামোগত অব্যবস্থার স্বরূপ। কিন্তু আমাদের ভোটে যারা রাজতখতে, তাদের চোখে প্রশাসনিক কাঠামোগত এই অব্যবস্থার স্বরূপগুলো কোন আবেদনই সৃষ্টি করে না! কোনো সরকারের আমলেই নয়! নয় কেনো? তার অন্তর্নিহিত কারণ সেই একটিই- ভোট । গাড়ি চালানোয় বা গাড়ির লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে নুতন আইন করলে দেশের অসংখ্য চালক – মালিক সমিতি বিগড়ে যাবে, আর ওইসব চালক – মালিক সমিতির নেতাদের অনেকেই সরকারি পার্টির হোমরাচোমড়াও আছেন – এমনই শোনা যায় । তবে আর কি – ‘মানুষ মরুক পথেঘাটে কুকুর বেড়ালের মতো – নেতাদের ভোটবাক্স থাকুক অক্ষত’ !!

এই কয়দিন আগেই একটি মাত্র সড়ক দূর্ঘটনায় চট্টগ্রামের মিরেরসরাই গ্রামের ঘরে ঘরে উঠে হৃদয়বিদারক কান্নার রোল। চল্লিশের ও অধিক শিশু, তরুণ একটি মাত্র সড়ক দূর্ঘটনায় নিহত হয়। ওই চালকের নাকি লাইসেন্সও ছিলো না গাড়ি চালানোর! যে চালকের গাড়ি চালানোর লাইসেন্স নেই সে কি করে গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নামে? কোন সে গাড়ির মালিক তাকে দিয়েছে গাড়ি চালানোর দায়িত্ব - আর একনিমেষে চল্লিশটি মায়ের কোল খালি করে দেবার!! সেই গাড়ি মালিকের কি শাস্তি হবে? কী শাস্তি হবে তার? দেশে একযুগের ও অধিক সময় আইনপেশায় যুক্ত থাকার কারণে জানি যে, এই ক্ষেত্রে আমাদের দেশের আইনের হাত বড্ড দুর্বল! এই গাড়িমালিক ছাড়া পেয়ে যাবে সমাজের তথাকথিত নেতাদের ও অর্থের বদৌলতে, আর গাড়িচালক বেরিয়ে যাবে দুর্বল আইনের সুযোগে! সেই আইনকে যুগোপযোগী করবার দায় বা চেষ্টা আমাদের আইন প্রণেতা তথাকথিত জনপ্রতিনিধিদের নেই, আর রাজনীতি করতে গিয়ে উনারা একটি ট্রেনিং বেশ ভালোই নিয়েছেন – তা হচ্ছে, উনাদের গায়ের চামড়া উনারা গণ্ডারের সাথে অদলবদল করে নিয়েছেন, কোন কথাই বা কোন হৃদয়বিদারক ঘটনাই উনাদের গণ্ডারসম চামড়া ভেদ করে হৃদয়ে গিয়ে পৌঁছায় না!

কিছুদিন আগেই পড়েছি, আমাদের দেশের সত্যিকারের গুণী ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রপরিচালক তারেক মাসুদ শুরু করতে যাচ্ছেন তার অনেকদিনের স্বপ্নফসল নুতন চলচ্চিত্র– ‘কাগজের ফুল’ । আশ্চর্য্য, ‘কাগজের ফুল’ কাগজেই থেকে গেলো পান্ডুলিপি হয়ে, আর সত্যিকারের সজীব ফুলে মুড়ে তারেক মাসুদ স্বয়ং যাত্রা করেছেন শেষ-শয়ানের আয়োজনে তার সৃষ্টির উত্তুঙ্গ সময়ে, সেই সাথে তার আরো চার শিল্পগুণী সহকর্মী!! আর কত মৃত্যু প্রয়োজন আমাদের তথাকথিত নেতাদের, আমলা কর্তাদের দৃষ্টি উন্মোচনে, বোধ-উন্মেষে বা আপন কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করতে!!

মিরেরসরাই গ্রামের হতভাগিনী মায়েদের মতো ক্যাথেরিন মাসুদেরও চোখের জলে জীবন কেটে যাবে, তারেক মাসুদের ছোট্ট শিশুটি কোনওদিন আর ‘বাবা’ বলে ডাকবে না, আর আমাদের অধীর আগ্রহে তারেক মাসুদের পরবর্তী ছবির অপেক্ষার কালটিকেও সেই ঘাতক চালক ও সরকার যোগসাজশে এক নিমেষে হত্যা করে ফেললো- তারেক মাসুদ ও তার সহকর্মীদের একইসাথে। । হায় রে বাংলাদেশ !!

লেখকঃ নিউইয়র্কপ্রবাসী আইনবিদ, কবি ও সংস্কৃতিসেবী

বাংলাদেশ সময় ১৩২৯ ঘণ্টা, আগস্ট ১৬, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।