এক জীবনে দুই দু’বার ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টির চাই’ দাবিটি শুনলাম। দু’বারেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়।
সাতাশ বছর পর ’স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টির দাবি আবারো উঠেছে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে আজ বুধবার এই দাবির সমর্থনে বুদ্ধিজীবী-শিক্ষক-সাংবাদিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আর সচেতন নাগরিকরা একাট্টা হচ্ছেন। জোরালো এই দাবিটি এখন মানুষের প্রাণের দাবি, যদিও দাবিটির আবেদন তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছেনি। রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতায়, স্বেছাচারিতায় আজ আমাদের রাষ্ট্র,সমাজ ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসের দারপ্রান্তে। সরকার ও বিরোধীদল ব্যস্ত নিজেদের আখের গোছাতে। অতি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের তিরাশি হাজার কোটি টাকা শেয়ার বাজার থেকে পরিকল্পিতভাবে গায়েব করে দেবার পরও আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বরা অদ্ভুত রহস্যময় কারণে নিশ্চুপ থাকেন। উনারা ব্যস্ত থাকেন নিজেদের সন্তানদের বিত্ত-বৈভব গড়ায়, সন্তানদের দুর্নীতির মামলা খারিজের আন্দোলনে। আর তাদের পদলেহী রাজনৈতিক ভৃত্যরা সেই দাবির সমর্থনে সোচ্চার! ভুয়া ঘোষণায় সরকারি বাডি দখল চিরস্হায়ী করতে। দেশ যেন দুই রাজনৈতিক পরিবারের পারিবারিক সম্পদ।
সাধারণ মানুষের বাড়িতে ইচ্ছেমাফিক রান্না-বান্নার সুযোগ বন্ধ সামান্য গ্যাসের সরবরাহের অভাবে। অথচ গ্যাসে ভাসছে দেশ! রাজনীতিক আর তাদের দোসররা যখন এয়ারকন্ডিশনারের শীতল হাওয়ায় আরো হাজার কোটি টাকা রোজগারের পরিকল্পনায় থাকেন, তখন বিদ্যুতের অভাবে পরীক্ষার্থী শিক্ষার্থীর অন্ধকারে বসে কাঁদে। অনিশ্চিত হয়ে যায় হতদরিদ্র কৃষকের জমি সেচ। কোল্ডস্টোরে পচে আলু। ব্যবসায়ীদের হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের কারখানার শিফট থাকে অচল। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মার্কেট মুখোমুখি হয় নির্ধারিত লোড শেডিংয়ের। পঙ্গু হয়ে যায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরও সামান্য খাবার পানির নিশ্চয়তা দিতে পারে না আমাদের রাজনীতিবিদেরা। ধিক! সব সুবিধা ভোগ করে জনগণকে দুর্ভোগে ঠেলে দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা আর রক্ষার জোরালো আহ্বান জানান তারা।
ছিনতাই, ঈভ টিজিং, চাঁদাবাজি, খুন-জখমে স্বাভাবিক জনজীবন অতিষ্ঠ। অফিসে আসা যাওয়ার জন্যে মানুষকে নিত্য সামিল হতে হয় পরিবহনযুদ্ধে । যানজটে দৈনিক পাঁচ ঘন্টা আয়ু হারায় মানুষ। এতো কষ্ট-যন্ত্রণার পরও যদি মানুষ পেট পুরে খেতে পাবার ‘বিলাসিতা টুকু’ পেতো! সামর্থ্যের পকেটে যখন চৈত্রের খরা তখন বাজারে জৈষ্ঠ্যের কাঠফাটা উত্তাপ। কোনো কিছুই স্পর্শ করার জো থাকেনা। ফেন-ভাত-ডালের সামান্য জীবনও মেলে না হায়! ভেজালে ভেজালে ছেয়ে গেছে দেশ। ভেজাল খাবারের প্রতিক্রিয়ায় কাতারে কাতারে অনিচ্ছুক মানুষ সারিবদ্ধ হচ্ছে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডাক্তার খানায়। অকালে হারাচ্ছেন স্বজন প্রিয়জন।
নিজের অস্তিত্বটুকুও জানান দেবার অধিকার হারিয়ে ফেলেছে সাধারণ মানুষ। আইনের রক্ষাকারী পুলিশকে বানানো হয়েছে দানব। সাধারণ মানুষকে রক্ষার বদলে পুলিশ খুঁটির জোরহীন সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন চালায়। আইনের শেষ ভরসাস্হল আদালতকেও বিতির্কত করে তোলা হয়েছে। বিচার ব্যবস্হাকে করে তোলা হয়েছে ব্যয়বহুল। সাধারণ মানুষের সামর্থ্য ও নাগালের বাইরে চলে গেছে বিচার প্রার্থনা।
মানুষের বেঁচে থাকার সামান্য চাহিদায় যোগাযোগ ব্যবস্হার বিকল্প নেই। কিন্তু রাজনৈতিক দুর্নীতি, স্বেছাচারিতা ও অবহেলায় আজ নিরাপদে বাড়ি ফেরার নিশ্চয়তাটুকু নেই। প্রিয়জনের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেবার যাত্রা এখন আর নির্বিঘ্ন নয়। তিন ঘন্টার যাত্রাপথ তিন দিনে প্রলম্বিত হতে পারে। প্রতিদিন রাস্তায় অকাতরে প্রাণহানি হছে। প্রাণ যাছে দলীয় ক্যাডরের হাতে, মস্তানদের হাতে, কন্ট্রাক্ট কিলারদের হাতে এবং সর্বোপরি রক্ষক পুলিশের হাতে। সাধারণ মানুষের প্রাণহানিতে আমাদের রাজনীতিবিদদের কোনো দুশ্চিন্তা নেই। একজন ভোটারের মৃত্যু কোনো প্রভাব ফেলে না রাজনীতির শরীরে!
মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভগুলো তাই উদগীরণের অপেক্ষায়। মানুষ আজ স্বাভাবিক মৃত্যুর দাবিতে সোচার হছে। আশ্চর্য্, মানুষ এখন বেঁচে থাকার মৌলিক দাবিটুকু পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে রাজনৈতিক অনাচারে। রাজনীতিবিদদের উপেক্ষার নির্লজ্জ হাসিতে। তবে মানুষ যখন জেগে ওঠে, তখন এই হাসিই মুহূর্তে রূপান্তরিত হয় কান্নায়।
রাজনীতিকর কান্নার প্রেক্ষাপট প্রায় প্রস্তুত। শেষাবধি শেষ হাসিটুকু জনগণই হাসবে। কিন্তু রাজনীতিকরা নিজেরা কী স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টিটুকু পাবেন?
মেলবোর্ন। ইমেলঃ abid.rahman@ymail.com
বাংলাদেশ সময় ১১৫২ ঘণ্টা, ২৪ আগস্ট, ২০১১