ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

...বন্ধুর জোরে হাঁটার চেষ্টা!

মাহবুব মিঠু, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪২ ঘণ্টা, আগস্ট ১৯, ২০১১
...বন্ধুর জোরে হাঁটার চেষ্টা!

ব্যক্তি লাদেনের মৃত্যুর ঘটনাটা একটু পুরনো হয়ে গেলও এর সংগে জড়িত আনুষঙ্গিক বিষয়াবলি অনেক দিন পর্যন্ত সাম্প্রতিক থাকবে। অস্ট্রেলিয়ায় মাইগ্রেশন এবং ব্যক্তি জীবনে এর প্রভাব সম্পর্কে একটা ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে, সেই সুবাদে এর উপরে কিছু পড়াশোনা এবং অতি অবশ্যই ইউ টিউবের দ্বারস্থ হয়ে কিছু ব্যক্তির সাক্ষাৎকার দেখতে দেখতে একটা ভিন্ন রকম চিন্তা মাথায় এসে গেল।

সেই সংগে যুক্ত হলো লাদেনের মৃত্যু-পরবর্তী নিজের একটা তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা। বলে রাখা ভালো, ইউ টিউব এখন পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষাদানের একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাড়িয়েছে।

আজকাল ইউনিগুলোতে হরহামেশাই ইউটিউবের ভিডিও ক্লিপস ব্যবহার করা হয় শিক্ষাদানের মাধ্যম হিসেবে। সে যাই হোক, বাইরে থেকে আসা অভিবাসীদের বেশিরভাগই মনে করেন তারা তাদের জীবনে কোনও না কোনও সময় কম বেশি বর্ণ বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। আসলে রেসিজম এমন একটা প্রত্যয় যার শক্তি অনেক প্রবল। মাঝে মাঝে বিশ্বের প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও এর কবল থেকে রেহাই পান না। রেসিজম প্রত্যয়টি যদিও রেস এবং এথনিক পরিচয়ের  সাথে সম্পর্কিত; কিন্তু এর মূল কথা গিয়ে দাঁড়ায় এর ভিত্তিতে বিভাজন এবং নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণের চেষ্টা। এই বিভাজন এবং শ্রেষ্ঠত্য প্রমাণ রেসিজম থেকে শুরু করে ধর্মীয় ভিত্তিতে এবং অবশ্যই ব্যক্তি শ্রেষ্ঠতা প্রতিষ্ঠায় সবখানেই সমানভাবে ক্রিয়াশীল। এরই ধারাবাহিকতায়, নিচের প্রসঙ্গগুলির প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও একটা জায়গায় খুবই মিল খুঁজে পাওয়া যাবে বিশেষত: আমার অবিখ্যাত বন্ধুটি এবং বিখ্যাত ওবামার মধ্যে। দুজনেই যে যার দুর্বলতা (আসলে কি এগুলি দুর্বলতা নাকি ভিন্নতা) ঢেকে নিজের বড়ত্ব প্রমাণে সচেষ্ট, শুধু কৌশলগুলি ভিন্ন।
 
প্রসংগ ১:
মানুষের লম্বা এবং খাটো হবার সাথে যদিও মর্যাদাগত কোনও সম্পর্ক নেই তারপরেও খাটো হবার জন্য কেউ কেউ আতœগ্লানিতে ভোগে। আমার এক বন্ধু ছিল যে উচ্চতায় আমার চেয়ে একটু খাটো। যদিও তাতে কিছু যায় আসে না কিন্তু হাঁটার সময়ে লক্ষ্য করতাম সে আমার চেয়ে সব সময় সচেতনভাবে আগে আগে থাকার চেষ্টা করতো। এভাবে সে তার খাটো হবার অভাবটাকে কিছুটা জোরে হেঁটে পূরণ করতো। শুধু আমার সেই বন্ধুটিই নয়; পৃথিবীর বেশীরভাগ মানুষই তার কোনও দূর্বলতাকে বিকল্প উপায়ে পূরণ করার চেষ্টা করে সবার সঙ্গে সমানতালে চলার খাতিরে। বর্তমান বিশ্বের কর্তা ওবামা সাহেবও এর ব্যতিক্রম নয়। তার বর্ণগত দুর্বলতা, পূর্বের ধর্মীয় পরিচয়  ঢাকার জন্য তিনি সব সময় সচেতন থাকেন। তিনি সাদা আমেরিকান নন; তার উপরে ধর্মীয় পরিচয়ে কিঞ্চিৎ মুসলমানী গন্ধ আছে; যেমন চাপিলা মাছে একটু ইলিশের গন্ধ থাকে যদিও, স্বাদে এবং পরিচয়ে সে ইলিশ নয়। এসব অপবাদ এবং দুর্বলতাকে ঢাকতে তিনি যে কার্যকলাপগুলো করে থাকেন তাতে উনাকে বেশ বিব্রত মনে হয় মাঝে মাঝে। কেননা পরে এসব ব্যবহারের সাথে কাজের কোনও মিল খুঁজে পাওয়া যায় না।   যেমন তিনি যখন কোনও সহকারীর সংগে কাজ করেন তখন তাকে পুরোপুরি এনজিও গুলোর informal ভংগীতে interaction করতে দেখি।

সহকারীর পাশে ঘনিষ্টভাবে বসা কিংবা তার ঘাড়ের উপর হাত রাখা ইত্যাকার অনেক কিছু যা থেকে মনে হয় তিনি বেশ মানবতাবাদী এবং বিশ্ববান্ধব। কিন্তু ইরাক আফগানিস্তানে হাজার হাজার নারীশিশু হত্যা দেখে তাকে মানবতাবাদী ভাবার কোনও কারণ দেখি না। বুশ এবং ওবামার মধ্যে মিল হচ্ছে উভয়েই মানবহত্যাকারী; আর অমিল হচ্ছে বুশ সত্যবাদী কিন্তু ওবামা কপট স্বভাবের। বুশ কথায় যেমন উগ্র ছিল কাজেও ছিল ততোটা বিধ্বংসী। ওবামা কথায় মানবিক কিন্তু হাতে তার বুশের মতোই নারীশিশুর রক্তের দাগ।  

প্রশ্ন হচ্ছে, আমার বন্ধু কেন কষ্ট করে জোরে হাঁটতো কিংবা ওবামার পরিচয় লুকানোর কেন এতো সচেতন চেষ্টা। আমার বন্ধুটি হয়তো ভাবতো সবার সংগে তাল মিলিয়ে না হাঁটতে পারলে পাছে শরীরের আকারের প্রসংগটি সামনে চলে আসে যেটা তার জন্য খুবই বিব্রতকর হয়ে দাঁড়াবে। এই ধারণাটি কিংবা অভিজ্ঞতাটি সে অবশ্যই তার চারপাশের পরিবেশ থেকে পেয়েছে। সে শিক্ষা পেয়েছে সমান (ইক্যুয়ালিটি)হবার, সাম্যতার (ইক্যুয়িটি)নয়। কিন্তু সমান  শব্দটি নিজেই যে একটা অসমান ধারণা নির্দেশ করে সেটা কে জানে! পৃথিবীর সব মানুষ কখনো সমান হতে পারে না। মানুষের মধ্যে যেমন বেঁটে, লম্বা আছে তেমনি আছে সাদা কালোর মতো আরো অনেক বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যেটা ঘোচানো সম্ভব নয় এবং প্রয়োজন্ও নেই। এই বৈশিষ্ট্যগত বিভাজনগুলো দূর করার জন্য আমাদের দরকার সমাজে সাম্য  প্রতিষ্ঠা যেটা থেকে আমরা সহনশীলতার শিক্ষা পাবো। সেই সমতাভিত্তিক সম্পর্কটি প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই আমার বন্ধুটিকে আর কষ্ট করে জোরে হাঁটতে হবে না এবং ওবামাও পারবেন তার স্বাভাবিক আচরণটি করতে।
 
প্রসংগ ২:
এবার অন্য প্রসঙ্গ, ওবামা এবং ওসামার মধ্যে নামের মতো আরো কয়েকটি বিষয়ে মিল লক্ষ্য করা যায়। যেমন: লাদেনকে আমেরিকা তৈরি করেছিল তার জাতশত্রু রাশিয়ার (সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের) বিরুদ্ধে লড়ার জন্য। বিভিন্নভাবে সমর্থন দিয়ে আমেরিকাই লাদেনকে লালনপালন করেছিল। প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ায় লাদেনকে হত্যা করে তার লাশ সমুদ্রে ছুড়ে ফেলা হয়েছে। একইভাবে ওবামাকে ক্ষমতায় এনে আমেরিকা এই ধারণাই প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে যে, দ্যাখো বিশ্ববাসী আমরা কতো উদার এবং মহানুভব। ওবামার মতো একজন আফ্রো-আমেরিকানকে আমরা ক্ষমতায় এনেছি। কাজেই আমরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি! কিন্তু ওবামার পরতে পরতে আমেরিকান হবার চেষ্টা এবং নিজেকে অমুসলিম প্রমাণ করার আপ্রাণ কসরত দেখে মনে হয় তাদের এই শ্রেষ্ঠত্বের দাবি কতোটা অসার। শেষমেষ প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে ওবামার গুরুত্ব কতোদিন থাকে সেটাই দেখার বিষয়। এজন্য আমাদের আর কিছুদিন হয়তো অপেক্ষা করতে।
 
প্রসংগ ৩:
লাদেনের হত্যার পর আমি কর্মক্ষেত্রে এক বিব্রতকর আচরণের শিকার হই। মিলাদেন নামের  এক সহকর্মী আমাকে বলে, ‘তোমার বস মারা গেছে। ’ আমি বুঝতে পেরিছিলাম কেন সে একথাটি বলেছিল। লাদেন এবং আমি ধর্মীয় পরিচয়ে দুজনই মুসলমান। আমি বেশ চমৎকার উত্তর দিয়েছিলাম ‘লাদেন অবশ্যই আমার বস নয়, তবে সম্ভবত তোমার বন্ধু হতে পারে। কারণ লাদেন এবং মিলাদেন নাম দুটি বেশ কাছের মনে হয় ছন্দোগতভাবে। ’

এই অভিজ্ঞতা একটা সত্যকেই তুলে ধরে যে, আমেরিকা বলছে যুদ্ধটা ইসলামের বিরুদ্ধে নয়, কিন্তু সব ক্ষেত্রে পশ্চিমা প্রতিক্রিয়ায় তারই ছায়াপাত, সেই সাধারণ মিলাদেন থেকে বুশ ওবামা পর্যন্ত।

আসলে সবখানেই মানুষ বিভিন্ন পরিচয়ে ব্ক্সাবন্দী। আমরা মানুষকে বিবেচনা করি তার গোষ্ঠীর যে কোন সদস্যের প্রতি ধারণা থেকে। একজনের অপরাধে সবাইকে সেই অনুপাতে মূল্যায়ন এবং প্রতিক্রিয়া। সারাবিশ্বে এই সত্যটি সমানভাবে সত্য। একজন মুসলমানের অপরাধ মানেই সমগ্র ধর্মীয়গোষ্ঠীর দায় নয়, এটা যেমন সত্য তেমনি ভারতে মুসলমানদের প্রতি অন্যায় মানেই বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন সমর্থনযোগ্য নয়। একইভাবে বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তানে হিন্দুদের প্রতি অন্যায় মানে ভারতে মুসলমান মেরে শেষ করো---খুবই পাশবিক!

আমার বাবা যখন ফরিদপুরে চাকরী করতেন তখন আলীপুর এবং কমলাপুরের মধ্যে খুবই শত্রুতা ছিল (এখন কেমন জানি না)। আমি বলছি সেই ৭৭ কিংবা ৭৮ সালের ঘটনা, তখন খুবই ছোট ছিলাম। দ্বন্দ্ব বাঁধলেই সেরেছে! ভাল মন্দ বাছ বিচার নেই, এক পাড়া অন্য পাড়ার যাকে পেত তাকেই নির্যাতন করতো। সে কি ঘটনার সঙ্গে জড়িত না নিরপেক্ষ,  বাবার বয়েসী না ছেলের বয়েসী দেখাদেখি নাই।

মনে পড়ে, একবার আলীপুরের কোন একজনকে কমলাপুরের কে একজন পিটিয়েছিল। এর রেশ ধরে শহিদ নামক কমলাপুরের জনৈক যুবক আলীপুরে তার বোনের বাসায় বেড়াতে যাবার পথে প্রতিপক্ষের হকিস্টিক এবং রামদার কোপে নিহত হয়। পরের দিন কমলাপুরের বড় শেঠ (তখন মাস্তানকে শেঠ বলা হতো, এখনো কি ফরিদপুরে তাই বলে?) মানুর নেতৃত্বে বিশাল বাহিনী আলীপুরের ঘরে ঘরে আক্রমণ চালিয়েছিল। তাদের পক্ষ থেকে কোনও প্রতিরোধ ছিল না। কারণ হত্যা মামলায় পুরুষরা সবাই ছিল ঘরছাড়া। ভেবে দেখুন, কারা তখন অত্যাচারিত হয়েছিল বেশি? অবশ্যই নারী এবং শিশুরা। এখানেও দেখুন, আইন রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অপরাধী কে প্রথমাবস্থায় সেটা ধর্তব্যের বিষয় নয়; বিষয় হচ্ছে অপরাধ ঘটনার এলাকার মধ্যে সবাইকে একইভাবে বিবেচনা করা। এ কারণে আলিপুরের সব পুরুষ অনিবার্য বিপর্যয় জেনেও পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য সব ছেড়েছুড়ে পালিয়েছিল।

আলীপুর-কমলাপুরের ঘটনাটা ব্যতিক্রম কিছু নয়। এটা দুটো বৈশ্বিক বাস্তবতাকে প্রমাণিত করে। প্রথমত: ‘আমরা এবং ওরা’-- এই বিভাজনের ভিত্তিতে শত্রু নির্ণয়। মানে অপরাধকারীকে আলাদাভাবে না দেখে সমপ্রদায়গতভাবে দেখা। যেমন: পাশ্চাত্য সমাজ উগ্রবাদী আল কায়েদার কর্মকান্ডের ভিত্তিতে মুসলমানদের বিবেচনা করে। দ্বিতীয়ত: শ্রেষ্ঠতা প্রমাণের জন্য লড়াই। সেই কোথায় আলীপুর-কমলাপুর এবং আমেরিকা। কিংবা কোথায় আমার বেঁটে বন্ধু আর কোথায় শক্তিধর দেশের প্রেসিডেন্ট ওবামা। দুস্তর ব্যবধান, কিন্তু  কী অসামান্য মিল একটা জায়গায়।   সবাই চায় শ্রেষ্ঠ হতে। মানব চরিত্রে শ্রেষ্ঠ হবার তাড়না এতো প্রবল যে, যে কোনও ব্যক্তি তার অবস্থান থেকে সুযোগ পেলেই শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় মরিয়া হয়ে ওঠে। শুধু পার্থক্য হচ্ছে, শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় ওবামা-ওসামারা মানুষ হত্যা করে আর আমার বেঁটে বন্ধুটি জোরে হাঁটে।

মাহবুব মিঠু: সমাজকর্মী ও গবেষক। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার ফ্লিন্ডার্স ইউনিউভার্সিটি অব অ্যাডেলাইডে সমাজকর্ম বিষয়ে মাস্টার্স করছেন।

বাংলাদেশ সময় ১১৩৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১৯, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।