বিএনপি দাবি করেছে তাদের জজ মিয়া নাটকটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা! এর মানে জজ মিয়া গ্রেনেড চালাতে পারে! দেশের বিরোধীদলের নেত্রীকেও গ্রেনেড ছুঁড়ে মেরে ফেলতে চেয়েছে জজ মিয়া! এই জজ মিয়ার হাতে বর্তমান বিরোধীদলের নেত্রীর জীবনহানির আশংকা আছে কিনা তা অবশ্য দলটি বলেনি।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী রোববার(২১-০৮-২০১১) এক সংবাদ সম্মেলনে বহুল আলোচিত-বিতর্কিত জজ মিয়ার ব্যাপারে নতুন এই দাবি তোলেন।
নোয়াখালীর সেনবাগের যে জজ মিয়া বিএনপিযুগের কলঙ্কের এক নাম। জজ মিয়া প্রসঙ্গ এলে শরমে মুখ লুকান অথবা মুখ টিপে হাসেন বিএনপির নেতা-কর্মীরাও। সেই জজ মিয়া নামের বাতিল ইস্যুটাকে নিজেদের ঔজ্জ্বল্য বাড়াতে আবার সামনে নিয়ে আসতে চাইছে দেশের প্রধান বিরোধীদল!
রোববারের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, গ্রেনেড হামলার বিষয়ে এর আগে তারা জজ মিয়ার নামে যে জবানবন্দী প্রচার করেছিলেন, সেটিই ছিল সঠিক! দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলোকেও বিশেষ নসিহত করেছেন বিএনপির এই নেতা। ‘সুসাংবাদিকতা’ করতে বলেছেন! তা শেখানোর ক্লাসটি কোথায় নেবেন রিজভী স্যার? কোর্সটির নাম কি হবে ‘জজ মিয়া.. সুসাংবাদিকতা’?
রিজভী সাহেব ভদ্রলোক মানুষ। দলের হয়ে সংবাদ সম্মেলনটি করা হলেও তিনিই নিশ্চয় মানবেন, সেই গ্রেনেড হামলার ঘটনাটি বিগত বিএনপি-জামায়াত সরকার আমলের অপশাসনের ভয়ঙ্কর একটি দৃষ্টান্ত। এর কারণে যিনি এখন প্রতিদিন প্রেস কনফারেন্স বা যে কোনভাবে মিডিয়ায় থাকতে চান, দলের সেই ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবও জজ মিয়ার নামে এই ডাহা মিথ্যা কথা বলার প্রেস কনফারেন্সটি করতে চাননি। যেমন মওদুদ আহমদের বিরুদ্ধেও প্রেস কনফারেন্স করতে চাননি ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব। তাহলে কি বিএনপির এসব দুই নম্বরী ইস্যুর প্রেস কনফারেন্সের জন্য নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছেন জনাব রিজভী আহমদ তথা ‘সুসাংবাদিকতার রিজভী স্যার’? বিএনপি বিটের সাংবাদিকরা বিষয়টি মাথায় রাখতে পারেন (যদি চান ‘সুসাংবাদিকতার ডিগ্রি!)।
ওই গ্রেনেড ঘটনার মাধ্যমে তখন সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশের তৎকালীন বিরোধীদলের নেত্রী শেখ হাসিনাকে তারা প্রাণে মেরে ফেলার চেষ্টা করে। বিরোধীদলের নেত্রীকে মারতে ব্যর্থ হলেও বর্তমান রাষ্ট্রপতির স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জনকে মেরে ফেলা গেছে। আহত করা গেছে শেখ হাসিনা, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মোহাম্মদ হানিফসহ আরও অনেক মানুষকে।
তৎকালীন বিরোধীদলের নেত্রী যাতে আর কখনও কানে না শোনেন, সে ব্যবস্থা করা গেছে।
আহতরা আজও শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন অসংখ্য স্প্লিন্টারের যন্ত্রণা। এসব সত্ত্বেও তখনো দেশের সব মানুষ মনে করেনি যে এমন একটি জঘন্য এপিসোডের সঙ্গে বিএনপি জড়িত। অনেকে তখন সরল মনে করছিলেন কাজটা করতে পারে মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী।
কিন্তু জজ মিয়া নাটক চালু আর তার মাধ্যমে একটি জবানবন্দী প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে সন্দেহ বাড়ে মানুষের। এরপর গত তত্ত্বাবধায়ক আমলে জানা সম্ভব হয় ঘটনা ধামাচাপা দিতে বিএনপি প্রশাসনের বিরল এক কীর্তি-কান্ড!
এক বেকার জজ মিয়াকে পিটিয়ে, এরপর পরিবারটির জন্য মাসোহারার ব্যবস্থা করে দেশের মানুষকে শোনানো হয় কি করে সে আর্জেস গ্রেনেড ফাটিয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিল দেশের বিরোধীদলের নেত্রীকে!
কাহিনীটি শুনে তখন আম-জনতা অনেকের ভয়ও করে! দেশে কি তাহলে এমন হাজার হাজার জজ মিয়া আছে যারা এভাবে গ্রেনেড চালাতে জানে। কিন্তু একটু বুদ্ধি-শুদ্ধি আছে এমন একজন মানুষও গল্পটা বিশ্বাস করেনি। বিএনপির বুদ্ধি-শুদ্ধিওয়ালা লোকজনও না। দেশের কোন মূলধারার মিডিয়াতো নয়ই। মিডিয়ার অনুসন্ধানী রিপোর্টে তা চিহ্নিত হয় ‘জজ মিয়া নাটক’, ‘আষাঢ়ে গল্প’ শিরোনামে! যাদের সবশেষ ‘সুসাংবাদিকতা’ না করার দায়ে অভিযুক্ত করেছেন বিএনপি নেতা রিজভী আহমেদ তথা আমাদের ‘সুসাংবাদিকতা শিক্ষার নয়া শিক্ষক ‘রিজভী স্যার’!
তা রিজভী স্যারকে বলি: আপনার মতো একজন লেখাপড়া জানা লোককে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী না বানিয়ে বাবরের মতো এয়ারপোর্টের চিহ্নিত বিশেষ ব্যবসায়ীকে ওই পদে গদিনশীন করার বিষয়ের মাজেজাতো বোঝেন, কিন্তু একবারও বিষয়টা নিয়ে কোনদিন প্রশ্ন তুলেছেন? কাঁঠাল গাছেতো কাঁঠালই হয়, তাই না? তাহলে আপনাদের ওই ``উই আর লুকিং ফর শত্রুজ``--এর কাছে ‘আম’ আশা করতে বলেন কেনো? জজ মিয়ারাতো ওই কাঁঠাল গাছ জাতীয়দের মস্তিষ্কপ্রসূতই ! বা এর চেয়ে উৎকৃষ্ট উদ্ভাবন কিছু কি সম্ভব ছিল তাদের পক্ষে?
তা স্যার, আপনাদের উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন যে জঙ্গি গোষ্ঠীর নেতা তা কি আপনারা কেউ ঘূণাক্ষরেও জানতেন না? সরকারি অফিসের একজন পিয়নের চাকরির আগে পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়, তা আপনাদের ওই মন্ত্রী-ফন্ত্রী কি সব ছিলেন ভেরিফিকেশনের উর্ধ্বে?
কি ভয়ঙ্কর দেখুন, মন্ত্রীর ভাই জঙ্গিগোষ্ঠীর নেতা! মন্ত্রীর সরকারি বাড়িতে লোকজন নিয়ে সে বৈঠকও করেছে! তারেক রহমানের নাম আসে কি করে মামলায়? তাইতো! মুফতি হান্নানের ভিডিওটা সবাইতো অনলাইনে দেখে আপনারা দেখেন না স্যার? ওটা কি বানানো-বানোয়াট জবানবন্দী? তা আপনারা বললে বা একটু টোপ দিলেইতো সে জবানবন্দীটা প্রত্যাহার করতে পারে তাই নয় কি!
আপনাদের সঙ্গেতো তার সম্পর্ক ভালো। আপনাদের আমলে `আল্লাহর মাল` স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী তার স্বভাব-চরিত্র ভালো উল্লেখ করে মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছিলেন তা কী মনে নাই? কোর্টে সামনাসামনি দেখা হবার পর ক্ষুদ্ধ এই মুফতি ``লুকিং ফর শত্রুজ`` বাবরকে হাতের কাছে পেয়ে কি সব অশ্রাব্য মন্তব্য করেছিলেন, তা কি ভুলে গেছেন?
বা গ্রেনেড অপারেশন শেষে আপনাদের পিন্টু উপমন্ত্রীর জঙ্গী ভাই মাওলানা তাজউদ্দিনের পাকিস্তানে হিযরত করার কারণ কি? এসব বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া কি সুসাংবাদিকতার পরিপন্থি? চিটাগাং এর ওই দশ ট্রাক অস্ত্র কি দেশীয় নিরাপত্তা, খোলাবাজারে অস্ত্রের স্বাভাবিক বেচাবিক্রি নিশ্চিত করার জন্য আনা হয়েছিল? এসব কম্ম করার জন্য কি তখন প্রচলন করা হয়েছিল ওই হাওয়া ভবন প্যারালাল সরকারের? তা এমন ভালো জিনিস হাওয়া ভবনটির উচ্ছেদ বা বন্ধ করে দেবারই বা কারণ কি রিজভী স্যার?
বিএনপির আমলে ওই গ্রেনেড হামলার মতো ভয়ংকর ঘটনাতো শুধু একটাই ঘটেনি। গ্রেনেড মেরে শাহ এ এম এস কিবরিয়ার মতো দেশের সাবেক একজন অর্থমন্ত্রী, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে। সিলেটে গ্রেনেড হামলা হয়েছে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর।
সিলেট পৌরসভার চেয়ারম্যান বদরউদ্দিন কামরানকে লক্ষ্য করে একাধিক হামলা করা হয়েছে। এর একটি ঘটনাও কি আপনারা ঠিকমতো তদন্ত করতে চেয়েছেন? সমস্যাটা কোথায় ছিল? তখন এসব বিষয় সঠিক তদন্ত-বিচারের ব্যবস্থা করলে তা কি আজ সেগুলোর পুনর্তদন্ত, বর্ধিত তদন্তের প্রয়োজন পড়তো? সমস্যাগুলা একটু স্বীকার করেন না কেন রিজভী স্যার!
এসব কি কি কারণে গত ইলেকশনে আপনাদের ভরাডুবি হয়েছিল তা কি আপনারা বিজ্ঞ ব্যক্তিরা একটু পোস্টমর্টেমের চেষ্টা করেননি? কী কারণে জাতির পিতা শেখ মুজিবের বিচার আপনারা আটকে রেখেছিলেন, এতে আপনাদের লাভ বা স্বার্থ কি ছিল, কি কারণে তখন বিদেশে থাকায় বেঁচে যাওয়া জাতির পিতার মেয়েকে আপনাদের আমলে এভাবে হত্যার চেষ্টা হলো, আর আপনারা করলেন ফাজলামোর জজ মিয়া ক্যারিকেচার!
আজ কোর্টে যে লোকগুলো এসে ১৬৪ করে সব ফাঁস করেছে, এই লোকগুলো কি আপনাদের আমলের নিয়োগপ্রাপ্ত না রিজভী স্যার? এরা কি তাদের জবানবন্দী প্রত্যাহারের জন্য কেউ কোথাও আবেদন করেছে? আপনাদের ওই অফিসারগুলা যদি আজ আপনাদের ফুলের মতো চরিত্র সব ফাঁস করে, আর আমরা যদি তা লিখি তাহলে তা ‘কুসাংবাদিকতা’ কি করে হয় রিজভী স্যার?
আপনাদের আমলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা যে সব আইনানুগ জবানবন্দী দিয়েছেন, এর একটারও পাল্টা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণেরও চেষ্টা করলেন না। উল্টো সব দোষ দিয়ে দিলেন মিডিয়াকে! এরপর যদি বিএনপির কোন নেতা আপনাকে মিডিয়ার সঙ্গে দলের সম্পর্ক নষ্টের চক্রান্তকারী বলে তখন কি উপায় আপনার হবে ‘স্যার’?
পুনশ্চঃ জনাব রিজভি সাহেবকে বলছি, নানা কারণে দেশের অবস্থা যে ভালো না তা আপনারাইতো দেখছেন। বিশেষ করে ৩-৪ জন মন্ত্রীর বিষয়ে মিডিয়া সত্যনিষ্ঠ ভূমিকা পালন করছে বলেই আপনারা আপনাদের চেয়ারপার্সনের দুই ছেলের দুর্নীতি ঢাকতে পারছেন না। পারছেন না যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালে কিছুই করতে। আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হলেতো মানুষ আবার আপনাদেরই ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে চাইবে। এর আগে আপনার ক্রেডেবিলেটির ঘষামজা দরকার। এসব জজ মিয়া জাতীয় ফালতু কিসিমের কথাবার্তায় ক্রেডেবিলেটি কমবে না বাড়বে?
এ অবস্থায় আপনার কথিত ‘সুসাংবাদিকতার’ ভূয়া তত্ত্বটি প্রত্যাহারের অতিদ্রুত একটি ঘোষণা দেবেন কী? তা না হলে কিন্তু আপনাদের পলিটিক্যাল ক্যারিয়ারে তা লবণাক্ত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে। তা সহ্য করতে পারবেন কী। গ্রেনেড হামলার সত্যিকারের বিচার আপনারা করেননি বা করতে চাননি। এর সঠিক বিচার যাতে হয় তাতো চান, তাই নয় কী! আর বাঘা সব ব্যারিস্টার আর উকিলতো আপনাদের দলেই বেশি। কাজেই ভয় কি?
আল্লাহরে যদি বিশ্বাস করেন, তাইলেতো মানবেন জোর করে কেউ কোনও মিথ্যাকে সত্য বলে চালিয়ে দিতে পারবে না। আরেকটি কথা রিজভি সাহেব, আওয়ামী লীগ সরকার এর মাঝে অনেক খারাপ কাজও করেছে। কিন্তু খালেদা জিয়াকে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে হত্যার চেষ্টা করে নাই। এই সত্যি স্বীকার করা কি কুসাংবাদিকতা রিজভী সাহেব?
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক।