লোকচক্ষুর আড়ালে ঘাপটি মেরে থাকা বন্ধু সাংবাদিক ও কবি জাফর ওয়াজেদ বিদ্রুপ করে বলতেন, মন্ত্রী হবার জন্যে তিনশ’ সিসি মগজ কম বা বেশি থাকতে হবে। স্বাভাবিক মানুষেরা মন্ত্রী হতে পারেন না।
রাজনীতিবিদদের এই কালঘুম ভাঙ্গানো অতি জরুরি হয়ে পড়ছে দেশ ও জাতির স্বার্থে। তাদের এই ’কালঘুম’ ভাঙ্গানোর জন্যে বিশেষ বা বাড়তি কোনও যোগ্যতা লাগে না। কেবল সাহসী, সৎ ও আন্তরিক হতে হয়। প্রিয়তম মানুষ ও লেখক অজাতশত্রু সৈয়দ আবুল মকসুদ নির্লোভ, সৎ ও আন্তরিক মানুষদের অন্যতম। তেত্রিশ বছর আগে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্হায় পরিচিত হওয়া মানুষটি অবিকল একই আছেন। বিনয় ও নিরহঙ্কারে ধন্য মানুষটির পোশাক ছাড়া আর কোনো পরিবর্তন নজরে আসে না।
অনেক ক্ষেত্রেই সৈয়দ আবুল মকসুদ বাংলাদেশের প্রথম ও অগ্রণী। গান্ধীজি, মাওলানা ভাষানী ও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ গবেষণার পথিকৃৎ তিনি। সৎ, সাহসী ও যুগপোযোগী উচ্চারণের জন্যে তার খ্যাতি বুদ্ধিজীবী মহলে সুদৃঢ়। তিনি যেন বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধিজীবী। অজাতশত্রু এই মানুষটি ২৪ আগস্ট শহীদ মিনারে ঘোষণা দিলেন শহীদ মিনারেই ঈদ করবেন। পুনর্ব্যক্ত করলেন আজকের বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের দাবি: যোগাযোগ সহ অযোগ্য সব মন্ত্রীর ঈদের আগে পদত্যাগের (কিংবা বরখাস্তের)। রাজনৈতিক সংকীর্ণতার ও দলীয় সীমাবদ্ধ বিশ্বাসের দেয়াল ভেঙ্গে এধরনের দাবি উত্থাপনের যোগ্যতা ও সাহস বোধহয় একমাত্র মকসুদেরই আছে। কাজে-কর্মে তিনি কখনো কখনো ব্যক্তির সীমা ছাড়ানো একক প্রতিষ্ঠান। রোববার তিনি এক বেতার সাক্ষাৎকারে আজকের বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের দাবিগুলোকে পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
কিন্তু রাজনৈতিক কালঘুমে থাকা মন্ত্রীরা নিদ্রাভঙ্গের বিরক্তিতে আছেন। তারা উঠে পড়ে লেগেছেন মকসুদের চরিত্র হননে। এ-যেন হাতির মুখে পিপীলিকার ঘুষি! বটতলার কালো কোটধারী এক মন্ত্রী মকসুদকে ‘আন্না হাজারে’ বানিয়ে ছেড়েছেন। ব্যঙ্গ করেছেনঃ লুঙ্গি-চাদর পরলেই আন্না হাজারে হওয়া যায় না। এই মন্ত্রী কিন্তু কেবল মুজিব কোট গায়ে দিয়েই আওয়ামী লীগ, কালো কোট গায়ে চড়িয়ে উকিল। কথাবার্তা শুনে মনে হয় না অন্য কোনো যোগ্যতা তার আছে। উনি হচ্ছেন, ক্ষমতাসীন রাজনীতির ‘পিকেল’। নিজেরা অসৎ ও দুর্নীতিবাজ বলেই মন্ত্রীদের অনেকেই বিশ্বাস করেন না যে বাংলাদেশেও সৎ মানুষ আছে। এই সব মন্ত্রীর ’দেশে’ মকসুদের মতো মানুষ পাওয়া অতি ভাগ্যের কথা। মকসুদ আজ অব্দি ক্ষুন্ন করেননি, জাতির বিশ্বাস ও আস্হা। প্রতিটি জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট আন্দোলনে মকসুদের ছিলো সরব উপস্হিতি। আমাদের রাজনীতি আজ রাজনীতিবিদের হাতে নেই, রাজনীতির নিয়ন্ত্রা আজ রাজনীতিবিদ নামধারী মুনাফা খোর ও দুর্বৃত্ত। এই শ্রেণীর খপ্পরে পড়ে দেশ-জাতির ভবিষ্যৎ গোল্লায় যাচ্ছে। বাংলাদেশ হাঁটছে নাইজেরিয়া-সোমালিয়ার মতো উল্টো পথে।
মকসুদ আজ লড়ছেন বাংলাদেশের সার্বিক রাজনৈতিক দুর্নীতি বিরুদ্ধে। দুর্নীতি বন্ধ করা গেলে অন্যসব সমস্যার সমাধান এমনিতেই আসবে। এখন ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা রাজনীতিতে আসার মূল লক্ষ্য থাকে উপার্জন। জাতীয় সম্পদ আত্মসাৎ। রাজনৈতিক শক্তিগুলো মিলেমিশে পরিকল্পনা করে দেশের সব ‘ইনস্টিটিউশন’কে ধ্বংস করে দিচ্ছে। পশ্চাদুখি যাত্রার এই বাংলাদেশ নির্মাণের জন্যে মুক্তিযুদ্ধ হয়নি, দেশ স্বাধীন হয়নি। সম্ভবতঃ আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের সময় এসেছে। তবে এই মুক্তিযুদ্ধ হবে অহিংস। সমবেত ও সম্মিলিত মানুষের ঐক্যে ভেসে যাবে রাজনৈতিক অনাচার। মুখ থুবড়ে পড়বে দুর্নীতিবাজরা। এই মুহূর্তে আমাদের একজন ‘আন্না হাজারে’ চাই। সব কিছু মিলিয়ে বাঙালি ‘আন্না হাজারে’হবার মতো যোগ্য একমাত্র নির্লোভ মকসুদ। কারণ তিনি সহায় সম্পদহীন। পৈতৃক জীবন ছাড়া হারানোর মতো কোনো সম্পদ নেই তার। সর্বোপরি উনি অহিংস।
সফেদ লুঙ্গি চাদরের মকসুদ দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটা অহিংস জেহাদের আহ্বান জানাবেন শহীদ মিনার থেকে, এই প্রত্যাশায় থাকি। প্লিজ, মকসুদ ভাই, নিরাশ করবেন না।
২৯ আগস্ট, ২০১১ মেলবোর্ণ