মনোবিজ্ঞানীরা বলেন আত্মহত্যা একটি রোগ। এ রোগে যে কোনো মানুষ যে কোনো সময় আক্রান্ত হতে পারেন।
প্রসঙ্গটির অবতারণা এ কারণে যে, যারা রাগে দুঃখে অপমানে অথবা জেদ করে আত্মহত্যা করে তারা কি মনোবিজ্ঞানীদের বলা ‘আত্মহত্যা রোগে’ আক্রান্ত হয়ে আত্মহত্যা করে?
গত ক’দিন ধরে সংবাদপত্রে প্রকাশিত পরপর একই রকম সংঘটিত আত্মহত্যার দুটি খবরের বিষয় আমার মাথায় ঘুর ঘুর করছে। ১৪ আগস্ট ২০১১ হবিগঞ্জের মাধবপুরে ফেরদৌসী নামে এক মা তার চার সন্তানসহ চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দেন। সৌভাগ্যক্রমে তার দুই সন্তান কিছুটা আহত হয়ে বেঁচে গেছে। কিন্ত মা তাঁর দুই সন্তানসহ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পেরেছেন। পরদিন হবিগঞ্জের পাশ্ববর্তী জেলা মৌলভীবাজারের শমশের নগরে রুমা বেগম নামে আরেক মা তার দুই বছর বয়সের একমাত্র শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে সেই একইভাবে চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করলেন।
এ দুটি ঘটনার একমাস আগে ১৭ জুলাই’ ২০১১ মৌলভীবাজারের ছয়কুট গ্রামের শেলী রাণী বৈদ্য নামে আরেক মা তার দুই শিশু সন্তানকে সাথে নিয়ে নিজের পা বেঁধে পুকুরে ডুবে আত্মহত্যা করেন। কী বীভৎস! কী হৃদয়বিদারক ঘটনা! লিখতে গিয়ে আমার গায়ের লোম কাঁটা দিয়ে উঠছে। অথচ এই মায়েরা কি ভাবে পারলেন তাদের সন্তান সাথে নিয়ে এমন মৃত্যু বেছে নিতে? আমি কেমন আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছি বলেই হয়ত: ঐ মায়েদের দোষ দিয়ে লেখাটিকে এগোনোর চেষ্টা করছি। এও হতে পারে আমি ভীতু প্রকৃতির মানুষ বলেই হয়ত আমি তাদের এমন মৃত্যু সমর্থন করতে পারছি না। তবে তারা হয়ত তাদের অবস্থান থেকে সাহসের সাথে ঠিক কাজটিই করেছেন।
এখন আমি বলতে চাচ্ছি এই যে মায়েরা আত্মহত্যা করলেন তারা কি আত্মহত্যা রোগে আক্রান্ত হয়ে আনন্দে এটা করেছেন? পত্রিকার সংবাদের বর্ণনা সেটা বলে না। হবিগঞ্জের ফেরদৌসী গ্রাম্য শালিসে অপমানিত হয়েছেন। গ্রাম্য মাতব্বররা তার চরিত্রের উপর কালিমা লেপন করেছেন। সে কারণে ফেরদৌসীর ভিতর এমন জেদ জন্ম নিয়েছে যে আর এ জীবন রাখা যায় না। যখন তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন আত্মহত্যা করবেন তখন সন্তানদের কথা মাথায় এসেছে। মা হিসাবে তিনি ভেবেছেন আমি না থাকলে সন্তানদের দেখেবে কে? সম্ভবত: এই চিন্তা থেকে তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেন `আমি যখন থাকবো না তখন আমার সন্তানরাও আর পৃথিবীতে না থাকুক। ` তাই তিনি চার সন্তান সাথে নিয়েই ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। ভাগ্যক্রমে দুই সন্তান বেঁচে গেছে। শমশেরনগরের রুমা বেগম যে তার পুত্রসন্তান নিয়ে আত্মহত্যা করলেন তার ঘটনাওতো একই রকম। যে প্রিয় স্বামীর সাথে সাত বছর ধরে সংসার করছেন, সেই স্বামী যখন বাপের বাড়ি থেকে ইফতারি দিচ্ছে না কেনএই প্রসঙ্গ তুলে মারধর করে সেই স্বামীর সাথে কি আর সংসার করা যায়? তাইতো তিনিও আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং সেই ফেরদৌসীর মতো একমাত্র সন্তানকে তার সঙ্গী করে একই রকম ঘটনা ঘটালেন। শেলী রাণী বৈদ্য শ্বাশুড়ি ও দেবরের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে আত্মহত্যার পথ ধরলেন।
আমার স্মরণে আসছে ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ খ্যাত অভিনেত্রী ডলি আনোয়ারের (ডলি ইব্রাহীম) কথা। ডলি আনোয়ার আত্মহত্যা করেছিলেন। সেই সময় পত্রিকার রিপোর্টিংয়ে পড়েছিলাম। আত্মহত্যার আগে তিনি তার পরিচিতজন সবার সাথে দেখা করেছিলেন। হাসি-তামাশা-আনন্দ করেছিলেন। একাকী থাকতেন। সারা ঘর তিনি ফুল দিয়ে সাজিয়ে ছিলেন। কাউকে বুঝতে দেননি তিনি এমন কান্ড ঘটাবেন। কিন্তু তিনি ঘটিয়ে ছিলেন। পরিচিত জন, স্বজন আর তার ভক্তদের তিনি কাঁদিয়েছিলেন এমন অভিনব আত্মহত্যা করে।
ফেরদৌসী, রুমা কিংবা শেলী রাণী বৈদ্যকে আমি ডলি আনোয়ারের সাথে মিলাচ্ছি না। ডলি আনোয়ার ছিলেন শিক্ষিত রুচিশীল উচ্চ সমাজের একজন। তার হয়ত চাওয়া পাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিলো। তাই এমন করেছিলেন। ফেরদৌসী, রুমা ও শেলী তো গ্রামের সহজ সরল গৃহবধূ। তাদেরকে তো পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কর্তারা অপবাদ দিয়ে, নির্যাতন করে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিলেন। কিন্ত তাঁরা যে কাজটি করলেন তা নিয়ে আমার কিছু কথা বলার জন্যই এই লেখাটি।
ফেরদৌসী ও রুমা কিংবা শেলী রাণী বৈদ্য হয়ত রাগে ক্ষোভে অপমানে সিদ্ধান্ত নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। কিন্ত তারা যে তাদের সাথে সন্তানদের হত্যা করলেন এ বিষয়টি আমাকে ভাবিত করছে। আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা পদে পদে লাঞ্ছিত হয়েছেন, হচ্ছেন, আগামীতেও হবেন। আমরা আমাদের যন্ত্রণা জেদ কিংবা আপমানের জ্বালা মেটাতে গিয়ে আমাদের সাথে নিষ্পাপ সন্তানকে কেন বলি করছি?
গত বছর ঢাকার জুরাইনে এক মা যখন সন্তানসহ আত্মহত্যা করলেন আর অন্যজন তার অবৈধ প্রেমের সাক্ষী না রাখতে গিয়ে প্রেমিকের সহায়তায় সন্তান হত্যা করলেন তখন মনে মনে ভেবেছিলাম এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু এখন এসব হত্যা ও আত্মহত্যার ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমার ভিতরে এক ধরণের শঙ্কার সৃষ্টি করছে। আমি অশুভ লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এসব হত্যা ও আত্মহত্যা মহামারি আকার ধারণ করবে। এই তিন মায়ের সন্তানসহ আত্মহত্যা তারই ইঙ্গিত বহন করছে বলে আমি মনে করি।
আমাদের সমাজে এখন এক অস্থির অবস্থা বিরাজ করছে। তাইতো দেখি এমন হৃদয়বিদারক ঘটনাকে কোনো কোনো মহল চিত্ত বিনোদনের উপকরণ হিসাবে নিচ্ছেন। কতজনকে দেখেছি রঙ চড়িয়ে রসিয়ে রসিয়ে এইসব ঘটনা বিকৃতভাবে উপস্থাপন করতে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে; কেন এসব মায়েরা হত্যা ও আত্মহত্যার মত জঘন্য অপরাধ সংঘটিত করলো? এর দায় কি শুধু এই মায়েদের? সমাজ ও রাষ্ট্রের কি কোনো দায় নেই?
আমিতো মনে করি এই নারীরা আত্মহত্যার মাধ্যমে সমাজের কাছে রাষ্ট্রের কাছে তাদের অসহায়ত্বের প্রকাশ ঘটাচ্ছেন। সেই সাথে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি ঘৃণাও জানাচ্ছেন।
আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে গ্রাম্য মাতব্বররা বারবারই সালিসের নামে তাদের অমানবিক সিদ্ধান্ত নারীদের উপর চাপিয়ে দেন। পুরুষরা সালিসে বসে নারী ব্যভিচার করেছে, নারীই অন্যায় করেছে, এই বলে নারীকে শাস্তি দিয়ে রায় ঘোষণা করে দেন। ব্যভিচারে যে পুরুষটি যুক্ত ছিলো বা থাকে তাকে আড়াল করে রাখেন। তার উপর শাস্তি হয় না।
আমি এখানে প্রশ্ন তুলতে চাই আমাদের গ্রামে গ্রামে আজ যারা সালিস করছে, ফতোয়া দিচ্ছে তারা কতটুকু আইন জানে? কতটুকু জানে ধর্ম সম্পর্কে? আমরা যারা নিজেদের শিক্ষিত বলে দাবি করি, তারাও কতটুকু জানি ইসলামী আইন কিংবা ধর্মের সারবস্তু? ধর্মের অল্প পাঠ গ্রহণ করে সীমাবদ্ধ জ্ঞান অর্জনকারীরা ধর্মকে পুঁজি করে যারা ব্যবসা করছে, তারাই ধর্মের সবচেয়ে বড় ক্ষতি করছে। যেহেতু তারা পুরুষ সে জন্যই ব্যভিচারী ঐ পুরুষটিকে ‘ফতোয়া-আইনের’ বাইরে রেখে তারা সিদ্ধান্ত দিয়ে দেয়।
শুধু তাই নয় আমি এমনও দেখেছি অপরাধী পুরষটিও ফতোয়াকারীদের সাথে এক হয়ে যায়। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণিত করার জন্য ঐ মেয়েটিকে গালিগালাজ করতেও কুন্ঠাবোধ করে না। অথচ ইসলামী আইনতো ব্যভিচারে লিপ্ত নারী-পুরুষ উভয়ের বিরুদ্ধে শাস্তির মাত্রা সমান রেখেছে। এসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। ইসলাম কখনোই ব্যভিচারকে সমর্থন করে না। ‘ব্যভিচার’ তো অবশ্যই একটি জঘন্য অপরাধ। ব্যভিচার তো কখনো একটি সুস্থ সমাজের চিত্র হতে পারে না।
পাঠক নিশ্চয় মনে আছে কমলগঞ্জের ছাতকছড়ার নূরজাহানের কথা। নূরজাহানের সেই আত্মাহুতি এ দেশে নারীর অধিকার আদায়ের আন্দোলন বেগবান করেছিল। তারই পথ ধরে নারীদের পক্ষে বেশ কিছু আইনও হয়েছে। যদিও এসব আইন নারীদের এখনো রক্ষাকবচ হয়ে উঠতে পারেনি। তবুওতো একটি ভিত তৈরী হয়েছে। এই ভিতটুকুই আমাদের জন্য আশার আলো।
আইয়ামে জাহেলিয়াতে ব্যভিচারে যখন সমগ্র আরব নিমজ্জিত ছিল, তখনই ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মুহাম্মদ(সাঃ) শান্তির বার্তা পৌছে দেন মানুষের কানে। মানুষকে শোনান আল্লাহর বাণী কোরআন। যা নিঃসন্দেহে মুসলমানের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান।
বহু-ব্যভিচারে যখন সমাজে এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তখন তা প্রতিরোধের জন্য এক পুরুষের চার বিয়েকেও সমর্থন দেয়া হয়েছিল। কারণ একটাই, বহু-ব্যভিচারের চেয়ে চার বিয়ে তখন উত্তম ব্যবস্থা ছিল।
আমাদের সমাজ আজ ভোগবাদী বিকৃত রুচিপীড়িত হয়ে পড়েছে। আজ ব্যভিচারকে নৈতিকভাবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য আমাদের ভোগবাদী সমাজ উঠে পড়ে লেগেছে। বিকৃত হচ্ছে মা-বোনের মন। কোনো কোনো মা-বোন তাই ভোগবাদী হয়ে উঠেছেন। ভোগবস্তু আদায়ের জন্য এইসব মায়েরা বোনেরা নিজ সন্তানকে প্রতিবন্ধক মনে করেন। তাই দেখি নিজের কুকর্ম ঢাকার জন্য সন্তানকে হত্যা করতেও মায়ের বুক কাঁপে না।
এ থেকে উত্তরণের পথ বের করতে হবে। জাগ্রত করতে হবে আমাদের বিবেককে। নারী পুরুষ নির্বিশেষে আমাদের ভিতরে ঘুমিয়ে থাকা নৈতিকতা তথা মূল্যবোধের উত্থান ঘটাতে হবে। তা হলেই হয়ত: আমরা মানুষের পরিচয় নিয়ে সমাজে রাষ্ট্রে মাথা উচুঁ করতে পারবো। নতুবা আমরা বিকৃত হত্যার কাছে; আত্মহত্যার কাছে বারবার পরাজিত হবো।
লতিফা নিলুফার পাপড়ি: কলাম লেখক, কবি, গল্পকার, শিক্ষক।
ই-মেইল: lnpapri@gmail.com