বিএনপি সমর্থক আইনজীবী এম ইউ আহম্মেদের দূর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর ইস্যুটি এখন দেশের নতুন রাজনৈতিক ইস্যু। ঈদের আগে-পরে বেশ কিছুদিন ইস্যুটি চাঙ্গা থাকবে।
এখানে ইনাদের-উনাদের সবার উদ্দেশে কিছু কথা বলা হবে। খারাপ লাগতে পারে। কিন্তু কথাগুলা বলা দরকার। হাইকোর্টে বিচারপতিদের এজলাসের সামনে মস্তানির যে ঘটনাটি যে ভালো কোন কাজ ছিলো না, তা পরে আদালতের কাছে সংশ্লিষ্টদের নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা ও তা মঞ্জুরের ঘটনায় প্রমাণিত। কিন্তু আমরা দেখলাম যারা দোষ স্বীকার করে মাপ চেয়ে জামিন নিলো, মুক্তির পর গাদাফুলের ছবি গলায় ঝুলিয়ে তারা আমাদের বিজয়ের ‘ভি’ দেখায়! ১৬ আগস্ট যে মানুষটি জামিনে মুক্ত হলেন তিনি এতদিন কি করে পুলিশে হেফাজতে ছিলেন? পুলিশ নিজেদের টর্চার আড়াল করতে তা করেছে। আইজিপিকে কোর্টে তলব করে তা কি জানতে চাওয়া হবে?
স্কয়ার হাসপাতালের ডাক্তাররা অবশ্য বলেছেন, হৃদরাগে আক্রান্ত অবস্থায় এম ইউ আহম্মেদকে তারা পেয়েছেন। এসময় খুব কমে যায় তার রক্তচাপ। সেটা গত সাত দিনেও স্বাভাবিক হয়নি। তার হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক ছিল না। এ ছাড়া তিনি ক্রনিক ব্রংকাইটিসে ভুগছিলেন, ফুসফুসও কাজ করছিল না। এসব বিভিন্ন জটিলতা যুক্ত হয়ে তিনি মারা যান। ’
এ সম্পর্কে কি বক্তব্য বিএনপির? না কি স্কয়ার হাসপাতালের ডাক্তাররা সবাই আওয়ামী লীগার?
এম ইউ আহম্মেদের মৃত্যুর ঘটনাকে খালেদা জিয়াসহ সবাই হত্যাকাণ্ড বলেছেন। হত্যা মামলার এজাহার দাখিল করা হয়েছে, কিন্তু লাশের ময়নাতদন্ত প্রথম কেন করতে দেওয়া হয়নি? পরিবারের অমতে গিয়েও কেন ময়নাতদন্ত করতে হয়েছে পুলিশকে? বা এখন কেন বলা হচ্ছে ইচ্ছেমতো রিপোর্ট দেয়ানোর জন্য পরিবারের বিনা অনুমতিতে ময়নাতদন্ত করা হয়েছে? আইনত ময়নাতদন্ত, ফরসেনিক রিপোর্ট ছাড়া কী একটা হত্যা মামলা চলে? বা এরপর যদি কবর থেকে উঠিয়ে লাশের ময়নাতদন্তের আদেশ কোর্ট দিত, তাহলে তা কী ভালো লাগার কথা ছিল স্বজন-পরিজনের?
গ্রেফতারের পর পুলিশের হেফাজতে অসুস্থ হন এম ইউ আহম্মেদ। এর দায়দায়িত্ব পুলিশের এড়ানোর সুযোগ আছে কী? এখন পুলিশ প্রমাণ করবে তাদের কোনও বাড়াবাড়ি ছিল না। কিন্তু তদন্তটা যেন পুলিশকে দিয়ে করানো না হয়! নিজেদের বাঁচাতে মিথ্যা বলে পুলিশ। এমন হাজার-লক্ষ প্রমাণ আছে।
পুলিশ আমাদের দেশে বরাবরই বাড়াবাড়ি করে। আওয়ামী লীগের সময় আওয়ামী লীগারদের চেয়ে বেশি বা বিএনপির সময় দলীয় নেতাকর্মীদের চেয়ে বেশি হয়ে যাওয়ার প্রমাণ দেখাতে তারা অনেক কিছু করে বা করানো হয়। এ আমলেও তা সমানে চলছে।
এখন বিরোধীদলে থাকাতে বিএনপি পুলিশি টর্চারের বিরুদ্ধে সোচ্চার, কিন্তু একবারও কী মুখ ফুটে বলছে যে আবার ক্ষমতায় গেলে পুলিশি টর্চার নিষিদ্ধ করা হবে?
কেন এটা একবারও বলা হয় না? বা তারা ক্ষমতায় থাকতে ড মহিউদ্দিন খান আলমগীর, সাবের হোসেন চৌধুরী, বাহাউদ্দিন নাছিম বা মুনতাসির মামুন, সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির, সেলিম সামাদ, এনামুল হক চৌধুরী, প্রিসিলা রাজসহ অনেকের ওপর যে ভয়াল টর্চার করা হয়েছিল তা ‘ঠিক’, ‘আইনি’ ছিল?
মতিয়া চৌধুরীসহ নারী নেত্রী-কর্মীরা রাস্তায় নামলে যে সাপের মতো পেটানো হতো, পুলিশের পিটুনি খেয়ে সে সব কী আজ একবারও মনে পড়ে? বা রাস্তায় বিরোধীদলের নারী রাজনৈতিক কর্মীদের সাপের মতো পেটাচ্ছে দেখলে ভালো লাগে আজকের মতিয়া চৌধুরী বা অপু উকিলদের? ভালো না লাগলে এর প্রতিবাদ করেন না কেন?
এম ইউ আহম্মেদের দূর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর পর হাসপাতালে ছুটে এসেছেন মুরব্বি আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। স্বপেশার মানুষ বলে তিনি ছুটে এসে বলেছেন, পুলিশ সব পারে? দেশ যে কোথায় যাচ্ছে তা এখন বোঝা যাচ্ছে! তা আইনজীবীর গায়ে হাত পড়াতে আপনি এলেন কথা বললেন, সাধারণ আমজনতা পাবলিককে যে সারাদিন পুলিশ বেআইনি পেটায় তখন একটুও বলেন না বা বিষয়টি কোর্টের নজরে আনেন না কেন?
লিমনের মতো একটা ছেলেকে যে এভাবে চোখের সামনে সারাজীবনের জন্য পঙ্গু বানিয়ে দেওয়া হলো, কোনদিন তা কোর্টে বা কোথাও দাঁড়িয়ে বলেছেন কী? সরি, আপনারাতো আবার মোটা ফি ছাড়া কোন কথা বলেন না বা দাঁড়ান না কোর্টে। লিমনের দরিদ্র মায়েরতো আবার আপনাদের মতো আইনজীবীদের টাকা দেবার সামর্থ্য নাই।
তা দেশ কোথায় যাচ্ছে টের পাচ্ছেন ব্যারিস্টার রফিক-উল হক? শেখ হাসিনা নিহত হবেন? আপনাদের মতো আইনজীবীদেরতো কিছুতেই কোনও সমস্যা নেই! সামরিক শাসকদের অ্যাটর্নি জেনারেল হবার অভিজ্ঞতাও আছে। এখন অবশ্য অত ছোটতে আপনারা রাজি হন না। কারণ আপনাদের আইন ব্যবসার ব্যাপ্তি-প্রাপ্তি অনেক বেশি।
আবার দেশে ১/১১ এলেও ক্ষতি নেই আপনার বা আপনাদের। তখন সব দলের গ্রেফতারকৃতের পরিবার-পরিজন টাকার বান্ডিল হাতে আপনার কাছে ছুটে যায়। আবার শেখ হাসিনা-খালেদা জিয়ার জামিনের মামলা আপনারা বিনে পয়সায়ও করেন। সব সমস্যা-মুসিবততো আমাদের আমজনতার!
ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, আমার এ কথাগুলায় অপরাধ নেবেন না। আইন পেশার বিশাল উপার্জন নিয়ে আপনি বিশাল একটা এতিমখানা একা চালান জানি। আক্ষেপের কথা বলার কারণ আওয়ামী লীগ-বিএনপি দু’দল মিলে দেশটাকে এমন যে পুলিশি রাষ্ট্র বানিয়ে রেখেছে, আপনি রফিক-উল হক, ড কামাল হোসেন, ড. জহির এমন চার-পাঁচজন মিলেই তা বন্ধ করাতে পারতেন। একেকটা ঘটনা ধরে ধরে যদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আইজিপিকে এক-দু’ ঘন্টার নোটিশে ভিকটিমসহ হাজির করাতেন কোর্টে, অনেক বাড়াবাড়ি কমে আসতো হয়তো। আপনারা চার-পাঁচজন মিলে চেষ্টাটিতো করতে পারতেন।
এম ইউ আহমদের মৃত্যুর পর স্কয়ার হাসপাতালে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে ধাওয়া, অবরুদ্ধ করে রাখার কারণ কী? তিনি যদি হাসপাতালে লাশ দেখতে না যেতেন তখন কী বলা হতো না যে অ্যাটর্নি জেনারেলও লাশ দেখতে আসেন নি! খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা, সুপ্রিমকোর্ট বারের সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, লাশের সুরতহাল রিপোর্টকে প্রভাবিত করতে অ্যাটর্নি জেনারেল হাসপাতালে এসেছিলেন। আবার পোস্ট মর্টেম করাতে দেয়া হচ্ছিল না! কেইসটা কী?
এখানে আমাদের এই ‘মামা’র উদ্দেশেও কিছু বলা দরকার। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর মামা হওয়াতে তিনি ঢাকার মিডিয়ার অনেক রিপোর্টারেরও মামা। মামার ‘নানা!’ বিষয় দেখেশুনে আজকাল দূর থেকে না হেসেও পারিনা। বিএনপিতেও তিনি এখন যেন ‘মোর ক্যাথলিক দ্যান দ্য পোপ’!
অথচ এই মামাতো বিএনপিতে নব্য। এখানে আসার আগে জাতীয় পার্টি করতেন। এরও আগে মানিক মিয়ার শ্যালক হিসাবে ছাত্রলীগ। ছোট ভাগ্নে মঞ্জুর সঙ্গে আওয়ামী লীগের সখ্যের কারণে এ দলটির সঙ্গেই তার বরাবর ভালো যোগাযোগ ছিল বা এখনও আছে।
আমাদের সেই মামা কিন্তু এখন বিএনপির পক্ষে খালেদা জিয়ার চেয়ে বেশি অ্যাগ্রেসিভ। তার বড় ভাগ্নে ১/১১ এর ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের চাইতেও বেশি যেন! তাকে বিনীত প্রশ্ন রেখে জানতে চাইছি একটি হত্যা মামলায়, আইনগত কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ মামা? সুরতহাল রিপোর্ট না ময়নাতদন্ত-ফরসেনিক রিপোর্ট? গুরুত্বপূর্ণটা কেন বাদ রাখতে চাওয়া হয়েছিল?
বিষয়টি হত্যাকান্ড হিসাবে নিজেরা কনভিন্সড না বলেই কী শুধু শুধু রাজনীতি করার জন্যেই লাশের ময়নাতদন্ত করাতে দিতে চাননি? আইনজীবী হিসাবে এর খোলাসা আপনাদের করতে হবে?
অ্যাটর্নি জেনারেলকে ধাওয়ার যে একটু নিন্দাও করলেন না মামা? আপনি কোনদিন অ্যাটর্নি জেনারেল হলেও খোদা নাখাস্তা যদি তেমন পরিস্থিতির শিকার হন? পথ যে আপনার সাবেক আওয়ামী ভাগ্নেদের চিনিয়ে দিয়ে রাখলেন! তা এই ইস্যুর সুযোগে পুলিশের বেআইনি টর্চারের বিষয়টা হাইকোর্ট-সুপ্রিমকোর্ট দিয়ে সরাসরি নিষিদ্ধ করানোর উদ্যোগ নেবে? খালেদা জিয়াকে দিয়ে একটা ঘোষণা দিয়ে বলাবেন, বিএনপি আর কোনদিন ক্ষমতায় গেলে পুলিশের হাতে কোন লাঠি জাতীয় জিনিসও থাকবে না? এই সুযোগে উদ্যোগটা নিন। কারণ এই বর্বর চিহ্নিত পুলিশ রাষ্ট্রটি আমার না। এই রাজনৈতিক-নৈতিক সততাটুকু কী দেখাতে পারবেন না আপনারা?
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময় ১০৪৯ ঘণ্টা, আগস্ট ২৮, ২০১১