ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

উন্নয়নের নামে অন্ধ অনুকরণ!

মাহবুব মিঠু, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১৪ ঘণ্টা, আগস্ট ২৫, ২০১১
উন্নয়নের নামে অন্ধ অনুকরণ!

“উন্নয়ন” আলোচনায় বিভিন্ন সময় এক একটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে কিছুটা বাস্তব পরিস্থিতির কারণে; আবার অনেকগুলো বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়ার জন্য। সাধারণতঃ ঘটনার ব্যাপকতা এবং গুরুত্বের উপর ভিত্তি করে কোনও বিষয় আলোচনায় প্রধান্য পাওয়ার দাবি রাখে।

উন্নয়ন ভাবনায় অবশ্যই “ব্যাপকতা” এবং “গুরুত্ব” নির্ধারণ করতে হবে স্থানীয় পরিপ্র্রেক্ষিত বিবেচনায়। কিন্তু হঠাৎ করে বাইরে থেকে বিশেষতঃ পাশ্চাত্য অভিজ্ঞতার আলোকে বা কারো অসৎ উদ্দেশ্যকে ভিত্তি করে কোনও ইস্যুকে জনপ্রিয় করার উদ্যেশ্যে “ডেভেলপমেন্ট  মার্কেটিং” করা ঐ নিদিষ্ট জনগোষ্ঠীর জীবনে নেতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারে।

প্রতিটি চাপিয়ে দেওয়া “উন্নয়ন-পণ্যের” পিছনে কোনও না কোনও অসৎ উদ্দেশ্য থাকে। এই উন্নয়ন-পণ্য মার্কেটিং এর জন্য শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহ কিছু তথাকথিত নিরপেক্ষ (!) সর্বদেশীয় সংস্থা তৈরি করেছে। এদের মাধ্যমেই তারা নিজেদের ইচ্ছা বা চাহিদাকে জোরপূর্বক বিশ্বজনীন করার চেষ্টা চালায়। এসব তথাকথিত সর্বদেশীয় সংস্থা কোন কোন ক্ষেত্রে শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহের পক্ষে নয়া উপনিবেশ স্থাপনের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে।

এদেরই কিছু প্রতিনিধি দেশীয় এন.জি.ওগুলোর সহায়তায় বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য গ্রামের প্রতিটি ঘরে টিউবয়েল বসানোর ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু তখন তারা আর্সেনিকের কথা বিবেচনা করেনি। অত:পর সেই টিউবয়েলগুলো সখোনকার মানুষের জন্য মরণ ফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছলি। যাদের অদূরদর্শিতার জন্য আজ এই অবস্থা তারা তখন আবার ত্রাতা হিসেবে “আর্সেনিক প্রকল্পে” কোটি কোটি ডলার খরচ করছে। আসলে এটা ছিল এক ধরনের “টেকনোপলিটিক্স” যার আড়ালে তারা নিজস্ব আইডিয়া বা পণ্য বাজারজাত করে মুনাফা অর্জন করে; পরে জনজীবনে কি ঘটতে পারে তা তাদের বিবেচ্য ছিল না। তারা জানে, যাই ঘটুক না কেন তাতে তাদের কোনও লোকসান নেই। বরঞ্চ নেতিবাচক কোনও প্রভাব তাদের পরে নতুন কোন ব্যবসার মওকা এনে দেবে। এর মাধ্যমে তারা দীর্ঘদিন সে দেশের সরকারের উপর ছড়ি ঘোরানেরা সুযোগ পাবে। এমনিভাবে স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের দরিদ্রজনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন সময় গিনিপিগ বানিয়ে নানা ধরনের উন্নয়ন মডেল উপস্থাপন করে স্বপ্ন দেখিয়েছে ভাগ্য পরিবর্তনের। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করা হয়েছে এর পিছনে। কিন্তু গ্রামের ছমিরন, জামিলাদের অর্থনৈতিক জীবনে উল্লেখযোগ্য তেমন কোন পরিবর্তন আসেনি। বরং কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাদের জীবনে বয়ে এনেছে সীমাহীন দুর্ভোগ।

বর্তমানে আমাদের দেশে উন্নয়ন ঘরানায় বেশ জোরালোভাবে “শিশু অধিকারের” বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। ধারণাটি যদিও পশ্চিমাদের “ব্রেন প্রডাক্ট” তবুও এর অনেক ইতিবাচক দিক আছে যা আমাদের দেশেও সমানভাবে প্রযোজ্য হতে পারে কিছুটা দেশীয় সংস্করণের মাধ্যমে। এটা বলাই বাহুল্য যে, যে কোন দেশের শিশুরাই সবচেয়ে বেশী এবং সহজে দুর্দশার শিকার হয়। কাজেই, শিশুদের অধিকার সুরক্ষা, তাদের সবধরনের সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা প্রত্যেক রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য দায়িত্ব। তবে সেটা করতে হবে আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। হুবহু পশ্চিমাদের অনুসরণ আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য হবে না।

শিশুদের উপর যৌন হয়রানি বিষয়ক আলোচনায় বারবার “নিকট আত্মীয়” বিশেষতঃ বাবা, চাচা, ফুফা, মামা কর্তৃক যৌন হয়রানির বিষয়টা কোনও রূপ তথ্য প্রমাণ ছাড়া বারবার টেনে আনাতে এর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। হ্যাঁ, পশ্চিমা বিশ্বে এবং এশীয়ার কিছু কিছু দেশে যেমন ফিলপাইনে এধরনের ঘটনার ব্যাপকতা আছে। কিন্তু আমার জানা মতে, বাংলাদেশে এ বিষয়ের উপর তেমন কোন্ও বিশ্বাসযোগ্য গবেষণা কিংবা জরিপ এখনো হয়নি। একটা এন.জি.ও স্বল্প পরিসরে কেস হিস্ট্রিনির্ভর একটা সমীক্ষা করেছিল বেশ কিছু বছর আগে মাত্র ৫০ জন শিশুর উপরে।   এটাও আলোচ্য ঘটনার ব্যাপকতা নিরূপণের জন্য মোটেও বিবেচ্য হতে পারে না। টার্গেট হিসেবে যাদের নির্বাচন করা হয়েছিল তাদের সবাই কোনও না কোনওভাবে কারো না কারো দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার। শুধু নির্দিষ্টভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার শিশুদের উপর তথ্য জরিপ বা গবেষণা সারা দেশের যৌন নির্যাতনের প্রবণতার হার সঠিকভাবে তুলে ধরে না। তাছাড়া এদের মধ্যে কতোজন নিকটাত্নীয় কর্তৃক যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে তাও সঠিকভাবে উল্লেখ নেই।

 মূলতঃ ব্যাপকতা নিরূপনের জন্য নমুনা (Sample) ঠিক করতে হয় দৈব চয়নের (Random Sampling) এর ভিত্তিতে; শুধু তাই নয়, সেখানে আরো অনেক বিষয়কে বিবেচনায় রাখতে হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে কিভাবে শিশুদের বেছে নেওয়া হয়েছে তা রিপোর্টটিতে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ নেই। এই পরিস্থিতিতে, এ ধরনের একটা স্পর্শকাতর বিষয়ের উপর পর্যাপ্ত তথ্য ছাড়া হৈ চৈ করা অনেক সময় বিরূপ ফল বয়ে আনতে পারে।

শিশুদের সব ধরনের নির্যাতন বিশেষতঃ যৌন নির্যাতন থেকে সুরক্ষা দেওয়া অন্যতম একটা শিশুঅধিকার  হিসেবে স্বীকৃত। শুধু আমাদের দেশে নয়, বিশ্বের সব দেশেই শিশুরা কম বেশি যৌন হয়রানি বা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বড়দের তুলনায় অনেক বেশি; যেহেতু শারীরিক এবং মানসিকভাবে বয়স বিবেচনায় এরা বড়দের তুলনায় একটু বেশি অপরিপক্ক। এই অপরিপক্কতার সুযোগ নিচ্ছে কিছু মানুষরূপী পশু। কাজেই, এই শিশুদের ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করার জন্য অবশ্যই সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। এরই মধ্যে আমাদের দেশের কিছু কিছু বেসরকারী সংস্থা প্রশংসনীয়ভাবে এ ভাল কাজটি করে যাচ্ছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও কোনও কোনও সংস্থার দৃষ্টিভঙ্গী এবং কৌশলকে কেন্দ্র করে কিছু কিছু বিতর্ক তৈরি হয়েছে যা আসলে স্থানীয় বাস্তবতাকে সঠিকভাবে তুলে ধরে না; বরং কোন কোন ক্ষেত্রে সেটা বিদ্যমান “সামাজিক ঐকতানকে” ব্যাহত করে। আমাদের মানসিকতা এমন কেন জানি না। নিজেদের ঘরের খবর পশ্চিমারা না বলা পর্যন্ত যেন আমরা বুঝতে পারি না কিংবা  তা গ্রহণযোগ্যতা পায় না। কী হীনমন্যতা নিজেদের প্রতি! তাছাড়া পশ্চিমারা যেটাই বলবে সত্যাসত্য পরীক্ষা না করেই চিলে কান নিয়েছে বলে দে ছুট!

আমাদের শিশু‡`i নিরাপত্তার দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে। কি দুর্ভাগ্য! শেখ মুজিব হত্যা, সেখানে জিয়ার ভুমিকা কিংবা অধুনা আলোচিত ইকোনমি÷ প্রচারিত আমাদের প্রধানমন্ত্রী কিংবা তার দল সম্পর্কে তথ্যের জন্য বাইরের সাংবাদিক কিংবা পত্রিকার উপর নির্ভর করতে হয়। এমনকি ড: ইউনুস নিয়ম বহির্ভূত কোন কাজ করেছে কিনা সেটার জন্যেও সূদুর সুইডেনের কোন ব্যাক্তির রিপোর্টের উপর নির্ভর করতে হয়। এর পরে কি ন্যাক্করজনক হৈচৈ সেই প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে একটা বিশেষ ঘরানার লোকদের। পাঠক সবাই জানেন যে এই নাটকেল সব চরিত্রই পূপূর্ব নির্ধারিত এবং কি ঘটবে, কেন ঘটবে সেটাও পূর্ব পরিকল্পিত। সে যাই হোক, এ ধরণের পরনির্ভশীলতার মাধ্যমে আমরা নিজেদের কর্ম ক্ষমতাকে ছোট করে দেখছি, অন্যর উপর নির্ভরশীলতা বাড়াচ্ছি। শিশুর উপরে নিকট আত্নীয় কর্তৃক যৌন নির্যাতন এটা যেমন স্পর্শকাতর ব্যপার তেমনি অতি গুরত্বপূর্ণ শিশুদেরকে এই পরিস্থিতির হাত থেকে রক্ষা করা। বিষয়টি এতোটাই স্পর্শকাতর যে, ভুক্তভোগীরা প্রয়শই চায় সেটাকে চেপে রাখতে সামাজিক লাজ লজ্জার ভয়ে। কিন্তু এটা চেপে রাখার বিষয় না, তেমনি প্রকৃত অবস্থা না জেনে একটা হৈ চৈ ফেলে দেয়াটাও সমীচীন নয়। পাশ্চাত্য দেশে এগুলো অহরহ ঘটার পেছনে যথেষ্ট কারন রয়েছে। একাকীত্বে বসবাস, পারিবারিক মূল্যবোধের অভাব, ঘন ঘন সম্পর্ক পরিবর্তন এবং সেই সুবাদে সন্তান মায়ের নতুন স্বামীর সংগে বসবাস (বায়োলজীকাল বাবা নয়) এবং আরো অন্যান্য আনুষঙ্গিক ঘটনা। কিন্তু বাংলাদেশে পরিস্থিতি ঠিক এক রকম নয়। তাই পশ্চিমা দেশের তথ্য প্রমাণ ব্যবহার করে আমাদের দেশে কোন কর্মসূচী চালু করা অনেক বিপদজনক  এবং সেটা বিজ্ঞানসম্মত নয়। হয়তো আমাদের দেশে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ সামাজিক এবং পারিবারিক সম্পর্কের কারনে কিংবা হয়তো ততোটা নয় যতোটা আমরা ভাবছি। সে যেটাই হোক, জানার জন্য দরকার একটা নিবিড় সামাজিক গবেষণা। শুধু তাই নয়, একটা কর্মসূwP হাতে নিলেই তো চলবে না। পশ্চিমা দেশে এই সব নির্যাতিত শিশুদের দেখভাল করার জন্য সরকার কর্তৃক বিশেষ ব্যবস্থা থাকে যাতে তারা আশ্রয়হীন হয়ে না পড়ে। কিছু কিছু ঘটনার বিচার করতে হয় ঘটনার ব্যাপকতা দিয়ে এবং কিছু কিছু ঘটনা বিচার করতে হয় ঘটনার গুরুত্ব দিয়ে। কাজেই, এই ইস্যুতে ঘটনার ব্যাপকতা যাই হোক না কেন গুরুত্ব অবশ্যই ব্যাপক। কোন অবস্থাতেই আমাদের শিশুকে বিপদজনক পরিস্থিতিতে ঠেলে দেওয়া যাবে না। এটা অবশ্যই জিরো টলারেন্সের মধ্যে পড়বে। তাই রাষ্ট্রেকে এগিয়ে আসতে হবে এই সব শিশুদের রক্ষনাবেক্ষণের জন্য এবং থাকতে হবে কঠোর, অমার্জনীয় শাস্তির বিধান।

আসলে পশ্চিমা দেশগুলো সব সময়েই কোনও না কোনওভাবে চায় প্রাচ্যের উপর আধিপত্য কায়েম করতে। আগে এটা করতো ভূমি দখল করে; আর এখন করে “সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের” মাধ্যমে। তারা সব সময় তাদের চোখে “অন্য” প্রাচ্যের লোকদের সম্পর্কে নিজস্ব একটা ধারণা তৈরি করে রাখে কিংবা নিজস্ব চিন্তা চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করে। এডওয়ার্ড সাঈদ সুন্দরভাবে প্রাচ্য সম্পর্কে পাশ্চাত্যের দৃষ্টিভঙ্গীকে তুলে ধরেছেন এভাবে: প্রাচ্য নিকৃষ্ট, পশ্চাৎপদ, পরিবর্তনহীন, প্রাচ্য ভিন্ন, অপর, অন্ধকারাচ্ছন্ন, যুক্তিহীন। প্রাচ্যের ভাগ্য হচ্ছে পশ্চিমের আদলে নিজেকে বিবর্তিত করা।   পাশ্চাত্যের বিভিন্ন ছায়াছবিতে এর প্রমাণ মিলবে যেখানে আরবদের সব সময় চিহ্নিত করা হয় রক্তপিপাসু, অসৎ, বিশ্বাসঘাতক, নিচু, দুর্বৃত্ত ইত্যাদি নিকৃষ্ট পরিচয়ে চিত্রায়িত করে।

প্রত্যেক সমাজের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, আত্মীয়তার সম্পর্ক আলাদা আলাদা। এই ভিন্নতার কারণে বিভিন্ন সমাজের আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক ভিন্ন ভিন্ন রকম হয়ে থাকে। আমাদের দেশে আত্মীয়তার বন্ধনগুলো বেশ দৃঢ়; সেই তুলনায় পশ্চিমারা বেশি বস্তুবাদী। সমাজবিজ্ঞানী ভেবার পশ্চিমা বিশ্বের বস্তবাদী চেতনার উত্থান প্রসঙ্গে প্রোটেস্ট্যান্ট নৈতিকতাকে দায়ী করেন। প্রোটেস্ট্যান্ট নৈতিকতায় ঈশ্বরকে দুর্জ্ঞেয় এবং মোক্ষলাভ অনিশ্চিত মনে করায়  অনুসারীদের  মধ্যে প্রচন্ড শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। এই আদর্শে উৎসাহিত করা হলো ব্যক্তিস্বাতন্ত্রকে এবং যেখানে কোনও কিছুকে আর পবিত্র বলে গণ্য করা হয় না, এখানে ঐতিহ্য বলে আর কিছু থাকল না। সব কিছুকেই ভোগবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা হয়। এ কারণে তাদের মধ্যে পারিবারিক বন্ধন অতোটা দৃঢ় নয় এবং তাই বৃদ্ধ বয়সে অনেককেই “বৃদ্ধাশ্রমে” থাকতে হয়- সন্তানেরা বাবা মায়ের কোন দায়দায়িত্ব নিতে চায় না। যেহেতু এই নৈতিকতায় ইহকালের কোনও ভাল কাজ পরকালে কোনও ফল বয়ে আনবে না বলে মনে করে এবং তাদের কাছে সব কিছুই বিধাতা কর্তৃক পূর্ব নির্ধারিত- তাই সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এখানে আমাদের প্রাচ্য সমাজের মতো কোন  “সামাজিক নিষেধাজ্ঞা” বা সোশ্যাল ট্যাবু  গুরুত্বপূর্ণ কোন ভূমিকা রাখে না। এজন্যই তারা ফ্রয়েড এবং কার্ল গুস্তাভ য়্যুং এর ওডিপাস এবং ইলেক্ট্রা কমপ্লেক্সের ভাবধারায় বেশি প্রভাবিত। এই ভাবধারায় বস্তুবাদী তথা ভোগবাদী দর্শন পুরোমাত্রায় সক্রিয় যেখানে শিশুর পায়খানা করার মধ্যেও পায়ুপথে ফ্রয়েড সেক্স-এর গন্ধ খুঁজেছেন।

বর্তমানে “বৈশ্বিক” ধারণার বাড়াবাড়ি রকম প্রভার এবং বৃদ্ধি সত্ত্বেও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতি বৈশিষ্ট্যগতভাবে যথেস্ট ভিন্ন। ধর্মীয়, সামাজিক এবং জ্ঞাতি সম্পর্কের (kinship system) কারণে অথবা অন্য যে কোনও কারণেই হোক আমাদের সমাজে পারিবারিক বন্ধন অনেক দৃঢ় এবং মজবুত। বিভিন্ন মূল্যবোধ এখনো অলিখিতভাবে সামাজিক আইন হিসেবে শক্তিশালী ভূমিকা রাখছে; এমনকি তা আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের ভিতরেও। জ্ঞাতি সম্পর্কের (kinship) সূত্র ধরে বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে সম্পর্কের একটা সামাজিক নীতিমালা রয়েছে। এটা কেউ ইচ্ছে করলেই ভাঙতে পারে না; প্রথমতঃ সামাজিকতার প্রক্রিয়া (socialization process) মধ্য দিয়ে অবৈধ সম্পর্কের বিরুদ্ধে এক ধরণের “সামাজিক নিষেধাজ্ঞা” (social taboo) গড়ে উঠেছে এবং দ্বিতীয়তঃ সামাজিক শাস্তির ভয়। কিন্তু পাশ্চাত্য সমাজে তথাকথিত “ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ” কিংবা জ্ঞাতি সম্পর্কের প্রভাবে সেখানে ভিন্ন মূল্যবোধ এবং ভিন্ন সংস্কৃতি তৈরি হয়।   “ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের" ফলাফল হিসেবে সেখানে সব কিছুকেই বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা হয়। “সামাজিক বিচার” বা “সামাজিক সংবিধান” সেখানে আমাদের মতো এতো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে না। তাছাড়া উন্নয়নকে শুধুমাত্র অর্থনীতিকেন্দ্রিক করে ফেলার ফলে তাদের মধ্যে মানবিক সম্পর্কের মধ্যকার আবেগীয় ব্যাপারগুলো লোপ পেয়েছে বা তীব্রতা কমে যাচ্ছে। প্রাচুর্যের তান্ডবে এবং পারস্পরিক বন্ধনের অভাবে তাদের মধ্যে যে হতাশার জন্ম নেয় তা অনেক নীতিবোধকে নষ্ট করে ফেলে। হয়তোবা এ কারনে তাদের দেশে হরহামেশা নিকট পুরুষ আত্নীয়কর্তৃক  মেয়েরা বেশি ধর্ষিতা হচ্ছে। এ সকল দেশ থেকে “উন্নয়ন দূত” হিসেবে যারা আসেন তারা সঙ্গে করে “যৌন নির্যাতন প্রেক্ষিত গৃহ এবং নিকট আত্মীয়” এই পূর্ব ধারণা আমদানি করে নিয়ে আসেন। কিন্তু আমাদের বাস্তবতায় এ ধরনের ঘটনার ব্যাপকতা কতোটুকু তা একবারও ভেবে দেখা হয় না। অবস্থানগত কারণে ভিন্নমত থাকলেও আমরা অনেকে অনেক সময় বিশ্বাসের সঙ্গে আপস করতে বাধ্য হই।

আমরা যদি সামাজিক নিরাপত্তার কথা চিন্তা করি তবে দেখব যে আমাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক সমাজের ভিতরে বিশাল ভূমিকা রাখছে। বাবা মা দু’জনেই চাকরী করলে এখনো আমাদের দেশের সন্তানেরা বড়দের স্নেহ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে না। এর সুযোগ কেউ কেউ নিতে পারে। আমি জানি না, আমাদের দেশে নিকট আত্নীয় কর্তৃক যৌন হয়রানির ব্যাপকতা কতোখানি। কেননা শুরুতেই আমি বলে রেখেছি যেহেতু বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর; তাই এ বিষয়ের উপর তেমন কোনও গবেষণা এখনো হয়নি। ব্যাপকতা না জেনে এতোবড় স্পর্শকাতর বিষয়ের জন্য কর্মকৌশল ঠিক করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। যে কোন ট্যাবু বা সামাজিক নিষেধাজ্ঞা পালিত হয় বা টিকে থাকে সামাজিক লজ্জা, ভয়ের কারণে।

সবশেষে একটা কথা না বললেই নয়, তাতে আমার লেখার অপূর্ণতা থেকে যাবে এবং বিভ্রান্তির সুযোগ থাকবে। আমাদের দেশে যে শিশুরা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে না তা কিন্তু নয়। তবে তার জন্য আবার  বলব যে, আমাদেরকে পাশ্চাত্যের ঘটনাকে ভিত্তি করে ধরে এবং সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা করা ভুল হবে। আমাদের দরকার আমাদের নিজস্ব অবস্থা জানা এবং এর মাত্রাটা সঠিকভাবে নিরূপণ করে কর্মকৌশল ঠিক করা। যাতে একটা খারাপ ঘটনাকে ঠেকাতে গিয়ে সমাজে বড় আকারে অন্য কোন ক্ষতিকর প্রভাব না পড়ে। সার্বিক সামাজিক স্বার্থ বিবেচনা করেই আমাদেরকে সতর্ক হতে হবে। আরো বেশি সতর্ক থাকতে হবে, কেউ যেন আমাদেরকে ব্যবহার করতে না পারে। মনে রাখতে হবে, পশ্চিমা সমাজে অনেক কিছুই নেই যা আমাদের সমাজে আছে। মাথাব্যথা হয়েছে বলে কারো পরামর্শে যেন আমরা মাথাটাকেই কেটে না ফেলি। এর জন্য কিউরেটিভ, প্রিভেনটিভ অনেক ব্যবস্থা রয়েছে। অবশ্য যাদের মাথাই নেই (এক্ষেত্রে পশ্চিমারা) তারাতো বলবেনই মাথা কেটে ফেলতে। সেই ঈর্ষাপরায়ণ লেজ কাটা চতুর শেয়ালের গল্প কে না জানে! একটু ভুল হলো বোধ হয়, মাথা কাটার মতো সামাজিক রোগ হলে অবশ্যই মাথা কাটতে হবে। কিন্তু সেই রোগটা তো সঠিকভাবে ডায়াগনোসিস করতে হবে তো!

মাহবুব মিঠু, সমাজ গবষেক ও লখেক
mahalom72@yahoo.com
বাংলাদশে সময় ১০৫৮ ঘণ্টা, আগস্ট ২৫, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।