গুরশরণ কাউর। বিশ্বের বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের ফার্স্ট লেডি।
২০০৪ সালে হঠাৎ করেই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হয়ে যান মনমোহন সিং। মৌলবাদী বিজেপিকে তাড়ানোর নির্বাচনী বিজয়ের কৃতিত্ব খুব স্বাভাবিক প্রধানমন্ত্রী হবার কথা ছিল কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর। কিন্তু তাঁর বিদেশিনী পরিচয়ের অপরাধে বিজেপি আর হিন্দু মৌলবাদীরা প্রতিবাদ তুললে, বুদ্ধিমতি সোনিয়া দেরি না করে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মনমোহনের নাম প্রস্তাব করলে হঠাৎ পাদপ্রদীপের আলোয় তিনি চলে আসেন। যদিও তিনি লোকসভার সদস্যও ছিলেন না। ছিলেন রাজ্য সভার মনোনীত সদস্য। লোকসভা নির্বাচনে জেতার মতো ক্যারিশমাও ছিল না তাঁর। কংগ্রেস ক্ষমতায় গেলে টেকনোক্রেট কোটায় বড়জোর অর্থমন্ত্রী হিসাবে তাঁর নাম ভেবে রাখা হয়েছিল।
নির্বাচনী খবর সংগ্রহের উদ্দেশে তখন দিল্লীতে। ভারতীয় রাজনীতির বিশেষ এক পরিবর্তন প্রবাহের নানা ঘটনার সাক্ষী হওয়ার সুযোগ তাই হয়। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মনমোহনের নাম প্রস্তাবের পর মিডিয়ার লোকজনের সঙ্গে তাঁদের দিল্লীর বাড়িতে ছুটে গেছি । বাড়ির বাগানে রাখা সাধারণ প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে মিডিয়াকে প্রতিক্রিয়া দেন বিশ্বের বৃহৎ ডেমোক্রেসির দেশের নতুন ফার্স্ট লেডি! একজন গৃহিনী হিসাবে প্রধানমন্ত্রী স্বামীর কাছে কী প্রত্যাশা জানতে চাইলে বলেন, গৃহস্থালি সামগ্রী বিশেষ করে রান্নার গ্যাসের যাতে দাম না বাড়ে। বাংলাদেশের সাংবাদিক হিসাবে বিষয়টি খুব স্পর্শ করে। কারণ আমাদের দেশের ফার্স্ট লেডির অভিজ্ঞতা ভালো নয়। সেই ২০০৪ থেকে এখনও ভারতের ফার্স্ট লেডি গুরশরণ। কিন্তু আজ কোথাও ফার্স্ট লেডি হিসাবে তাঁর দাপটের কথা অভিযোগ কেউ শোনেনি!
মনমোহনের সফরকে সামনে রেখে গুরশরণের সেই প্রথম মিডিয়া ইন্টারভ্যুর কথা মনে পড়ল। ঢাকায় থাকলে সফরের কোন এক ফাঁকে তাঁর কাছে জানতে চাইতাম ফার্স্ট লেডি হিসাবে তাঁর গত সাত বছরের জীবন-অভিজ্ঞতা। মজা করে জানতে চাইতাম তাঁর দেশে এখন রান্নার গ্যাসের দাম সাধারণ গৃহবধূদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে কিনা! অথবা জানেন কিনা বাংলাদেশের ফার্স্ট লেডিদের বৃত্তান্ত! সুযোগটি নিতে পারেন কোন একজন সাংবাদিক বন্ধু। কারণ ভারতীয় এই ফার্স্ট লেডির কাছে শেখার অনেককিছু আছে। যার দৃষ্টান্ত অবশ্য বাংলাদেশেও আছে অথবা নেই!
বাংলাদেশের ফার্স্ট লেডি হিসাবে মানুষ খালেদা জিয়া আর রওশন এরশাদকেই বেশি চিনেছে দেখেছে এবং বুঝেছে! এর আগে মুজিবনগর সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন মুক্তিযুদ্ধকালীন এক রকম সন্ন্যাস জীবন কাটিয়েছেন। পচাত্তরে তাজউদ্দিন খুন হবার পর জোহরা তাজউদ্দিন রাজনীতিতে আসায় সবাই তাঁর নাম জানেন। কিন্তু সৈয়দ নজরুলের স্ত্রীর নাম জানেন ক’জন?
দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকে আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের নাম জানেন। বারবার গ্রেপ্তার হওয়া এক রাজনৈতিক নেতার সাধারণ বেশ-পোশাকের একা সবদিক সামাল দেওয়া স্ত্রী এক নারী হিসাবে তাঁর ইমেজ পরিচয়ের বিষয়টি দেশের ফার্স্ট লেডি হওয়ার পরও খুব বদলায়নি।
পচাত্তরের পনের আগস্ট রাষ্ট্রপতি স্বামীসহ স্বজনদের সঙ্গে নিহত হন বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ফার্স্ট লেডি যিনি এভাবে ঘাতকের হাতে খুন হয়েছেন! বা এমন দুর্ভাগ্যের ঘটনা খুব বেশি নেই বিশ্বের ইতিহাসেও! পচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পর কিছু সময় খোন্দকার মোশতাক, কিছু সময় বিচারপতি সায়েমকে ক্ষমতায় রাখা হলেও আসল ক্ষমতাসীন হন জেনারেল জিয়াউর রহমান। ফার্স্ট লেডি হন খালেদা জিয়া। স্বামীর সঙ্গে নিয়মিত বিদেশে সফরসঙ্গিনী হলেও জিয়া তাঁর স্ত্রীকে কখনো কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করেননি। কোনো সামাজিক কর্মকাণ্ডেও তাঁকে জড়াননি বা জড়িত হতে দেননি।
জিয়া প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক থাকার সময়ে বায়তুল মোকাররম মার্কেটের বিখ্যাত শাড়ির দোকান পাবনা স্টোর থেকে অনেকগুলো শাড়ি খালেদা জিয়া ও তাঁর বড়বোন চকলেট আপার (এখন প্রয়াত) উপহার হিসাবে গ্রহণ এবং ঘটনা জানার পর ক্ষুদ্ধ জিয়ার তা ফেরত দেওয়ার ঘটনা ঘনিষ্ঠ সাংবাদিকরা জানেন। জিয়া নিহত হবার পর এক টিভি সাক্ষাৎকারে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, সংসার খরচ চালানোর জন্যে মাসে তাঁকে দু’হাজার টাকা দেওয়া হতো। ওই টাকার ভিতর তিনি খুব কষ্টে সংসার চালাতেন।
একই টিভি সাক্ষাৎকারে তারেক-কোকো বলেছিলেন, তাঁদের বাবা তাঁদেরকে পুরনো শার্ট দর্জি দিয়ে ছোট করিয়ে পরতে দিতেন। বিএনপি অবশ্য এখন আর গল্পগুলো বলে না।
বাংলাদেশের এ যাবতকালের সবচেয়ে দাপটের আর লম্বা সময়ের জন্য ফার্স্ট লেডি ছিলেন রওশন এরশাদ। এমন কী ফার্স্ট লেডি হিসাবে তাঁকে তখন একটি অফিসও দেওয়া হয়। ফার্স্ট লেডি হিসাবে নিয়মিত বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতেন রওশন। রাষ্ট্রীয় বেতার-টিভিতে সেসব বাধ্যতামূলক প্রচার করা হতো। রওশন ছাড়াও এরশাদ তখন আরেকজন ছায়া ফার্স্ট লেডি(!) হিসাবে তাঁর বান্ধবী জিনাত মোশাররফের সমাজসেবার (!) প্রচারেরও ব্যবস্থা করতেন। এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর পদচ্যুত ফার্স্ট লেডি রওশনের নানান দুর্নীতি প্রকাশ পায়! তাঁর শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে রাখা ট্রাঙ্ক ভর্তি টাকাও উদ্ধার করা হয়। জনতা টাওয়ার নামের যে দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হিসাবে এরশাদ পাঁচ বছর নির্বাচন করতে পারেননি, ওই সম্পত্তিও রওশনের নামে করা হয়েছিল।
এরশাদের পতনের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ রাষ্ট্রপতি হলেও তাঁর স্ত্রী ফার্স্ট লেডি হিসাবে আলোচনার পাদপ্রদীপে কখনো আসেননি। বিএনপি ক্ষমতায় ফিরলে আব্দুর রহমান বিশ্বাস রাষ্ট্রপতি হন। এরপর আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় ফিরলে আবার রাষ্ট্রপতি হন বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ। বিএনপির ফের ক্ষমতায় প্রথমে বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও পরে অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমদ রাষ্ট্রপতি হন। তৎকালীন ফার্স্ট লেডি হিসাবে তাঁর অধ্যাপিকা স্ত্রী আনোয়ারা আহমদের কোন দাপট দেখানোর অভিযোগ কেউ কখনো করেনি।
১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া-শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ধারাবাহিক সংসদীয় সরকার চলছে দেশে। এদের মধ্যে উভয় মেয়াদে সধবা হিসাবে ক্ষমতাসীন হলেও শেখ হাসিনার বিজ্ঞানী স্বামী ড ওয়াজেদ মিয়া কখনো ক্ষমতার দাপট দেখাননি। প্রথমে রাষ্ট্রপতির জামাই ও পরে প্রধানমন্ত্রীর স্বামী হিসাবে ক্ষমতার বলয়ের মধ্যে থাকলেও তিনি যে সব সময় ক্ষমতা থেকে দূরে থাকতেন, তাঁর মৃত্যুর পর সবাই তা বলেছেন। বর্তমান রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের আমলে ফার্স্ট লেডিবিহীন চলছে বঙ্গভবনের দিনরাত্রি! ২০০৪ সালের ২১ আগষ্ট তৎকালীন বিরোধীদলের নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার উদ্দেশে পরিচালিত গ্রেনেড হামলায় নিহত হন বর্তমান রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমান।
ফজলুল বারী: সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক