ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী এবং সাংবিধানিক স্বীকৃতি

হিমু অধিকারী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ১৮, ২০১১
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী এবং সাংবিধানিক স্বীকৃতি

সম্প্রতি আলোচিত বিষয় আদিবাসী প্রসঙ্গ। সেই সূত্র ধরেই আমার চিন্তার ভেতর দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে ঘূর্ণায়মান এই আদিবাসী বিষয়টি আবারও চাঙ্গা হয়ে উঠল।

তাই সাহসে ভর করে আমার চিন্তার ফসল সবার সঙ্গে ভাগ করার ইচ্ছা সংবরণ করতে পারলাম না।

বর্তমানে বাংলাদেশে বসবাসরত সব জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে বাঙালিরা সংখ্যাগত দিক থেকে বৃহত্তম এবং অন্যরা ক্ষুদ্রতম। তাই হয়তো সবার নাগরিক অধিকার সমুন্নত রাখার প্রয়োজনে এবারের সংবিধান সংশোধনীতেও বাংলাদেশী শব্দটি বিলুপ্ত করা সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও এবং বিহারিসহ অল্প কয়েকটি জাতি-গোষ্ঠী ব্রিটিশ/পাকিস্তান আমলে ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে এসে বসতি স্থাপন করে। এর বাইরে এখানকার প্রায় সব জাতি-গোষ্ঠী হাজার-হাজার বছর ধরে এই মাটি এবং জলবায়ুতে বংশানুক্রমে বসবাস করে আসছে।

এখানে প্রসঙ্গক্রমে চলে আসে ‘আদিবাসী’ শব্দটি। এর অর্থ এ ভূখণ্ডে আদি থেকে যারা বসবাস করে আসছেন তারাই আদিবাসী। সেটিই হয়তো তিন পার্বত্য জেলার অধিবাসীদের আদিবাসী বলার পেছনে যুক্তি। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, বাঙালিরা আদিবাসী নয় কেন? বাঙালিরা কত দিন থেকে এই ভূখণ্ডে বসবাস করে আসছে? এই প্রশ্ন আমার একান্তই ব্যক্তিগত। আমার অনুর্বর মস্তিষ্কের এলোমেলো চিন্তার ফসল। কাউকে খাটো অথবা অসম্মান করার জন্য নয়। আমি একজন খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষ। কোনো তত্ত্বজ্ঞানের অধিকারী নই। সুতরাং নৃ-বিজ্ঞানের জ্ঞানতত্ত্ব আমার না থাকারই কথা। তাই এত বড় একটি তাত্ত্বিক এবং রাষ্ট্রীয় বিষয়ের ওপর আলোচনা করা আমার পক্ষে ধৃষ্টতারই শামিল এবং সম্ভবত সমালোচিত ও নিন্দিত হওয়ার বিষয়ও। তাই হয়তো অজ্ঞানতাবশত সাম্প্রতিক এত বড় ইস্যুটির ওপর দু-একটি লাইন লেখার সাহস পেয়েছি। তবে অতীত এবং সাম্প্রতিক সময়ে ‘আদিবাসী’ শব্দটির ওপর দিয়ে যে ধরনের ঝড় প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে, তা আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে কেবল বিচলিতই করে না, একটি কঠিন শঙ্কার মধ্যেও রাখে।

জাতিসংঘে বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলার অধিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতির বিষয়টি দেশের বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় স্থান পেয়েছে। ‘প্রথম আলো’র ২ আগস্ট, ২০১১ তারিখে একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘জাতিসংঘে গৃহীত প্রতিবেদনে আদিবাসীদের স্বীকৃতি বাংলাদেশের আপত্তি’। এই সংবাদে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপুমনির উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে : দেশের পার্বত্য তিন জেলার লোকজন আদিবাসী নয়, ক্ষুদ্র নৃ-জাতিগোষ্ঠী। ঠিক তার পরের দিন ‘প্রথম আলো’ ভেতরের পৃষ্ঠায় আদিবাসী প্রসঙ্গে আরো একটি সংবাদ পরিবেশন করে উল্লেখ করেছে : সম্প্রতি বিদেশি কূটনীতিক ও সাহায্য সংস্থার প্রতিনিধিদের ডেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী তিন পার্বত্য জেলার অধিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে আখ্যায়িত না করে ক্ষুদ্র নৃ-জাতিগোষ্ঠী হিসেবে উল্লেখ করার পরামর্শ দেন।

আবারও আমার উর্বর মস্তিষ্কে ঘূর্ণায়মান কিছু এলোমেলো চিন্তার প্রতিফলন এই লেখায় আলোকপাত করার বাসনা করছি। যে ভাষাভাষীর মানুষই হই না কেন, এই জলবায়ুতে আমরা হাজার বছরের জীবনপ্রবাহে জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক। তাই রাষ্ট্র ও সরকারের কর্তব্য তার নাগরিকের অধিকার সুনিশ্চিত করতে সংবিধানে তা লিপিবদ্ধ করা। এ দেশে বাঙালি ছাড়াও চাকমা, গারো, সাঁওতাল, বম, লুসাইসহ অনেক জাতিসত্তার অস্তিত্ব রয়েছে। আমি যদি বাংলাদেশী বাঙালি হই, তবে কেন বাংলাদেশী চাকমা, গারো, সাঁওতাল, বম্, লুসাই ইত্যাদি জাতিসত্তার কথা সুনির্দিষ্টভাবে সংবিধানে উল্লেখ থাকবে না?

আমার জানা মতে, ভারতের মেঘালয়ে গারোরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং ভারতের সংবিধানে তাদের ভারতীয় গারো হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তারা একটি পূর্ণাঙ্গ জাতিসত্তার পরিচয় নিয়ে তথা দেশ ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচিত।

উপজাতি, আদিবাসী, পাহাড়ি এবং ক্ষুদ্র নৃ-জাতিগোষ্ঠী-- এগুলো ওদের পরিচয় নয়। সবচেয়ে বড় কথা, একটি জাতি হিসেবে চাকমা, গারো, সাঁওতাল, বম, লুসাই-- এদের কোনো পরিচিতি সংকট নেই। ওদের পরিচয় ওরা চাকমা, গারো, সাঁওতাল, বম, লুসাই এবং বাংলাদেশের অধিবাসী।

একটি জাতিগোষ্ঠীর পরিচিতির জন্য যেসব উপাদান নৃবিজ্ঞানে, সমাজবিজ্ঞানে উল্লেখ করা হয়েছে-- চাকমা, গারো, সাঁওতাল, বম, লুসাইসহ বাংলাদেশে বসবাসরত সবার মধ্যে তা রয়েছে, যেমন রয়েছে বাঙালিদের মধ্যে। এখানে ‘বিশেষ জনগোষ্ঠী’ বলতেও কিছু নেই।

সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাপকাঠিতে সংখ্যালঘিষ্ঠের বিচার অনুচিত। আমরা সবাই মানুষ এবং বাংলাদেশের অধিবাসী। আজকের এই জটিলতা দূর করতে পারে কেবল সাংবিধানিক স্বীকৃতি। আমরা আরো একটি সাংবিধানিক সংশোধনীর অপেক্ষায় থাকলাম।


 লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, পাক্ষিক স্বর্গমর্ত্য
 ই-মেইল : subrata_sandillya@yahoo.com


বাংলাদেশ সময় ২৩০৫, আগস্ট ১৮, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।