ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

ঢাকায় হয়ে গেলো দুটি ঐতিহাসিক খেলা!

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৭, ২০১১
ঢাকায় হয়ে গেলো দুটি ঐতিহাসিক খেলা!

একদিনে দুটি খেলা হয়েছে দেশে-ঢাকায়! বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে আর প্রধানমন্ত্রীর নাখালপাড়ার অফিসে! সাধারণ খেলা নয়, মহারণ! দুটোই আবার ঐতিহাসিক তকমা পেয়েছে! আর্জেন্টিনা বনাম নাইজেরিয়া আর বাংলাদেশ বনাম ভারত! প্রথমটি সত্যিকার অর্থে খেলার মাঠের খেলা। দ্বিতীয়টি প্রতিবেশী দুই দেশের টাগ অব ওয়ার! রাজনীতির-কূটনীতির।



ঢাকার মাঠেও নাইজেরিয়ার বিরুদ্ধে মেসি জাদুতে প্রত্যাশার জয় পেয়েছে আর্জেন্টিনা। বাংলাদেশের ব্রাজিল সাপোর্টাদের বেশিরভাগ কী মনের থেকে তাই আশা করেছিলেন? মনে হয় না। অর্থাৎ আর্জেন্টিনার জয়ে তারা জেতেননি।
 
আর এভাবে তিস্তা চুক্তি না হওয়াতে জিতল না বাংলাদেশ! অধরা থেকে গেল সীমান্ত সমস্যার সমাধানও? ১৬২ ছিটমহল হস্তান্তর, তিনবিঘা ২৪ ঘণ্টা খোলা, ৬১ পণ্যে শুল্কছাড়ও তিস্তার পানির কান্নায় ভেসে গেল! এরপরও দিল্লির মেহমান ঘরে এসে পড়েছেন বলে আবেগে অথবা আদিখ্যেতায় ট্রানজিট পরিপত্রে স্বাক্ষর করে ফেললে কিন্তু খবর ছিল!
 
তিস্তা চুক্তি পানিতে ফেলায় ট্রানজিট চুক্তি ঢুকে গেছে ফাইলে! সারাদিন ধরে এ নিয়ে চলেছে অস্বস্তি। এর শোধ কে কিভাবে নেবে? এতসব না পাওয়া কী করে সামাল দেবেন শেখ হাসিনা? আনন্দবাজার লিখেছে এর মাঝে সাংবাদিক বেবী মওদুদকে তিনি দূত হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে পাঠিয়েছেন! ট্রানজিট  স্বাক্ষর না করার শোধ কী নেবে ভারতীয় চানক্য কূটনীতি?  ভারতীয় ব্যবসায়ীদের  ট্রানজিট যে বড় দরকার ছিল! বাংলাদেশে ঠান্ডা মাথায় শান্তিতে ব্যবসার জন্য তাদের বড় অনেকের নাকি আবার বিএনপিকে পছন্দ!
 
ভিন্ন একটি অপেক্ষাও ছিল বিএনপির! সে কারণে বিশেষ জরুরি এক  বৈঠকও হয়েছে খালেদা জিয়ার গুলশান অফিসে। কারও কারও জাতীয়তাবাদী(!) মনটি কী একটু বেশি খারাপ হয়েছে? ট্রানজিটের নামে করিডোর অথবা দেশ বিক্রির গোলামী হয়ে গেছে বলে সরকারকে তুলোধুনো করার প্রস্তুতিটাও কী মাঠে মারা গেল আপাতত! কিন্তু বিরোধীদলে থাকলেতো ইস্যুর অভাব হয় না! এখন তিস্তা চুক্তি আর সীমান্ত সমস্যা সমাধানের কূটনৈতিক ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে তারা মাঠ গরমের চেষ্টা করতে পারে! তিনবিঘা সমস্যা মিটলেও সীমান্তে বিএসএফ এর হত্যাকান্ড বন্ধের কোন প্রতিশ্রুতি মনমোহনের সফরে আসেনি।
 
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের দীর্ঘ অপেক্ষার তিস্তার পানি চুক্তির কথা আমরা আগে লিখেছি। এনিয়ে দু’দেশের প্রাক আলোচনাও বেশ এগিয়েছিল। কিন্তু অপেক্ষা-প্রত্যাশার তিস্তার পানি বন্টন চুক্তিটিকে কিনা শেষ মূহুর্তে পানিতে ফেলে দিলেন পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। এরপর ভারতের সংশ্লিষ্ট সচিব দিল্লিতে মিডিয়াকে বলে দিলেন পানি চুক্তি হচ্ছে না।
 
আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি ঢাকায় দিলেন উল্টো মিথ্যে আশ্বাস! মনমোহনের সঙ্গে ভারতীয় পানিসম্পদ মন্ত্রীকে না দেখে সবাই নিশ্চিত হলেন দীপু মনির কথা ঠিক না! বেচারী আর কী! মনমোহনের সফর প্রস্তুতির কোথাও তাঁকে রাখা না হলেও শেষ পর্যন্ত তিনিই কিনা মিডিয়ার কাছে মিথ্যা সাজলেন? অথচ যারা এসব নিয়ে হিল্লি-দিল্লি করেছেন, তারা এখন কোথায়!
 
বাংলাদেশের মানুষের পাওনা পানির জীবনমরণ চুক্তিটি আটকে মনমোহনের সফর পন্ড করে দিতে পারার সাফল্য(!)এখন মমতার! তার দেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরের গুরুত্বটাই পাংচার করতে গিয়ে তিনি আটকে দিয়েছেন আমাদের পাওনা পানির ন্যায্য হিস্যা! –দেখা যাবে দিদি, দিন যায় কথা থাকে।
 
এখন আর কী পানি আলোচনা খুব শিগগিরই হবার সম্ভাবনা আছে! অদূর ভবিষ্যতে সে সুযোগ যদি আসে, এখানে আমরা সরকারকে দুটি বিষয়ে বলব। প্রথম কথাটি হচ্ছে তিস্তার পানিচুক্তি অনিশ্চিত হয়ে যাবার পর এখনই ট্রানজিট নয় এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্তটি নিয়ে ফেলার জন্য ধন্যবাদ। সাধারণত আমাদের দেশের সরকারগুলো ভারত বা বড় কোনও প্রতিপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় নিজের থেকে অথবা অপ্রকাশিত নানা কারণে অপ্রয়োজনীয় নতজানু হয়ে যায়। পূর্ব পুরুষদের দু’শ বছর গোলাম থাকার অভিজ্ঞতা ভুলতে পারে না!

দ্বিতীয় কথাটি, এবার সৃষ্ট অবস্থার কারণে তাৎক্ষণিক ‘তিস্তা চুক্তি না হলে ট্রানজিট চুক্তি নয়’ নীতি নেয়া হলেও ভবিষ্যতে যাতে বিষয় দুটিকে এক নিক্তিতে মাপা না হয়। কারণ ইস্যু দুটির প্রেক্ষাপট আনুষাঙ্গিক বিষয়াদি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
 
আঞ্চলিক অভিন্ন নদীর ভাটির দেশ হিসাবে পানির ন্যায্য হিস্যার বিষয়টি আমাদের অধিকার। মমতা ব্যানার্জি অথবা যে কোন ‘হনুরে’ যেখানে-সেখানে যত বাগড়াই দেননা কেন, আন্তর্জাতিক আইনে পানির ন্যায্য হিস্যা আমাদের দিতেই হবে। আপনি বড় ভাই বলে পানি যা খুশি বেশি নেবেন আর ছোট ভাই হওয়াতে আমাকে কম দেবেন, আন্তর্জাতিক আইনের কোথাও এমন উল্লেখ নেই। আপনি ভারত নতুন আন্তর্জাতিক মুরব্বি হবার চেষ্টা করছেন, আর অভিন্ন নদীতে প্রতিবেশীর ন্যায্য হিস্যার প্রাপ্তিতে বঞ্চিত করবেন, আজকের খোলামেলা দুনিয়ায় সেটি আর আগের মতো সহজ-সম্ভব না। বেশি টানাহেঁচড়া ভদ্রতার পোষাকপরিচ্ছদও গায়ে-গতরে জায়গামতো থাকবে না।

ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সহায়তাকারী বন্ধুরাষ্ট্র। ড. মনমোহন সিং এর মতো একজন নীতিবান-অর্থনীতিবিদ এবং ভদ্রলোক এখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী। যিনি বাংলাদেশের ক্ষতি হবে এমন কিছু না করার বিষয়েও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ঢাকার মিডিয়া বিবৃতিতেও তিনি অভিন্ন নদীর পানির ভাগাভাগিকে বিরোধের সূত্র না, উন্নয়নের সোপান হিসাবে দেখতে ভাবতে বলেছেন।

ভদ্রলোক মনমোহন তার এই বক্তব্যের আলোকেই পানি চুক্তির বিষয়ে ফয়সালায় নতুন চেষ্টা শুরু করা যেতে পারে। ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রতিবেশী বাংলাদেশ আশা করতে আন্তর্জাতিক আইনে প্রাপ্য অধিকারের লাইনে থাবেন ভদ্রলোক মনমোহন। উনাদের আব্রুতে শরমিন্দার সৃষ্টি করতে পারে এমন কোথাও যেন আমাদের যেতে না হয়।
 
এর পরের বিষয় ট্রানজিট। এটি যেমন ভারত অনেকদিন ধরে চাইছে, কিন্তু এ বিষয়টিতে আমাদের এখন পর্যন্ত কোন প্রস্তুতিই নেই। এখন পরন্ত যা হয়েছে তাও হলো আওয়ামী লীগ শুধু বিএনপির প্রচারনার জবাব দিয়েছে। ট্রানজিটের অবকাঠামো প্রতিষ্ঠার কিছু করেনি।
 
ট্রানজিট না করিডোর, ডিম না আণ্ডা এই বিতর্কেই আমজনতাকে দেখানো হয়েছে জুজুবুড়ির ভয়! অথচ দুনিয়ার বাস্তবতা ট্রানজিট। ভারত থেকে এখন যে বাস-ট্রেন আসে-যায় সেগুলোর চালকসহ স্টাফদের যার যার দেশের বৈধ পাসপোর্ট-ভিসা থাকতে হয়। আমরাও তেমন বৈধ পাসপোর্ট ভিসায় পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে সেখান থেকে চলে যাই ভারতের নানা রাজ্যে।
 
কিন্তু আমি আমরা ভারতের যেখানেই চলে যাই না কেন সেদেশের আইন আর নজরদারির বাইরে থাকি কী, না ভারত থেকে আসা লোকজনকে নজরদারির বাইরে রাখি? তাছাড়া এই বাস-ট্রেন চালু হয়ে গেলেই ভারতীয় সন্ত্রাসী বানের পানিরমতো যে এখানে ঢুকে যাবে-সন্ত্রাস চালাবে বলা হয়েছিল, তেমন কোন ঘটনা আজ পর্যন্ত ঘটেছে কী? ট্রানজিট হলে সে সুযোগ গ্রহণকারী যানবাহনের চালক-স্টাফ-যাত্রীদেরতোও তেমন বৈধ পাসপোর্ট-ভিসা থাকবে বা থাকতে হবে তাই নয় কী?
 
কিন্তু এসব তাদের কাল্পনিক চিল্লানো ভয়ভীতি ছড়ানোর পুরনো ধারা বহালই আছে। বাজছেই  উনচল্লিশ বছরের আগের সেই রেকর্ড! মনমোহনের সফরকে কেন্দ্র করে ফেইসবুকে এক তরুণ তার কমেন্টসে লিখেছেন, ভারতকে তিনি ঘৃণা করার কারণ স্বাধীনতার আগে থেকে  তারা এদেশটিকে অঙ্গরাজ্য বানানোর চেষ্টা করছে। সে লক্ষ্য নিয়েই মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তখন তারা অস্ত্র তুলে দিয়েছিল! বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মকে এ ধরনের ভুল-বানোয়াট গল্প সমগ্র কে শিখিয়েছে? এভাবেই পার্বত্য শান্তিচুক্তি হলে ফেনী পর্যন্ত ভারত হয়ে যাবার গল্প কি বলা হয়নি? হয়েছে।

ট্রানজিট নিয়ে বর্তমান সরকারও এখন বাস্তবের জায়গায় এসেছে। অর্থাৎ এখনই ট্রানজিট  দেবার মতো অবকাঠামো বাংলাদেশে নেই। বাংলাদেশের হালকাপাতলা সব গাড়িগুলাই এখানে প্রয়োজনীয় মেরামত-রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভাঙ্গাচোরা রাস্তাঘাটে চলতে পারেনা! মহাসড়কের মধ্যে মধ্যে পুকুরের মতো গর্ত হয়ে যাওয়া নিয়ে যানবাহনের মালিক-চালকরা ঘোষণা দিয়ে সেগুলোর চলাচল বন্ধ করে দেন! এরপর দেশের প্রধানমন্ত্রীকে উদোগী হয়ে রাস্তা মেরামতের কাজ শুরু করাতে হয়!
 
আর ট্রানজিটপ্রাপ্ত ভারতীয়-নেপাল বা ভূটানের বিশাল সব লরির বহর যদি ‘হাওয়া হাওয়া ও হাওয়া’ গাইতে গাইতে এসব রাস্তা দিয়ে ঢোকে তাহলেতো তিনদিনের মধ্যে পরিত্যক্ত বন্ধ হয়ে যাবার কথা দেশের প্রধান সব মহাসড়ক! আর ট্রানজিটের মালবাহী ট্রেন চলাচলের মতো ব্রডগেজ লাইনও সারাদেশে নেই। এসব মালবাহী ট্রেন মানে ভারী ভারী সব কন্টেনারবাহী যান। সেই ব্রিটিশদের বানিয়ে যাওয়া আমাদের রেললাইনের হালকাপাতলা পাথর আর রক্ষনাবেক্ষণের যে অবস্থা, ভারতীয় ওইসব ভারিক্কি মালবাহী ট্রেন সব কয়েক ঘন্টা চললেই লাইনসব দেবে যাওয়াসহ তা ট্রানজিট দিতে গিয়ে রেল যোগাযোগের বিপর্যয়ের আন্তর্জাতিক কৌতুককর খবরও হয়ে যেতে পারে।

তাই  ট্রানজিট চুক্তির আগে সরকারকে এর অবকাঠামো তৈরিতে মনোযোগ দিতে হবে। অত টাকার গৌরীসেন কী ঠিক করা আছে? আর তিস্তা চুক্তি আর ট্রানজিটকে যেন এক নিক্তিতে বা পরষ্পরের পরিপূরক ধারনায় গুলিয়ে ফেলা না হয়। সবকিছুতে সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে দেশের স্বার্থ। মমতা ব্যানার্জি তার রাজ্যের স্বার্থে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করতে দেননি। আগামিতে তাঁর সঙ্গে ছবি তোলার আশায় নিজের দেশের স্বার্থ বাদ দিয়ে দিদির স্বার্থ প্রতিষ্ঠা-সংরক্ষণে আমরা যাতে উতালা-দিওয়ানা হয়ে না যাই।
 
ফজলুল বারীঃ সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক।

বাংলাদেশ সময় ১০৫৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৭, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।